প্রবীণ জীবনে অবসর : একটি নতুন চ্যালেঞ্জ

হাসান আলী, সভাপতি, এজিং সাপোর্ট ফোরাম

প্রকাশ : ২১ জুলাই ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

অবসর মানে কাজ নেই। অর্থাৎ কাজ করে আয়-রোজগার করতে হয় না। মানুষ কাজ বলতে বোঝে শারীরিক বা মানসিক শ্রমের বিনিময়ে অর্জিত টাকা-পয়সা। যে কাজে টাকা-পয়সা রোজগার হয় না, তাকে আমাদের সমাজ কাজ হিসেবে গ্রহণ করতে চায় না। অবসর হলো ব্যক্তির পেশাগত জীবনের অবসান। সামাজিকভাবে কিছু সংখ্যক লোকের অনুৎপাদনশীল ভূমিকায় যাওয়া। আমাদের সমাজ যখন কৃষিনির্ভর ছিল তখন বার্ধক্য বিষয়টি এতটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল না। ফসল উৎপাদনে কঠোর পরিশ্রম করতে হতো। উৎপাদিত ফসল দিয়ে নিজের এবং পরিবার-পরিজনের চাহিদা মেটাতে পারত, সন্তান-সন্ততিরা কৃষি কাজে সহায়তা করত। ব্যক্তি যৌবনে কঠোর পরিশ্রম করতে পারতেন, আস্তে আস্তে পরিশ্রম করার ক্ষমতা কমতে থাকত। অসুখ-বিসুখ ক্রমেই দুর্বল করে তুলত। একসময় প্রবীণ জীবনে প্রবেশ করত; কিন্তু তখন পর্যন্ত সংসারের নিয়ন্ত্রণভার তার ওপরই থাকত। প্রবীণ জীবনে প্রবেশ করে ব্যক্তি হালকা কাজকর্মে নিজেকে সক্রিয় রাখতেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রবীণরা কাজকর্মে ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করতেন। অর্থাৎ যতক্ষণ শরীরে শক্তি থাকত ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো না কোনো কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন। আবার যাদের জমিজমা কম ছিল কিংবা ছিল না, তারা প্রবীণ বয়সে এসে হালকা কাজকর্ম করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। একসময় কাজ পাওয়া যেত না, শরীর দুর্বল হয়ে যেত, অসুখ-বিসুখে কাতর হয়ে ভিক্ষাবৃত্তি কিংবা চেয়েচিন্তে খাওয়া-পরা চলত। ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের পর সমাজে ব্যাপক পরিবর্তন শুরু হয়। পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কগুলো কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। কৃষিনির্ভর সমাজে গড়ে ওঠা নীতিনৈতিকতা-মূল্যবোধ নতুন পরিস্থিতির মুখোমুখি হলো। পণ্যসামগ্রীর উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং উদ্বৃত্ত উৎপাদন করার ক্ষমতা অর্জিত হয়। অনেকেই স্বনিয়োজিত কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে কলকারখানায় এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে যোগ দেন। রাষ্ট্রের কাজকর্ম বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকারি চাকরিতে বিশালসংখ্যক লোকের কর্মসংস্থান হয়। আমেরিকায় ১৯২১ সালে প্রথম সরকারি কর্মচারীদের পেনশন প্রথা চালু করা হয়। ইংল্যান্ডে শুধু স্থায়ী সরকারি কর্মচারীরা পেনশন পেত। শিল্প বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বৃহৎ আকারের শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে থাকে। নতুন নতুন প্রযুক্তি উৎপাদনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। শারীরিক পরিশ্রমের বদলে মানসিক পরিশ্রমের গুরুত্ব বেড়ে যায়। নতুন প্রযুক্তি নবীনরা আয়ত্ত করে নেয় দ্রুত। অপেক্ষাকৃত প্রবীণদের প্রশিক্ষণ দিয়ে নতুনদের সমান করে দক্ষতা বৃদ্ধি করা কঠিন হয়ে পড়ে। চাকরির বাজারে নবীনদের কদর বেড়ে যায়। প্রবীণদের কর্মক্ষেত্র ছোট হয়ে আসে। অধিক লাভের আশায় পুঁজিবাদ রাষ্ট্রশক্তির সঙ্গে এক হয়ে অবসর গ্রহণকে বাধ্যতামূলক করে দেয়। দার্শনিক ব্যাখ্যা দেয়া হয় প্রবীণরা কাজ ছেড়ে না দিলে নবীনরা কাজের সুযোগ পাবে না। দেশ নবীনদের সেবা থেকে বঞ্চিত হবে। প্রবীণরা অবসর জীবনে যাওয়ার নির্দিষ্ট বয়স পেল। একই সঙ্গে অনাগত ভবিষ্যতের কথা ভেবে চিন্তিত হলো। রাষ্ট্রশক্তি, আমলাতন্ত্র, পুঁজিপতি শ্রেণী অবসর গ্রহণকে উৎসাহিত করতে পেনশন ও গ্রাচুইটি চালু করে। অবসর গ্রহণের নির্দিষ্ট বয়সের আগেই নানা রকম আর্থিক সুবিধার ঘোষণা দিয়ে অবসর গ্রহণকে উৎসাহিত করা হয়। এসব কর্মসূচিকে ‘গোল্ডেন হ্যান্ডশেক’ হিসেবে প্রচার করা হয়। যেসব দেশে অধিক উৎপাদন এবং আয়- রোজগার ভালো সেসব দেশে আকর্ষণীয় সরকারি/বেসরকারি পেনশন দিচ্ছে। এতে অবসর গ্রহণের জন্য অনেকেই অনুপ্রাণিত হচ্ছে। যেসব দেশ আর্থিকভাবে দুর্বল, সেসব দেশে অবসর ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা কম। বাংলাদেশে সরকারি কর্মচারীরা আমৃত্যু পেনশন, চিকিৎসা ভাতা, উৎসব ভাতা ইত্যাদি পেয়ে থাকেন। তাদের মৃত্যুর পর স্বামী কিংবা স্ত্রী আমৃত্যু পেনশন ভোগ করতে পারেন। নাবালক সন্তানসন্ততিরা একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পেনশন পেয়ে থাকে। প্রতিবন্ধী সন্তান আজীবন পেনশন পায়। বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এককালীন সুবিধা পান। বেশিরভাগ শিল্প-কলকারখানা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত গ্রাচুইটি সন্তোষজনক নয়। চাকরির বয়সসীমায় পৌঁছলে বাধ্যতামূলক অবসর নিতে হয়। অনেকেই আছেন নির্দিষ্ট সময়ের আগেই অবসর নেন। কেউ যখন স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করতে চান তখন মনে করা হয়, চাকরির চেয়ে অবসর জীবন অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। আবার কেউ কেউ আছেন শারীরিক বা মানসিকভাবে অক্ষম, তারা নির্দিষ্ট বয়সসীমার আগেই অবসর নেন। অবসর গ্রহণকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার ক্ষেত্রে সমাজ ব্যবস্থার দৃষ্টিভঙ্গি হলো যুব বয়সীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। এটি বৈষম্যমূলক এবং বয়সবিদ্বেষী মনোভাব। বাংলাদেশে অবসর গ্রহণের পর অনেক যোগ্য-দক্ষ ব্যক্তিকে একটি পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়। সাংবিধানিক পদ ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদে অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণদের নিয়োগ দেয়া হয়। এগুলো সংখ্যায় অনেক কম। আমার প্রশ্ন হলো, মানুষ কতদিন কাজ করবে? জীবনের উদ্দেশ্য কি শুধু কর্ম এবং কর্মঠ থাকা? শুধুই অর্থ উপার্জন? সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ? পেশাগত কাজই কি সব? এসব প্রশ্নের উত্তর আমি খুঁজে বেড়াই। কখনও বইপত্রে, আবার কখনও জ্ঞানী ব্যক্তিদের সান্নিধ্যে এসে। বেশিরভাগ সময়ই আমার পছন্দ মতো উত্তর পাই না। জ্ঞানী ব্যক্তিদের কাছে গিয়ে হতাশ হতে হয়। তাদের কেউ বলেন ‘সক্রিয় বার্ধক্য’ প্রবীণ জীবনের কাম্য। কবরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত কর্মক্ষম থাকবেন প্রবীণ। আমার মন এতে সায় দেয় না। মন বলে পেশাগত কাজ সব নয়। জীবনে অনেক কিছু করার, দেখার, বোঝার, উপভোগের রয়েছে। জীবনকে বৈচিত্র্যপূর্ণ করা, রঙিনভাবে সাজিয়ে তোলা, আনন্দদায়ক করা, ভোগবাদী সংস্কৃতি থেকে মুক্ত করা এগুলো জীবনের অংশ বলে মনে করি। প্রবীণ জীবনে এগুলোর গুরুত্ব নিশ্চয়ই রয়েছে। গায়ে খাটা প্রবীণ শ্রমিক দিন শেষে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। ক্ষুধা নিবারণের পর ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দেন। যিনি প্রবীণ জীবনে গায়ে খাটা শ্রমিক নন, তিনি তার পেশাগত সাফল্য, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, অনিশ্চয়তার মধ্যেই ক্লান্ত হয়ে পড়েন। জীবনের সমস্যাগুলোকে সত্যিকার বৈজ্ঞানিক যুক্তিতর্ক দিয়ে ভাবতে চান না। বেশিরভাগ সময়ই নিয়তির কাছে আশ্রয় নেন একটু শান্তির আশায়। বৃদ্ধ বয়সে ভাবনা আসে। আমি কে? আমার জীবনের লক্ষ্য কী? পৃথিবীতে আমি কেন এসেছি? দীর্ঘ সময় ধরে বেঁচে থাকলাম কেন? মৃত্যুর মধ্য দিয়ে কী জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে? মৃত্যু-পরবর্তী জীবন কেমন? এ ধরনের প্রশ্ন মাঝে মাঝেই অবসর জীবনকে ভাবিয়ে তোলে। আর মাত্র ৩০ বছরের মধ্যেই পৃথিবীর জনসংখ্যার পাঁচভাগের একভাগ প্রবীণ হবে। এই প্রবীণরা কমবেশি বিত্তবান অবসরভোগী হিসেবে আবির্ভাব হবেন। আধুনিক যন্ত্রপাতির উন্নতি, প্রযুক্তির উচ্চ ব্যবহার, শিল্প-কলকারখানার আধুনিকায়ন, কৃষির অবিশ্বাস্য সাফল্যে মানুষের দৈনন্দিন কর্মঘণ্টা কমে যাবে। অনেক অফিস-আদালতের প্রয়োজনীয়তা ফুরাবে। সাপ্তাহিক ছুটির দিন দুই দিনের পরিবর্তে চারদিন হবে। দৈনিক ৮ ঘণ্টার পরিবর্তে ৪ ঘণ্টার অফিস হবে। কঠিন দুঃসাধ্য কাজ রোবট দ্বারা সম্পাদিত হবে। একজন মানুষের শুধু ১০ বছর কাজ করলেই সারা জীবনের ভরণপোষণ, বিনোদন, চিকিৎসা, আশ্রয়ের ব্যবস্থা হবে। মানুষের কায়িক শ্রম বলতে কিছু থাকবে না। চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতি মানুষের আয়ু আরও বাড়িয়ে দিয়ে ১২০ বছর হবে। চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের বাধ্যতামূলক বয়স হবে ৪০ বছর।

নতুনদের কাজের সুযোগ দিতে সবাইকে ৪০ বছর বয়সেই অবসর নিতে হবে। এমন একটা সমাজজীবন আসার সম্ভাবনা আমরা দেখতে চাই। দীর্ঘায়িত এ জীবনকে কেমন করে বয়ে বেড়াতে হবে তার পরিকল্পনা কী? আমাদের একদল জ্ঞানী লোক ভাবেন অবসর গ্রহণের পর প্রবীণদের আয়বৃদ্ধিমূলক কাজে যুক্ত থাকা উচিত।

প্রবীণদের কর্মক্ষম থাকার জন্য, অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর হওয়ার জন্য কাজের মধ্যে থাকতে হবে। আরেক দল ভাবেন মৃত্যুর পরবর্তী জীবন শান্তিপূর্ণ আনন্দদায়ক করাই একমাত্র কাজ। বর্তমানে নবীন জনগোষ্ঠী ভোক্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যাদের প্রধান আগ্রহ শুধু ভোগে।

তারা সব কিছু গো-গ্রাসে ভোগের জন্য আকুল। পোশাক, খাবার, নেশা, টেলিভিশন, ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন, বক্তৃতা, নাটক, গানবাজনা, যৌনতা, শিল্পকর্ম, নাটক, বইপত্র সবকিছু ভোগ করার জন্য অস্থির হয়ে আছে। এই জনগোষ্ঠী যখন প্রবীণ হবে তাদের চাহিদা কেমন করে মেটানো হবে আমি ভাবতে পারছি না। আমাদের নবীনরা ভোগের জন্য এত উতলা কেন? মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, এই প্রবল ভোগের তাড়নার পেছনে রয়েছে শূন্যতা, তিক্ততা, বিষন্নতা, হাহাকার, নিঃসঙ্গতা। প্রবীণরা অনেক দাবি করেন। সব দাবি যোগ করলে একটি দাবি প্রধান হয়ে দেখা দেয় তা হলো, ক্রয় এবং ভোগের স্বাধীনতা।

স্বর্গের কল্পনা প্রায় একই রকম। স্বর্গের বিপণিবিতান থেকে ইচ্ছা মতো কিনবেন এবং ভোগ করবেন। অবসরকে অর্থবহ করা আজকের দিনের নতুন চ্যালেঞ্জ।