ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আরসার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড

রোহিঙ্গা শিবিরে সক্রিয় ৪ শতাধিক সদস্য
আরসার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড

মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর নিপীড়ন ও অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে দেশটির বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। মিয়ানমারের সৈন্যরা রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়ে ওই স্থানে নানা স্থাপনা তৈরি করেছে। ফলে বাংলাদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গারা কখনো তাদের নিজ দেশে ফিরে গেলে তাদের বাড়িঘর হয়তো চিনতে পারবে না। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার হিসাব অনুসারে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর ৭ লাখ ৭৩ হাজার ৯৭২ জন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসে। তবে এর আগে থেকেই বাংলাদেশে অবস্থান করছিল আরো প্রায় ৪ লাখ রোহিঙ্গা। প্রতি বছর প্রায় ৩০ হাজার রোহিঙ্গা সন্তান জন্ম নেয়ায় বতমানে ১২ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বালাদেশে অবস্থান করছে। এসব রোহিঙ্গা স্বাভাবিক জীবনযাপন করলে কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু তারা কক্সবাজারে অবস্থান নেয়ার পর ওই এলাকায় সন্ত্রাসি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। তাদের অত্যচারে স্থানীয় মানুষ অতিষ্ঠ। সেই সঙ্গে আতঙ্কিত। খুনোখুনি, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায় এবং মুক্তিপণ না পেয়ে খুন করে মরদেহ গুম করতে পাহাড়ের গহিনে ফেলে আসার ঘটনায় কেবল এলাকাবাসী নয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও চিন্তিত। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে শিবিরগুলোতে পুলিশ-আনসারের পাশাপাশি র‌্যাবও তৎপর রয়েছে। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার আলাপ-আলোচনা চালিয়ে এলেও কার্যত কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। রোহিঙ্গা প্রত্যাবসনে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের বিভিন্ন সংস্থার সহায়তা কামনা করেও কোনো ফল পাওয়া যাচ্ছে না। বাংলাদেশে যেসব বিদেশি মিশন আসে তারা রোহিঙ্গা শিবিরগুলো পরিদর্শন করে। রোহিঙ্গা নেতাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে। রোহিঙ্গরা তাদের কাছে নিজ মাতৃভূমিতে ফিরে যাওয়ার আকুতি জানায়। মিয়ানমার থেকে কখনো কখনো প্রতিনিধি দল এসে রোহিঙ্গাদের তালিকা তৈরি করে তাদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য উদ্যোগ নিলেও কেন যেন তা ভেস্তে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক মহলের কাছে যখনই সুযোগ পাচ্ছে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে তাগিদ দিয়ে আসছে।

আন্তর্জাতিক সংগঠন বা রাষ্ট্রগুলো রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে সহমত প্রকাশ করলেও মিয়ানমার সরকারের আপসহীন মনোভাবের কারণে সেটি সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষ করে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি-আরসার তৎপরতায় মানুষের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা বেড়েছে। আরসার অপতৎপরতায় সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা কার্যত ভেঙে পড়েছে। রেহিঙ্গারা প্রথমে কক্সবাজারের বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে অবস্থান নিলেও তাদের একটি মুষ্টিমেয় অংশকে নোয়াখালীর ভাসানচরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে তারা স্বাভাবিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে অবস্থান করা রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের চেয়ে তুলনামূলক শান্তিতে বসবাস করায় তাদের মধ্যে কেউ কেউ মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাচ্ছে না। আবার কেউ কেউ মিয়ানমারে ফিরে যেতে ব্যাকুল। এই প্রেক্ষাপটে তাদের মধ্যে দুটি গ্রুপ তৈরির পাশাপাশি গড়ে উঠেছে সন্ত্রাসী সংগঠন আরসা। কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে ৪০০ থেকে ৪৫০ সন্ত্রাসী সক্রিয় রয়েছে। তারা ক্যাম্পের গহিন পাহাড়ে গোপন আস্তানা তৈরি করে হত্যা, অপহরণ, চাঁদাবাজি, গুমসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ড সংঘটিত করে আসছে। টেকনাফের গহিন পাহাড়ে গোপন আস্তানা থেকে শুক্রবার রাতে র‌্যাবের হাতে আটক সংগঠনটির সামরিক কমান্ডার হাফেজ নুর মোহাম্মদসহ আরসার ছয় শীর্ষ সন্ত্রাসীর কাছ থেকে জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এসেছে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য।

মিয়ানমারে তারা কে কী করত, কে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিত, কে বোমা বানাত এবং বাংলাদেশে এসে তারা কীভাবে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে এবং কে কোন দায়িত্বে ছিল, তারা নিজেরাই র‌্যাবের কাছে এসব তথ্য জানিয়েছে। হাফেজ নূর মোহাম্মদ উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরের অন্যতম সামরিক কমান্ডার হিসেবে আরসার নেতৃত্ব দিয়ে আসছিল। তার নেতৃত্বে আরসার ৩০-৩৫ জন সদস্য ওই ক্যাম্প ও আশপাশের এলাকায় খুন, অপহরণ, ডাকাতি, মাদক, চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তারসহ বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত। এমনকি তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য তারা পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে দুর্গম সীমান্তবর্তী অঞ্চল দিয়ে অস্ত্র চোরাচালান করত। হাফেজ নূর তার দলের সদস্যদের মাধ্যমে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে খুন, অপহরণ ও গুমের ভয় দেখিয়ে চাঁদা দাবি করত। চাঁদার অর্থ না পেলে ভিকটিমকে অপহরণ করে শারীরিক ও পাশবিক নির্যাতন এবং মুক্তিপণ দাবি করত। মুক্তিপণ না পেলে তারা ভিকটিমকে খুন করে গহিন পাহাড়ে অথবা জঙ্গলে লাশ গুম করে ফেলত। সম্প্রতি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আলোচিত ছয়জনের হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত ছিল হাফেজ নূর। অপহরণ ও টার্গেট কিলিং শেষে কক্সবাজারের গহিন পার্বত্য এলাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় আত্মগোপনে চলে যেত। আরসা সদস্যরা অস্ত্র চালনা, কুংফু ও রণকৌশলে পারদর্শী। তাই অবিলম্বে কম্বিং অপাশেন চালিয়ে তাদের নির্মূল করা না গেলে ওই অঞ্চলের মানুষের শান্তিপূর্ণ বসবাস ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত