চলচ্চিত্রের চালচিত্র

৩০০ আসনে ৩০০ সিনেপ্লেক্স এখন সময়ের দাবি

হাবিবুল ইসলাম হাবিব, নির্মাতা ও প্রযোজক

প্রকাশ : ২৫ জুলাই ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সিনেমার হলেল সবচেয়ে বড় দুঃসময় চলছে, সিনেমা বা চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িত সবাই এটা স্বীকার করবেন। যেখানে নব্বই দশকের শুরুতে বাংলাদেশে সিনেমা হলের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৪৩৫টি; দুই দশকে কমতে কমতে সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে একশ’র কাছাকাছি (মাঝে মধ্যে নানান উৎসব উপলক্ষে হাটে বাজারে, কালেভদ্রে ৪০-৫০টি ভাঙাচোরা অস্বাস্থ্যসম্মত সিনেমা হল যুক্ত হয়ে থাকে)। গত দুই দশকে বাংলাদেশের কোথাও নতুন সিনেমা হল নির্মাণ হয়নি। সিনেমা হলই যদি না থাকে তাহলে দর্শকরা সিনেমা দেখবে কোথায়। হাটে মাঠে ময়দানে নিশ্চয় সিনেমা দেখানো হবে না। সিনেমা বা চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়নে বাণিজ্যিক দৃষ্টিতে সিনেমা হলের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তা নিয়েই আলোচনা। ১৮৯৫ সালে লুমিয়ের ব্রাদার্স সর্বপ্রথম সিনেমা ধারণাটিকে দর্শকদের সামনে নিয়ে আসেন। সিনেমার সূচনার সেই তারিখটি ছিল ২৮ ডিসেম্বর। এই ঘটনার পরপরই মাত্র এক দশকের মধ্যেই সিনেমা তার অভিনবত্ব কাটিয়ে উঠে এক বিশাল সর্বজনীন বিনোদন শিল্পে পরিণত হয়। নির্বাক থেকে সবাক, সাদা কালো থেকে রঙিন সিনেমা- পাড়ি দিয়েছে অনেকটা পথ। সিনেমার এই পথচলায় অবিভক্ত ইংরেজ শাসিত ভারতও খুব একটা পিছিয়ে থাকেনি। সিনেমার যাত্রা শুরুর পরের বছর ভারতের দর্শকরা সিনেমার সঙ্গে পরিচিতি লাভ করে। ১৮৯৬ সালে তৎকালীন বোম্বে শহরের ওয়াটসন হোটেলের বিরাট হলঘরে লুমিয়ের ভাইদের সিনেমা ‘দ্য অ্যারাইভাল অব আ ট্রেন অ্যাট দ্য স্টেশন’ প্রদর্শিত হয়। অবশ্য দর্শকদের অধিকাংশ ছিলেন শাসক ইংরেজ কর্তা আর মুষ্টিমেয় অভিজাত ভারতীয়। ১৮৯৮ সালে কলকাতা পা রাখে সিনেমা দর্শনে। জে স্টিভেনসন এক ইংরেজ স্টার থিয়েটারে প্রদর্শিত করেন নির্বাক সিনেমা। এর পর সারা বিশ্বের এগিয়ে থাকা দেশগুলো নেমে পড়ে সিনেমা নির্মাণে।

অবশ্য এর পেছনে প্রেরণা হিসেবে ছিল বাণিজ্যিক মুনাফা অর্জন। বিশাল দর্শককে মুগ্ধ হয়ে এই অভিনবত্ব ভোগ করার আগ্রহ সিনেমাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। পরাধীন ভারতবাসী এই নতুন প্রযুক্তিকে আত্মস্থ করতে লেগে পড়ে। ঢাকার সন্তান হীরালাল সেন ভাই মতিলাল সেনকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেন রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানি। এই কোম্পানি তখনকার মঞ্চায়িত নাটকের দৃশ্য, নানা রকম ঘটনাবলি ইত্যাদি নিয়ে প্রায় চল্লিশটির মতো সিনেমা তৈরি করে ফেলে। যদিও তিনি ভারতে প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা তৈরির কৃতিত্ব পাননি। ১৯০৩ সালে তাদের কাহিনিভিত্তিক সিনেমা ‘আলিবাবা অ্যান্ড ফর্টি থিভস’ দর্শকদের মনোরঞ্জনে প্রদর্শিত হয়। তার আগে ১৮৯৯ সালে বোম্বেতে সখারাম ভাতওয়াদেকর নামের এক ভারতীয় স্বল্পদৈর্ঘ্যরে দুটি ছবি ‘দ্য রেসলারস’ ও ‘ম্যান অ্যান্ড মাংকি’ নির্মাণ করেন। সিনেমা বলতে যে ধারণাটি প্রতিষ্ঠিত, সে ধারণায় প্রথম নির্বাক সিনেমা তৈরি হয় ধুনধীরাজ গোবিন্দ ফালকের পরিচালনায় ‘রাজা হরিশ্চন্দ্র’। ছবিটির দৈর্ঘ্য ছিল ৩ হাজার ৭০০ ফিট। ১৯১৩ সালে এর মধ্য দিয়ে ভারতীয় সিনেমা শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। বোম্বের পর কলকাতায় সিনেমা তৈরি শুরু হয় ১৯১৭ সালে। প্রথম বাংলা নের্বাক সিনেমা ‘সত্যবাদী রাজা হরিশ্চন্দ্র’। সিনেমাটি নির্মাণে এগিয়ে এসেছিল প্রদর্শক ম্যাডানের এলফিনস্টন বায়োস্কোপ কোম্পানি। ওদিকে ভারতে পাঞ্জাবের কেন্দ্র লাহোরে গড়ে ওঠে আরেকটি সিনেমা কেন্দ্র। আব্দুর রশিদ কারদার ১৯৩০ সালে নির্মাণ করেন নির্বাক ছবি ‘হুসনে কি ডাকু’। তিনটি কেন্দ্র- বোম্বে যাকে বলা হয় বলিউড, কলকাতা যাকে টালিউড নামেই সবাই চেনে, আর লাহোরকেন্দ্রিক সিনেমাকে বলা হতো ললিউড। ততদিনে ভারতীয় জনগণের এক বিনোদনের জায়গা নিয়ে নিয়েছে সিনেমা। সারা ভারতেই তৈরি হতে লাগল একের পর এক সিনেমা হল। তৎকালীন পূর্ব বাংলা সিনেমার কেন্দ্র হিসেবে যাত্রা শুরু না করলেও সিনেমা হল নির্মাণে পিছিয়ে থাকেনি। বোম্বে, কলকাতা, লাহোর ও বিশেষ হলে বিদেশি ইংরেজি সিনেমাই দেখানো হতে লাগল।

১৮৯৮ সালে পাটুয়াটুলী এলাকায় ক্রাউন থিয়েটারে প্রথম সিনেমা প্রদর্শিত হয়। প্রথাগত সিনেমা হল নির্মিত হয় ১৯১৫ সালে। তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোল চলছে। লেজার নামের এক ইংরেজ নবাব ইউসুফ খান থেকে জায়গা কিনে আরমানিটোলায় সিনেমা হলটি তৈরি করেন, নাম দেন পিকচার হাউস। লেজার সেটি পরে বিক্রি করে দেন উদ্ভবজী ঠাকুর নামের এক মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীর কাছে। পিকচার হাউস অনেকটা পরে নাম বদলে হয় শাবিস্তান। একুশ শতকের শুরুতেই হলটি বন্ধ হয়ে যায়। সারা দেশে ব্যবসাটির প্রসার ঘটে, দেশব্যাপী গড়ে ওঠে একের পর এক সিনেমা হল। দেশ ভাগ হয়ে আমরা যখন পূর্ব পাকিস্তান, তখন আমাদের নিজেদের সিনেমা বানানোর ভাবনা এলো অনেকের মাথায়। কল্পনাকে বাস্তব করতে এগিয়ে এলেন আব্দুল জব্বার খান। ফরিদপুরে সংঘটিত এক ডাকাতির কাহিনি নিয়ে তিনি নেমে পড়লেন এই বাংলার প্রথম সিনেমা বানাতে। ১৯৫৩ সালে শুরু করে ১৯৫৬ সালে মুক্তি পেল এই বাংলার প্রথম সিনেমা ‘মুখ ও মুখোশ’। সিনেমাটি দর্শকদের মধ্যে বিপুল আগ্রহ সৃষ্টি করেছিল। চৌষট্টি হাজার রুপি ব্যয় হয়েছিল সিনেমাটি নির্মাণে। প্রথম দফাতেই ছবিটি আয় করে ৪৮ হাজার রুপি। সিনেমা আর থেমে থাকেনি এই বাংলায়। পঁয়ষট্টির যুদ্ধের পর ভারতীয় সিনেমা নিষিদ্ধ হলে লাহোর করাচির সিনেমার সঙ্গে সমান তালে পাল্লা দিয়ে এগিয়েছে এই বাংলার সিনেমা। আজ সেই সিনেমার কী দুর্দশা। বাংলাদেশের বহু জেলায় এই সময়ে কোনো সিনেমা হল নেই। ভাবা যায়! পর্যটন নগরী কক্সবাজারে বিনোদনের জন্য তেমন কোনো সিনেমা হল নেই। আগে এই শহরে দুটি সিনেমা হল ছিল। পর্যটনের অপর শহর রাঙামাটির অবস্থাও তাই। আগে এই শহরে তিনটি সিনেমা হল ছিল। ঢাকার পাশে নরসিংদী শহরে ছিল তিনটি সিনেমা হল, এখন একটিও চালু নেই। একই অবস্থা ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরেও, সেখানে তিনটি সিনেমা হলের সব ক’টিই বন্ধ। সিনেমা হল নেই নড়াইল, ঝালকাঠি, পঞ্চগড়, মুন্সীগঞ্জ জেলা শহরেও। একের পর এক বন্ধ হয়ে সেখানে গড়ে উঠছে বহুতল ভবন মার্কেট। এজন্যই চলচ্চিত্র শিল্পকে বাঁচাতে নতুন ভাবনায় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। বলা হয় মানসম্পন্ন সিনেমা না থাকাতে সিনেমা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে দর্শকরা, তাই এই ধস। মানসম্পন্ন সিনেমা তৈরি হওয়ার সুযোগই তো কমে গেছে। সিনেমা হল নেই, যাও আছে তারও সংস্কার নেই। প্রথাগত সিনেমা হলের সংজ্ঞা বদলে গেছে, সিনেমা দেখার প্রচলিত ধারণাও বদলে গিয়ে আজ অন্য রূপ নিয়েছে। সিনেমা দেখা, কেনাকাটা, খাওয়া দাওয়া ইত্যাদি মিলিয়ে প্যাকেজ বিনোদনের সময় এখন। সেজন্যই সিনেপ্লেক্স গড়ে তুলতে সচেষ্ট হতে হবে। দর্শকদের ফিরিয়ে আনতে হবে সিনেমা দেখার জন্য।

নব্বই দশক পর্যন্ত সিনেমা দেখাটা ছিল পারিবারিক বিনোদনের অন্যতম উৎস। অবস্থাটা বদলে যেতে থাকে আকাশ সংস্কৃতির উদ্ভব হওয়ায়। এর আগে টেলিভিশনে চ্যানেল বলতে একটিই ছিল। সেটি ছিল বিটিভি। আকাশ সংস্কৃতি নাগরিক জীবনে বহু চ্যানেল দেখার জানালা খুলে দিল, তাও দিবস ও রজনী চব্বিশ ঘণ্টা। তার মধ্যে আবার বিদেশি চ্যানেল। নিষিদ্ধ বস্তুর আকর্ষণের মতো সনাতন ধারা নাগরিকদের হুমড়ি খেয়ে পড়তে দেখা গেল টেলিভিশন পর্দায়। তাতে আরও জোগান দিল বাংলা সিনেমার অধোগতি। সে সময় বহু নির্মাতাকে বলতে দেখা গেছে তাদের নির্মিত সিনেমা নিম্নবিত্তরা দেখলেই তারা টিকে যাবে। সেজন্যই হয়তো অশ্লীলতা গ্রাস করতে লাগল বাংলা সিনেমাকে। মেধা ও মননের চর্চার এই পতন মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করলো বিপুল সংখ্যার মধ্যবিত্তকে। তারা বিনোদনের উৎস হিসেবে আঁকড়ে ধরল চারদেয়ালি বিনোদনের বাহন টিভিকে। দর্শক কমতে থাকায় লোকসানের বোঝা টানতে টানতে প্রথাগত সিনেমা হলগুলোর ঝাঁপ বন্ধ হতে লাগল। যারা নিভু নিভু হলেও টিকে থাকল, তারা সংস্কার দর্শকদের সুবিধার কথা বিবেচনায় নিতে পারল না। সিনেমা দেখার পরিবেশ পৌঁছাল তলানিতে।

তাহলে কি আকাশ সংস্কৃতির বিকাশ সিনেমার এই দুর্দশার জন্য দায়ী? এই প্রশ্নে বিতর্ক চলতে পারে, অনেকেই এই প্রশ্নে সমর্থন জানাতে পারে। তবে বিশ্ব প্রেক্ষাপটে বিচার করা হলে দেখা যাবে আকাশ সংস্কৃতির বিকাশ সিনেমাকে হটাতে পারেনি বরং আকাশ সংস্কৃতি সহায়ক হয়েছে সিনেমার বাণিজ্যিক বিকাশে। প্রতিবেশী দেশ ভারতে দৃষ্টি ফেললে দেখতে পাব, সেখানে জাতীয় তথা বলিউডি সিনেমার রমরমা অবস্থা। এমনকি আঞ্চলিক সিনেমাও পুঁজি ফেরত পেয়ে মুনাফা করছে। সেদেশে সিনেমার হিট বিচার হচ্ছে প্রথম সপ্তাহে সেল শতকোটির বিচারে। সে দেশে আকাশ সংস্কৃতির বিকাশে রয়েছে তিনটি মাধ্যম। ক্যাবল টিভি, ডিটিএইচ ও আইপি টিভি। রয়েছে আঞ্চলিক, জাতীয়, আন্তর্জাতিক মিলিয়ে সহস্র টিভি চ্যানেল। সেখানে সিনেমার রমরমা বাজার। এর প্রধান কারণ সেদেশে সিনেপ্লেক্সের বিস্তার ঘটেছে জনমানসের মানসিকতাকে লালন করে। সে দেশেও প্রথাগত সিনেমা হল বন্ধ হচ্ছে, এর মধ্যে ঐতিহ্যধারী বহু সিনেমা হলও রয়েছে। সিনেমার নির্মাণ কৌশল, বিষয়ও বদলেছে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে।

লস্ট ফাউন্ড, অ্যাকশন আর মধুর মিলন- এই ফর্মুলা সিনেমা এখন হয় না। সেখানে বায়োপিক এমনকি মঙ্গল অভিযান নিয়ে সিনেমার বিষয় হয়। সেগুলো দর্শকদের আনুকূল্যও লাভ করে। আমরাও এখানে প্রথার বাইরে গিয়ে টানটান চিত্রনাট্যে সিনেমা নির্মাণ করি; কিন্তু দর্শকরা দেখবে কোথায়। বহু জেলা শহরে সিনেমা হলের অস্তিত্বই নেই। যা ক’টি আছে সেসব হলে না আছে আরামদায়ক আসন ব্যবস্থা, না আছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ, না আছে আধুনিক শব্দ ব্যবস্থা, পরিবেশ তো কহতব্য নয়। মানসম্পন্ন সিনেমা তৈরি হবে কী করে। কোনো প্রযোজক লোকসান দেওয়ার জন্য অর্থ লগ্নি করবেন না, এ কারণেই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ধারণা বদলাতে হবে। জেলায়, উপজেলায় গড়ে তুলতে হবে সিনেপ্লেক্স। তাহলেই বাঁচবে বাংলা সিনেমা, তৈরি হবে মানসম্পন্ন দর্শক। বিনিয়োগ ফেরত পাওয়ার গ্যারান্টি এই ধারণার সঙ্গে জড়িত। সিনেপ্লেক্স বিষয়টি কী? এবার আলো ফেলা যাক সিনেপ্লেক্স ধারণাটির দিকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সিনেমা দেখার রুচি ও ধ্যান-ধারণার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। শুধু সিনেমা দেখার জন্যই দলবেঁধে যাওয়া এরকমটা আজকাল হয় না। সিনেমা দেখার সঙ্গে শপিং করা, খাওয়া দাওয়া জড়িয়ে আছে। ধরুন একটি পরিবার হয়তো চারজনের, তাদের সঙ্গে একই ছাদের তলায় বসবাস না হলেও কাজিনদের যোগাযোগ তো আছেই। তারা সবাই এক হয়ে লম্বা সময় কাটাবে।