শিক্ষকদের অননুমোদিত অনুপস্থিতি

প্রশিক্ষিত জাতি গঠনের অন্তরায়

প্রকাশ : ২৫ জুলাই ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

দেশের ১৬টি জেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাৎক্ষণিক পরিদর্শন করে ৩৪ জন শিক্ষককে অননুমোদিতভাবে অনুপস্থিত পাওয়া গেছে। ডিজিটাল মনিটরিংয়ের মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের তাৎক্ষণিক পরিদর্শনে এই অনিয়ম ধরা পড়ে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মনিটরিং অ্যান্ড ইভাল্যুয়েশন উইংয়ের গত জুন মাসের প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। এই প্রতিবেদনের আলোকে গত রোববার মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর অনুপস্থিত শিক্ষকদের কারণ দর্শোনো নোটিশ দিয়েছে। নোটিশে পরবর্তী ৫ কর্মদিসের মধ্যে নিজ নিজ জেলা শিক্ষা অফিসারের কাছে উপস্থিত হয়ে শিক্ষকদের অনুপস্থিতির সুস্পষ্ট কারণ জানাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর আগে গত ৬ জুলাইয়ের অফিস আদেশে দেশের ১৫ জেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৩৫ জন শিক্ষক-কর্মচারীর অনুপস্থিতি ধরা পড়ে। তাদেরও কারণ দর্শাতে নোটিশ করা হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এ জন্য ধন্যাবাদ।

মানুষ প্রত্যাশা করে, জনগণের করের টাকায় বেতনভুক্ত শিক্ষকদের এভাবে কাজে ফাঁকি দিয়ে মহান পেশা শিক্ষকতা চালিয়ে যাওয়া অনুচিত। অভিযোগ রয়েছে এমনিতে ক্লাসে শিক্ষকরা মনোযোগী নন এবং সেইসঙ্গে যদি হন অনুপস্থিতি। তাহলে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা সহজেই অনুমেয়। আমাদের সমাজে একটা অভিযোগ রয়েছে যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা সাধারণত ক্লাসমুখী হন না। কারণে-অকারণে ক্লাসে অনুপস্থিতি শিক্ষকদের কাছে হয়তো কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বলে মনে হয় না। এটা জাতির জন্য অশনিসংকেত। আবার কোনো কোনো শিক্ষক ক্লাসে যাওয়ার আগে কী পড়াবেন তার ওপর বিষয়ভিত্তিক কোনো পড়াশোনা না করে পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি শিক্ষার্থীদের জ্ঞানদান করতে থাকেন। আবার অনেক শিক্ষক রয়েছেন, তারা তার নিজের ব্যক্তিগত জীবনযাপন কিংবা পরিবারিক সম্পর্কিত আলাপ-আলোচনা করেই ক্লাসের অধিকাংশ সময় ব্যয় করেন। কোনো কোনো শিক্ষক আছেন বিজ্ঞান পড়াতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা সকালে কী নাস্তা করেছে সেই আলাপ জুড়ে দেন।

রোল কল করার পর যতটুকু সময় একজন শিক্ষক পান সে সময়টুকু যদি তিনি শিক্ষাদানে ব্যয় করতেন, তা হলে শিক্ষার্থীরাও ক্লাস করতে আগ্রহী হতো। শিক্ষার্থীরা ক্লাসের পড়ায় সন্তুষ্ট হতে না পেরে কোচিংয়ের ওপর নির্ভশীল হয়ে পড়ছে। বিষয়ভিত্তিক পড়াশোনা না করে বই দেখে কিংবা নোট নিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়ালে তারা তা গ্রহণ করবে না। রোল কল শেষে তারা ক্লাস ছেড়ে অন্যত্র গিয়ে মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। ক্লাসকে শিক্ষার্থীদের কাছ প্রাণবন্ত করার দায়িত্ব শিক্ষকের। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, মেধাবীরা স্কুল-কলেজ পর্যায়ের শিক্ষকতা পেশায় আসতে চান না। কেননা, এই পেশায় আর্থিক সচ্ছলতা নেই। সংসার পরিচালনা করতে গিয়ে সংগত কারণেই শিক্ষকরা যেহেতু ক্লাসের আগে-পরে প্রাইভেট পড়ান, সে কারণে তাদের মনোযোগ থাকে প্রাইভেট পড়ানোর দিকে। কোচিংয়ে না পড়ে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়তে শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করা হয়। নেপথ্যে থাকে বেশি নম্বর দেয়ার প্রতিশ্রুতি। শিক্ষার্থীদের একটা ধারণা, সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট না পড়লে পরীক্ষায় বেশি নম্বর পাওয়া যায় না। ক্লাস শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট না পড়লে কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনে বিপর্যয় নেমে আসে। যেসব শিক্ষার্থী কোচিংয়ে পড়ে তারাও যে খুব ভালো শিক্ষাদান পদ্ধতির মধ্যে থাকে, তাও কিন্তু নয়।

কোচিংয়ের শিক্ষকরা মূলত বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র। তাদেরও ক্লাস ও পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়। তাদেরও ব্যস্ততা থাকে। তারাও কারণে-অকারণে কোচিংয়ে পড়াতে আসেন না। এলেও শিক্ষার্থীদের বিষয়ভিত্তিক শিক্ষাদান করতে তাদের মধ্যে আগ্রহ কম বলেই অভিযোগ পাওয়া যায়। রাজধানীর অনেক নামিদামি কোচিং সেন্টারের শিক্ষকরা নিজেদের ‘শিক্ষক’ মনে করে সেইভাবে আচরণ করেন। এক ঘণ্টার একটা ক্লাস সেটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হোক কিংবা কোচিং সেন্টারেই হোক, সেটাকে পাঠদানের উপযোগী করা একজন শিক্ষকের নৈতিক দায়িত্ব। কোনো কোনো শিক্ষক রয়েছেন, তাদের ক্লাসে যোগ দিতে শিক্ষার্থীরা ব্যাকুল থাকে। আবার অনেক শিক্ষার্থী রয়েছে, তারা শিক্ষকের শিক্ষাদান পদ্ধতি নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। তাই তারা ওইসব শিক্ষকের ক্লাস থাকলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপস্থিত হয় না। আর অভিভাবকদের চাপ ও নির্দিষ্ট দিন হাজির থাকার বাধ্যবাধকতা থাকায় যেসব শিক্ষার্থী ক্লাসে যায়, তারা চুপচাপ বসে থাকে কিংবা ঘুমিয়ে-ঝিমিয়ে সময় কাটিয়ে দেয়। সে কারণে শিক্ষাদান পদ্ধতি যদি শিক্ষাবান্ধব না হয়, তা হলে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে মনোযোগী হবে না। একটি প্রশিক্ষিত জাতি গড়ে উঠবে না। সে কারণে ক্লাসে উপস্থিতি ও মনোযোগী হওয়ার তাগিদ শিক্ষকদের নিজের মধ্যে থেকে না এলে শিক্ষার্থীদের জীবন অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যাবে।