দেশের রপ্তানি আয় বৃদ্ধি করতে রপ্তানিপণ্যগুলোর উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিপণন ব্যবস্থা সুসংহত করা প্রয়োজন। কারণ রপ্তানি আয়ের ওপরই দেশের টেকসই অর্থনীতি নির্ভর করে। আমদানিনির্ভরতা দেশের অর্থনীতিতে যে চাপ সৃষ্টি করে সেটা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ভালোভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের মধ্যে প্রথমেই রয়েছে তৈরি পোশাক শিল্প। আর দ্বিতীয় শীর্ষ রপ্তানি পণ্য হলো চামড়া। তথ্যে জানা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রায় ১২৪ কোটি ৫২ লাখ মার্কিন ডলারের চামড়া ও চামড়া থেকে তৈরি পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এর মধ্যে শুধু চামড়া রপ্তানি হয়েছে প্রায় ১৫ কোটি ১৪ লাখ ডলারের। চলতি অর্থবছরে ১৪৪ কোটি ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানির লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার। সারা বিশ্বেই চামড়া ও চামড়াজাত শিল্পের চাহিদা রয়েছে। চামড়ার জুতা, ব্যাগসহ যাবতীয় সামগ্রী বিশ্বব্যাপী ক্রেতাদের কাছে খুব আকর্ষণীয়। চামড়া শিল্প কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বড় বড় কোম্পানি। আমাদের দেশে সারা বছর তো বটেই কোরবানির ঈদের সময় আরও বেশি চামড়া সংগৃহীত হয়। বিশ্বে চামড়া শিল্পে প্রতিযোগিতাও লক্ষ্যণীয়। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের বড় ভূমিকা এবং সম্ভাবনা রয়েছে। রপ্তানি পণ্য হিসেবে চামড়ার সুনামও রয়েছে। কোনো রপ্তানি পণ্যে বাজার তৈরি এবং তা ধরে রাখা একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয়। ক্রমাগত সেই খাতের উন্নয়নের মাধ্যমে এবং গুণগত মানের ধারাবাহিকতা রক্ষার মাধ্যমে সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। কারণ প্রতিটি খাত যেমন- পাট, চা বা পোশাক শিল্পে যেমন বহু মানুষের কর্মসংস্থান এবং অর্থনৈতিক বিষয় জড়িত থাকে, চামড়া শিল্পেও চামড়া সংগ্রহের প্রান্তিক পর্যায় থেকে সবাই অনেকেই জড়িত থাকে। প্রতি বছরই কোরবানির ঈদের আগে ও পরে চামড়ার দরপতন বা দাম নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। দেখা যায়, প্রান্তিক ব্যবসায়ীরা ন্যায্য দাম পায় না। চামড়া বিক্রিতে ন্যায্য দাম না পাওয়া বা দাম না পেয়ে চামড়া পুঁতে ফেলা বা ফেলে দেয়ার ঘটনাও ঘটে। তারপর কীভাবে চামড়ার ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা যায় তা হয় আলোচনার বিষয়। গত বছরের সেই চামড়া শিল্পে বাজে অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার পর বেশ কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল।
প্রকৃতপক্ষে অন্যান্য শিল্পের মতোই চামড়া শিল্পকে একটি অগ্রাধিকারযোগ্য শিল্প হিসেবে দেখতে হবে এবং প্রান্তিক পর্যায় থেকে ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ থেকে পাকা চামড়ার পাশাপাশি এখন জুতা, ট্রাভেল ব্যাগ, বেল্ট, ওয়ালেট বা মানিব্যাগ বিদেশে রপ্তানি হয়। এ সম্ভাবনাময় খাতকে আরও কাজে লাগিয়ে দেশকে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে নেয়া সম্ভব। তবে গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, মূলত এখন যে সমস্যাটি চামড়া শিল্পকে বাধাগ্রস্ত করছে সেটি হলো এলডব্লিউজি সনদ। কারণ ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্বের বড় ব্র্যান্ডগুলোর কাছে ভালো দামে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য বিক্রি করতে হলে এলডব্লিউজি সনদ জরুরি। সেই সনদ আছে বাংলাদেশের মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠানের। ২০০৫ সালে নাইকি, অ্যাডিডাস, টিম্বারল্যান্ডের মতো কয়েকটি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড ও জুতা উৎপাদনকারী মিলে লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ বা এলডব্লিউজি গঠন করে। সংস্থাটির লক্ষ্য হলো পরিবেশগত সুরক্ষা নিশ্চিত করে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য উৎপাদন করার বিষয়টি নিশ্চিত করা। এই সনদ চামড়াজাত পণ্যের ভালো দাম পেতে সহায়তা করে। এ ছাড়া পরিবেশ সুরক্ষায়ও ভূমিকা রয়েছে। এছাড়া বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি ও পরিস্থিতি কিছুটা প্রতিকূলে থাকায় মাঝখানে এ শিল্প বিকাশ একটু বাধাগ্রস্ত হলেও সে পরিবেশ ক্রমেই কাটিয়ে উঠছে।
একটি শিল্পকে বাঁচাতে হলে সেই শিল্পের সম্ভাবনা যাচাই পূর্বক সমস্যার একেবারে গোড়া থেকে শুরু করা প্রয়োজন। রিভাইজ করা প্রয়োজন। কেন সমস্যা বারবার সৃষ্টি হচ্ছে, কার জন্য হচ্ছে বা কীভাবে হচ্ছে, সম্ভাবনাকে কেন কাজে লাগানো যাচ্ছে না ইত্যাদি বিষয় সমাধান করা দরকার। চামড়ার দাম না পাওয়া চামড়া শিল্পের ভবিষ্যতকেও দুর্বল করে দেবে। অথচ মাত্র এক দশক আগেও চামড়ার এ অবস্থা ছিল না। যে গরুর চামড়া সে সময় বিক্রি হতো দুই থেকে আড়াই হাজারে সেই চামড়া এখন বিক্রি হয় এক থেকে দেড়শ’ টাকায়। কোথাও কোথাও তা আরও একটু বেশি বিক্রি হয়েছে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত দাম পায়নি। কেন প্রতি বছরই এরকম পরিস্থিতির তৈরি হয় সেটা খুঁজে বের করতে হবে। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের সঙ্গে দেশের অর্থনীতি ও কর্মসংস্থান জড়িত। চামড়া খাত ঘুরে দাড়াতে হলে চামড়া সংগ্রহ থেকে রপ্তানি পর্যন্ত শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। বিশ্ব চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে গুরুত্ব দিচ্ছে। বিশেষত যে দেশগুলোকে আমরা প্রতিযোগী মনে করছি তারা। আমাদেরও তাদের সঙ্গে সমানতালে এগিয়ে যেতে হবে। কারণ সামনের বছরগুলোতে বিশ্বব্যাপী চামড়ার বিশাল বাজার তৈরি হবে। বাংলাদেশের চামড়ার মান উন্নতমানের। বিদেশে ব্যাপক চাহিদাও রয়েছে। বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য মতে, বর্তমানে দেশ থেকে লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ বা এলডব্লিউজি সনদবিহীন কারখানায় প্রক্রিয়াজাত প্রতিটি চামড়া ন্যূনতম ৪৫ সেন্ট থেকে শুরু করে ১ দশমিক ৮০ ডলারে রপ্তানি হচ্ছে। তবে এলডব্লিউজি সনদধারী কারখানার ক্ষেত্রে এই দাম দ্বিগুণের বেশি। এই খাত থেকে আরও বেশি আয়ের লক্ষ্য রয়েছে বর্তমান সরকারের। সে লক্ষ্যে দ্রুত অগ্রসর হতে হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে বার্ষিক রপ্তানি আয় এক বিলিয়ন থেকে বাড়িয়ে ১০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার চেষ্টা করছে সরকার।
করোনা কারণে কয়েক বছর চামড়া রপ্তানিতে আমরা গত কয়েক বছর খুব বেশি সুবিধা করতে না পারলেও এখন চামড়া খাত ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। কিন্তু এ খাতে বিদ্যমান সমস্যাগুলো সমাধান করতে হবে। গণমাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি ছিল ১২৩ কোটি ডলারের বেশি। ২০১৭-১৮ সালের অর্থবছরে তা কমে এসে দাড়ায় ১০৮ কোটি ডলারে। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ১০২ কোটি এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা ৮০ কোটি ডলারে নেমে আসে। ২০২০-২১ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্যের রপ্তানি বেড়ে দাঁড়ায় ৯৪১.৬ মিলিয়ন ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে এই খাতে বেশি অগ্রগতি হয়। এ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের মোট রপ্তানি ছিল ১.২৫ বিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছরেও চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি ঊর্ধ্বমুখী বলে জানা গেছে। অর্থাৎ চামড়ার একটি সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ রয়েছে। পবিত্র ঈদুল আজহার আগে এই বাজার আরও চাঙ্গা হয়ে ওঠে। দেশের প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। করোনা মহামারীর ভেতর অন্য সব খাতের সাথে চামড়া খাতও সংকটে পরে। সরকারি হিসেবে কোরবানিতে প্রায় কোটি গরু জবাই করা হয়। এই সময় লাখ লাখ মৌসুমি ব্যবসায়ী থাকেন চামড়া কেনার জন্য। এদের হাত ধরেই চামড়া পৌঁছে যায় চামড়া ব্যবসায়ীদের হাতে। চামড়া ব্যবসায়ে এসব মৌসুমি ব্যবসায়ীও এখন উৎসাহ হারাতে শুরু করেছে। আমাদের দেশে পাট, চা, তৈরি পোশাক এসব শিল্প দেশের অর্থনীতিকে সুসংহত করতে এবং অর্থনীতি এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিশ্বব্যাপী চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি ও মূল্য বৃদ্ধি পেলেও আমাদের দেশে চামড়া নিয়ে প্রতি বছর এই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি কেন ঘটছে? আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ যদি পারে তাহলে আমরাও পারব চামড়ার আন্তর্জাতিক বাজারে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে যেভাবে পোশাক শিল্পে আমাদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে পেরেছি। এই শিল্প এগিয়ে নিয়ে গেলে দেশের অর্থনীতিতেও গতি সঞ্চার হবে। চামড়ার ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করার পাশাপাশি অবশ্যই বিদ্যমান সমস্যাগুলোতে মনোযোগ দেওয়া আবশ্যক।