ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কৃষকের উন্নয়নে চাই মনোভাব পরিবর্তন ও সচেতনতা

জাহিদ হাসান জিহাদ, কলাম লেখক
কৃষকের উন্নয়নে চাই মনোভাব পরিবর্তন ও সচেতনতা

বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর অপার সম্ভাবনার দেশ। এদেশের জনসংখ্যার ৪০ শতাংশের বেশি মানুষ কৃষির ওপর সরাসরি নির্ভরশীল। স্বাধীনতা-পরবর্তী দেশের কৃষি ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। সাম্প্রতি বৈশ্বিক করোনা মহামারিতে যেখানে বিশ্বের শিল্পনির্ভর এবং উন্নত দেশগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থা ভেঙে পড়েছে, সেখানে কৃষিনির্ভর আমাদের দেশ মাথা উঁচু করে রয়েছে সগৌরবে। কৃষি সম্প্রসারণ, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, কৃষি অর্থনীতি, বাজার ব্যবস্থাপনা, সার ব্যবস্থাপনা, উচ্চ ফলনশীল জাত, কৃষি গবেষণার মাধ্যমে বদলে যাচ্ছে কৃষি খাত। আর এই কৃষির মূল কারিগর আমাদের দেশের কৃষক। দেশের কৃষির উন্নতি হলেও আশানুরূপ উন্নতি হয়নি আমাদের কৃষকদের। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে যেসব কৃষক ফসল ফলায়, দিন শেষে তাদের চুলাতেই আগুন জ্বলে না। বর্তমানে কৃষকদের জীবনমান উন্নয়নে সরকার নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কৃষি ঋণ, কৃষি প্রণোদনা, প্রশিক্ষণ, ফসল বীমাসহ বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকদের সহায়তা প্রদান করছে। সেই সঙ্গে কৃষকদের জীবনমান উন্নয়নে এনজিও এবং বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছে। তারপরও কৃষকদের জীবনমান উন্নয়নে তেমন কোনো পরিবর্তন আসছে না। এর কারণ কী? কৃষকরা কি এসব সুবিধা ঠিকমতো পাচ্ছেন না? নাকি এই পেশাটাই অলাভজনক?

আমাদের দেশের বেশিরভাগ কৃষক বাস করেন গ্রামে। কৃষিপণ্য উৎপাদন কাজে সরাসরি যারা নিয়োজিত তাদের বড় একটি অংশ হলো প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষক এবং ভূমিহীন বা বর্গা চাষি। যাদের ১০ থেকে ১৫ বিঘা জমি রয়েছে তারা খুব একটা কৃষি কাজ করেন না; জমি বর্গা দিয়ে অন্য পেশায় জীবিকা নির্বাহ করেন। আর সেই জমিতে প্রান্তিক ও ভূমিহীন কৃষকরা অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে ফলান সোনার ফসল।

ক্ষুদ্র, প্রান্তিক ও বর্গা চাষির সংখ্যা আমাদের দেশে বেশি। আবার অনেকটা অবহেলিত এই চাষিরায়। কৃষি সুবিধা নিতে গেলে তাদের পড়তে হয় ভোগান্তিতে, কৃষি ঋণ পেতেও তাদের নানা বেগ পেতে হয়। সরকারি সুবিধাও ঠিকমতো পৌঁছায় না তাদের পর্যন্ত। গবেষণার মাধ্যমে উচ্চফলনশীল বীজেও ভেজাল মেশানো, সারের মান নষ্ট আর ডিলারের কারসাজিতে পদে পদে ঠকছেন কৃষকরা। মাঠে যখন চাষ শুরুর সময় হয়- বর্গা ও প্রান্তিক চাষিদের কাছ থেকে বেশি দামে জমির লিজ খরচ ধরে জমির মালিক। বর্গামূল্য নির্ধারিত না হওয়ার কারণে প্রতিবছরই প্রায় বাড়তি টাকা দিতে হয়। এ বছর যে টাকায় বর্গা নিয়েছে জমি, আগামী বছর তার চেয়ে বেশি টাকা দিয়ে জমি বর্গা নিতে হয়। এতে চাষের শুরুতেই চাপে পড়ে কৃষক। মাঠে চাষ করবেন কিন্তু সে সময় জমিতে পানি নেই। শ্যালো ইঞ্জিনচালিত পাম্প ব্যবহার করবে; কিন্তু জ্বালানির দাম বেশি। যেসব এলাকায় প্রাকৃতিক উৎস, কিংবা সেচ প্রকল্প চলমান রয়েছে সেখানেও সমস্যা। বেশিরভাগ এলাকা অবৈধ দখলদারদের কাছে জিম্মি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, ধান উৎপাদনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটা মৌসুম হলো রবি মৌসুম। অথচ এই মৌসুমে দেশের বিভিন্ন এলাকায় তামাক চাষের ফলে সেচ সুবিধা ঠিকমতো মাঠে পায় না চাষিরা। কারণ রবি মৌসুমের বোরো ধানের জমিতে পানি নিতে চাইলে পার্শ্ববর্তী তামাক চাষির অসুবিধা। ফলে অধিক তামাক চাষ প্রবণ এলাকার বোরো ধান চাষিরা ঠিকমতো পানি পায় না। এ ছাড়া শস্য পর্যায় এবং মাঠের ‘ক্রপ প্যাটার্ন’ ঠিকমতো না করার কারণেও যত্রতত্র ফসল আবাদ করেন কৃষকরা। এতে নানা সময় ফলন কমে যায়। আমাদের দেশের অধিকাংশ এলাকার ক্ষুদ্র কৃষকদের জমির পরিমাণ এক দাগে কম। কম জমি, ভাগাভাগি হওয়া এবং একই ধরনের ফসল আবাদ না করার কারণে মাঠের জমিতে আইলের পরিমাণ বেড়ে যায়। সেক্ষেত্রে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ সুবিধা পায় না তারা। জমি খণ্ড হওয়ার ফলে তাদের চাষ, মই, আগাছা দমন, সেচ ইত্যাদি কাজে যান্ত্রিকীকরণ সুবিধা কম। যেখানে যান্ত্রিকীকরণ সুবিধা পায় কৃষকরা সেখানেও যন্ত্রপাতির মালিকদের কাছে এক প্রকারের জিম্মি তারা। তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে চাষ খরচ দ্বিগুণ হারে বেড়েছে। সেচ খরচও পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকার কৃষকদের জন্য প্রণোদনার মাধ্যমে যে সার, বীজ দিয়ে থাকেন তা ঠিকমতো প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকদের পর্যন্ত সব ক্ষেত্রে পৌঁছায় না। বিতরণ কাজে নিয়োজিত কিছু অসাধু ব্যক্তি, স্থানীয় ক্ষমতাশীল নেতাকর্মী, অকৃষকদের প্রভাবে প্রান্তিক এসব কৃষকরা অনেকটা বঞ্চিত হন প্রণোদনা থেকে।

সরকার এসব প্রণোদনা অনেকটাই স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধিদের স্বজনপ্রীতির কারণে মুখ থুবড়ে পড়ে। সেই সঙ্গে মনিটরিং ব্যবস্থা নড়বড়ে হওয়া এবং ভেজাল বীজের ফলে কৃষককরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাশাপাশি প্রণোদনা গ্রহণের ক্ষেত্রে ভোগান্তির কারণে এ সুবিধা থেকে অনেকটাই হতাশ প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকরা। কৃষক পর্যায়ে বিনামূল্যে এসব প্রণোদনা সুবিধা দেওয়ার কথা, অথচ কৃষি সম্প্রসারণ এসব সুবিধা বিনামূল্যে দিলেও সুবিধা প্রাপ্তির জন্য অসাধু জনপ্রতিনিধিদের অনেক ক্ষেত্রে টাকা দিতে হয় কৃষকদের। গ্রাম থেকে উপজেলা শহরে এসে একজন কৃষক সরকারি প্রণোদনা গ্রহণের ক্ষেত্রে তার দৈনিক শ্রমের মূল্য, সময় অপচয়, যাতায়াত খরচের তুলনায় প্রণোদনা কম পাওয়ায় অনাগ্রহ তৈরি হয়। আবার যথাসময়ে সার বীজ কৃষক পর্যায়ে না পৌঁছানোর ফলে সেগুলো কাজে লাগাতে পারে না কৃষক। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কৃষক পর্যায়ে কৃষি সেবা দিয়ে থাকেন। কৃষকরা যাতে ন্যায্যমূল্যে সার-বীজ কিনতে পারে এজন্য মনিটরিং করে কৃষি বিভাগ। কিন্তু মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার না হওয়ায় সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অতিরিক্ত দামে সার-বীজ কিনতে হয় কৃষকদের। মাঠ পর্যায়ে কর্মরত কর্মকর্তাদের মনিটরিংয়ের অভাবে বিভিন্ন এলাকায় বীজ কিনে প্রতারিত হয় কৃষক। আবার কোথাও কোথাও ভেজাল সার ও বীজ কিনেও ক্ষতিগ্রস্ত হয় তারা। কৃষকরে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এসব অসাধু ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেও তেমন কোনো লাভ হয় না। যার ঠকার, সেই কৃষকই দিনশেষে ঠকে। এছাড়া কৃষি শ্রমিকের তুলনায় অকৃষি শ্রমিকের মজুরি বেশি। এ কারণে ফসল রোপণ, পরিচর্যা, কর্তন, মাড়াই, সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনার সময় কৃষকরা প্রতি মৌসুমে ক্ষতিগ্রস্ত। সরকার কৃষি যান্ত্রিকীকরণে নানা প্রদক্ষেপ গ্রহণ করলেও যন্ত্রপাতি সহজলভ্য না হওয়ায় অনেকটায় সুফল পায় না তারা। এলাকা ও ফসল ভেদে কৃষি শ্রমিকের নির্ধারিত মূল্য নির্ধারিত না থাকার ফলে কৃষককে বাড়তি টাকা দিতে হয়। এতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। আবার ফসল চাষাবাদের ক্ষেত্রে আমাদের দেশের কৃষকদের অজ্ঞতাও রয়েছে। ফসলের জাত নির্বাচন সম্পর্কে জ্ঞানের অভাবের ফলে কোন মৌসুমে কোন ফসলের কি জাত আবাদ করতে হবে- এটা নিয়ে দ্বিধায় থাকে চাষিরা। এ ছাড়া মাঠ পর্যায়ে তারা এক জনের দেখা দেখি চাষ করে। এতে উচ্চ ফলনশীল ও উন্নত জাতের ফসল আবাদ সম্প্রসারণ কম হয়। একেক এলাকার মাটি, জলবায়ু একেক রকম। সে অনুয়াযী উদ্ভাবিত ফসলের জাত চাষে উক্ত এলাকায় চাষিদের প্রবণতা সৃষ্টি করতে হবে। এ ছাড়া সেসব ফসলের জাত সম্পর্কে কৃষকদের বিস্তর ধারণা প্রদান করতে হবে। আমাদের দেশের বেশিরভাগ কৃষক কোন ফসলের পরে কোন ফসল চাষ করলে ভালো হয়, রোগবলাই কম হয়, উৎপাদন বেশি হয়- এসব সম্পর্কে খুব একটা অভিজ্ঞ নয়। ফলে তারা চাষাবাদের ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া প্রতিবছর ভেজাল বীজ, আবহাওয়া, বন্যা, খরা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ তো থাকেই। এজন্য কৃষকদের ফসল চাষাবাদের আধুনিক কলাকৌশল সম্পর্কে প্রশিক্ষণ এবং মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন করা জরুরি। কৃষকরা মাঠ ফসলের আবাদ করেন; কিন্তু ফসলের রোগবালাই ও পোকামাকড় সম্পর্কে অনেকটাই অজ্ঞ। যার কারণে শস্যহানির মতো ঘটনা ঘটে। সচারচর ধানের জমিতে পোকা নড়াচড়া করলেই কৃষকরা মনে করেন জমিতে পোকার আক্রমণ হয়েছে। এর পরে ছুটে যান স্থানীয় কীটনাশকের দোকানে। সেখান থেকে কীটনাশকের দোকানির পরামর্শেই পোকার উপস্থিতি না দেখেই কীটনাশক কিনে এনে যত্রতত্র জমিতে দেন। কিন্তু জমিতে উপকারী এবং অপকারী এই দুই ধরনের পোকা ও মাকড় থাকে। উপকারী এবং অপকারী পোকা শনাক্ত না করেই কৃষকরা কীটনাশক স্প্রে করেন। এতে অপকারী পোকার পাশাপাশি উপকারী পোকা ধ্বংস হয়। ফলে ক্ষতি আরো বেশি হয়। এছাড়া সার বা কীটনাশকের সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে কৃষকরা অভিজ্ঞ নন। মাত্রা, কার্যকারিতা এবং প্রয়োগ পদ্ধতি সঠিকভাবে জানেন না। ফলে একদিকে যেমন সার ও কীটনাশক ব্যবহারে অপচয় হয়, ঠিক অন্যদিকে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। এদিকে মাঠ পর্যায়ে ফসলের রোগবলাই ও পোকা দমনের ক্ষেত্রে প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকরা বেশিরভাগই কীটনাশক বিক্রেতার ওপর নির্ভর করে। জমিতে কখন কোন কীটনাশক প্রয়োগ করবেন তার পরামর্শ বেশিরভাগই দেন ওইসব দোকানি। এদিক থেকে কীটনাশকের এসব দোকানির কাছেও জিম্মি থাকেন কৃষকরা। অনেক ক্ষেত্রে মেয়াদ উত্তীর্ণ কীটনাশক ব্যবহারের ফলে ঠিকমতো রোগ ও পোকা দমন হয় না। এক্ষেত্রে বাড়তি টাকা খরচ করতে হয় কৃষকদের। অনেক কৃষক আছেন যারা চাষের পরে ফসল বিক্রি করে সার ও কীটনাশকের মূল্য পরিশোধ করেন। যার কারণে ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত মুনাফার সুযোগ করে নেন। এক্ষেত্রে কৃষকরা যাতে ন্যায্য মূল্যে কীটনাশক ও সার কিনতে পারেন, সেদিকে মনিটরিং ব্যবস্থা আরো জোরদার করা প্রয়োজন। মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের পরামর্শদাতা কর্মকর্তাদের আরো আন্তরিক হয়ে কৃষকদের পরামর্শ প্রদানের ব্যবস্থা করা জরুরি। কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যে যেন কৃষক ন্যায্য মূল্য পায়, সেজন্য বর্তমান সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তবে তার পরেও কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য দাম পায় না। একজন কৃষকের স্বপ্ন থাকে, তার মাঠে এবার যে ফসল রয়েছে, তা যেন ঠিকমতো ঘরে তুলতে পারে। ফলন যাতে ভালো হয় আর দাম যাতে ঠিকঠাক পায়। একজন ভোক্তা চাই সরকার কৃষকদের জন্য সার-বীজ-জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু কৃষক পর্যায়ে সেগুলো নির্ধারণ করে ব্যবসায়ীরা। সারের মূল্য সরকার যে দাম নির্ধারণ করে দেয় তা থেকে কেজিপ্রতি ৫-১০ টাকা বেশি দিয়ে কিনতে হয় কৃষকদের।

বীজ ও জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রেও বিষয়টা একই রকম। কৃষক ধান উৎপাদন করলে ধানের দাম, পাটের দাম, আখের দাম, আলুর দাম, ডাল, পেঁয়াজ, সবজিসহ সব কৃষিপণ্যের দাম নির্ধারণ কৃষকের হাতে নেই। বর্তমানে ধানের একটি সরকারি দাম নির্ধারিত রয়েছে। কিন্তু কৃষকরা সে নির্ধারিত দামে বিক্রি করতে পারে না সরকারের কাছে। প্রভাবশালী নেতাকর্মীরাই কৃষক ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ধান কম দামে কিনে সরকার নির্ধারিত দামে সরকারের কাছে বিক্রি করে। অনেক ক্ষেত্রে সরকারি মূল্যের তুলনায় খোলা বাজারের দাম বেশি হয়, সেক্ষেত্রে ধানের প্রথম দাম নির্ধারণ করে চালকল মালিকরা, দ্বিতীয় দাম নির্ধারণ করেন বড় ব্যবসীয়রা, তৃতীয় দাম নির্ধারণ করেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও দালালরা, চতুর্থ দাম নির্ধারণ করে স্থানীয় সিন্ডিকেট। আর কৃষকদের বাধ্য হয়ে ওই স্থানীয় সিন্ডিকেটের কাছেই তাদের বেঁধে দেওয়া দামে ধান বিক্রি করতে হয়। কারণ কৃষকরা তাদের কাছে জিম্মি। পাটের ক্ষেত্রেও একই ব্যবস্থা চালু রয়েছে। আখ উৎপাদন করে কৃষক, আর তার দাম নির্ধারণ করেন আখ ব্যবসায়ী এবং মিলের অসাধু কর্মকর্তারা। যার কারণে সরকারি মূল্যে আখ বিক্রি করতে পারেন না কৃষকরা। দাম দিলেও টাকা না পাওয়া, ঘুষ না দিলে আখের ওজন কমে যাওয়া, টাকার পরিবর্তে চিনি দেওয়াসহ বিভিন্ন কারণে আখ চাষে অনাগ্রহ কৃষকদের। তেমনি আলুর দাম নির্ধারণ করে বাজার সিন্ডিকেট। ডাল, সবজির দামও বাজারের সিন্ডিকেটের হাতে। পেঁয়াজ উৎপাদন করে কৃষক আর তা থেকে লাভবান হয় অসাধু ব্যবসায়ীরা। কারণ কৃষক নিরুপায়। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম অর্থকারী ফসল তামাক। এতেও আছে ক্ষতির হিসেব। তামাক উৎপাদন করে শুধু কৃষক। তাছাড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ, দাম নির্ধারণ থেকে শুরু করে সবই নির্ধারণ করে দেয় কোম্পানিগুলো। তামাক চাষে দেশের সহজ সরল অভাবি কৃষকদের টার্গেট করে তামাক কোম্পানিগুলো কৃষকদের সঙ্গে জোঁকের মতো আচরণ করছে। চাষের শুরুতে নানা প্রলোভন দেখিয়ে, চড়া সুদে চাষের জন্য বীজ, সার দিয়ে পরবর্তী সময়ে তাদের নির্ধারিত দামেই কৃষকদের পণ্য বিক্রি করতে হয়। এ ক্ষেত্রেও কৃষক নিরুপায়। সাম্প্রতিক সময়ে তরমুজের দাম নিয়ে কৃষকদের ঠকার চিত্র সবার সামনে।

মাঠের কৃষকদের থেকে তরমুজ পিস হিসেবে কিনে বাজারে ক্রেতাদের কাছে কেজি দরে বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে। অসাধু ব্যবসায়ীরা তরমুজ ক্ষেতে গিয়ে কৃষকদের কাছ থেকে পিস হিসেবে কিনছেন। তরমুজ চাষি এবং বাজাররের ক্রেতাদের মধ্যে বড় যোগাযোগ না থাকার সুবিধা নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরদের সিন্ডিকেট এই কাজ করছে। ব্যবসায়ীদের অতি লাভের মানসিকতা থেকে এটা হচ্ছে। দাবি ওঠানোটা স্বাভাবিক। পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেওয়াটাই আধুনিক বাজার ব্যবস্থাপনার ধারণার মধ্যে পড়ে। মূলত ভুঁইফোড়দের দৌরাত্ম্য এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের যোগসাজশই কৃষকের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ার প্রধান কারণ। এতে ক্রেতা যেমন ঠকছেন, তেমনি উৎপাদনকারী কৃষকও ঠকছেন।

ফলে কৃষক এবং ক্রেতার মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করা না হলে এই বাজার ব্যবস্থায় চলমান সিন্ডিকেট দমন সম্ভব নয়। কৃষিপণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রেও কৃষকদের নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। কৃষক তার উৎপাদিত পণ্য স্থানীয় বাজারে বিক্রির পরিবর্তে বাইরের বাজারে নিতে গেলে পরিবহনের ভাড়া নিয়ে অসুবিধা হয়।

একজন কৃষক ক্ষেত থেকে ৫০ কেজি বেগুন তুলে স্থানীয় বাজারে নিয়ে যান। সেটা শহরের বাজারে নিয়ে গেলে দ্বিগুণ দাম পাবেন জেনেও সেটা স্থানীয় বাজারে বিক্রি করতে বাধ্য হন তিনি।

কারণ কম পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে বেশি ভাড়া দিতে হয়। এক্ষেত্রে সিন্ডিকেটের কাছে বিক্রি ছাড়া কোনো উপায় থাকে না কৃষকদের। আবার কৃষিপণ্য সংরক্ষণের সু-ব্যবস্থা এখনো আমাদের দেশে পর্যাপ্ত নয়। কৃষকরা যে বাড়িতে বা অল্প কিছুদিন ফসল সংরক্ষণ করবে, তারও অজ্ঞতা রয়েছে। এজন্য সবজি, ফল, লতাজাতীয় ফসল, দানা শস্য, পেঁয়াজ ইত্যাদিসহ দ্রুত পচনশীল পণ্য উৎপাদন করে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন কৃষক।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত