বিশেষ নিবন্ধ শিক্ষা জাতীয়করণ বা জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা

অসিত কুমার মণ্ডল

প্রকাশ : ২৬ জুলাই ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

শিক্ষার মাপকাঠি নির্ধারণের যত শিক্ষাই থাক না কেন, বর্তমান যুগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর শিক্ষক ব্যতীত শিক্ষা অর্জনের বিকল্প আর কোনো মাধ্যম নেই বললেই চলে। সার্টিফিকেট বা সনদপত্র অর্জনের জন্য কোনো না কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দরোজায় হাজির হতেই হয়। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার এটাই সর্বশেষ রূপ বা চূড়ান্ত মাধ্যম বলা যায়। এ কারণে দেশের সর্বত্র দিনের পর দিন বিভিন্ন ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। সেখানে শিক্ষার্থীরা শিক্ষা গ্রহণ করছে। শিক্ষা গ্রণের পর উচ্চশিক্ষা বা উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের পর যারা শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত হচ্ছেন, তারা শিক্ষক। তাদের পারিশ্রমিক যেটা দেওয়া হয়, সেটাকে বলা হয় বেতন। দেশের প্রচলিত সার্ভিস রুলস অনুসারে এমপিও (মান্থলি পে-অর্ডার) ভুক্তির পর একজন শিক্ষক বেতন পান। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রতিটি সরকার ক্রমান্বয়ে শিক্ষকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করেছেন। সর্বশেষ বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শিক্ষকদের সর্বোচ্চ বেতন-ভাতা কয়েক দফায় দ্বিগুণ, তিন গুণ হারে বৃদ্ধি করেছেন। যেটিকে সম্মানজনক বলা যায়। শিক্ষকদের সাপ্তাহিক দু’দিন ছুটি কার্যকর করেছেন। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি স্কুল-কলেজে শিফট সিস্টেম চালুর কারণে শিক্ষকরা টানা আট ঘণ্টা ডিউটির স্থলে ৩-৫ ঘণ্টা কর্তব্য পালন করেন। অধিকাংশ শিক্ষক ব্যক্তিগত উদ্যোগে কোচিং সেন্টারের নামে স্কুলের আদলে শ্রেণিভিত্তিক রুটিন মাফিক ক্লাস চালু করেছেন। যেখানে দিন-রাত শিক্ষার্থী আর অভিভাবকদের আনাগোনা। বৈশাখী ভাতা, বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতাসহ কত সুযোগ-সুবিধা। অথচ আমাদের শিক্ষকদের তাতে মন ভরছে না। তারা শিক্ষা জাতীয়করণের নামে বেতন-ভাতা বৃদ্ধির আন্দোলন করছেন। জাতীয়করণটা কি? কাকে বলে? তার পরিকাঠামো বা অবকাঠামো কী হবে? এটা কোনো শিক্ষক সঠিকভাবে স্পষ্ট করে বলতে পারেন না। তারা আন্দোলনের মধ্যে বক্তব্যে শুধু তাদের অভাব-অভিযোগ আর সুযোগ-সুবিধার কথা বলছেন, পেটের ক্ষুধার কথা বলছেন, অভুক্তির কথা বলছেন। শিক্ষা জাতীয়করণ শুধু দেশের মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক বা উচ্চশিক্ষা স্তরের শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করা নয়। শিক্ষক-কর্মচারীরা তাদের পদ-পদবি অনুযায়ী এবং সরকারের নির্ধারিত বেতন কোটা অনুযায়ী বেতন-ভাতা পাবেন। এ সব বিষয় শিক্ষা জাতীয়করণ বা জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন বা প্রচলনের আওতায় পড়ে না। বেতন-ভাতা বৃদ্ধির বিষয়টি দেশের সরকারের অর্থনৈতিক ভিত্তি এবং ফান্ডের ওপরে নির্ভর করে। সরকার তার অর্থনৈতিক ক্ষমতা অনুযায়ী দেশের সার্ভিস রুলস অনুসারে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন স্কেল বৃদ্ধি করতে পারে। সেটা বর্তমান সরকার করেছে। বিগত সরকারের সময়ে একজন মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষকের প্রারম্ভিক বেতন স্কেল ৩ হাজার ৪০০ টাকা ছিল। বর্তমান সরকার প্রথমবারে বৃদ্ধি করে ৮ হাজার ২৫০ টাকার স্কেলে উন্নতি করেন। দ্বিতীয়বার ১ হাজার ৬০০ টাকার স্কেল প্রদান করেছেন। এভাবে প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে উচ্চতর শিক্ষাস্তর পর্যন্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করেছেন। কিন্তু শিক্ষা জাতীয়করণ বিষয়টি দেশের সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থার একটি অবকাঠামো। যেখানে প্রাথমিক লেবেল থেকে শুরু করে উচ্চস্তরের শিক্ষাব্যবস্থা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। সেখানে শিক্ষার সব স্তরের শিক্ষক-কর্মচারী আন্দোলনে শামিল হবেন কেন? সরকারের নীতি-নির্ধারকরা বা শিক্ষা মন্ত্রণালয় এটা নির্ধারণ করবে।

শিক্ষা জাতীয়করণ বা জাতীয় শিক্ষা ব্যাবস্থার সংজ্ঞা : দেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার শ্রেণি এবং স্তরভেদে সব স্তরের শিক্ষাব্যবস্থায়, সরকারি কারিকুলাম অনুযায়ী একটি অভিন্ন পাঠ্যসূচির আওতায় পাঠদান প্রক্রিয়া ও পরীক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে সর্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন ঘটানোর ব্যবস্থাই শিক্ষা জাতীয়করণ বা জাতীয় শিক্ষানীতি বা জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা।

জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার পরিকাঠামো : যে শিক্ষা ব্যবস্থার ভেতরে সর্বজনীন একটি শিক্ষাব্যবস্থার রূপ বিদ্যমান থাকবে। যেটি শিক্ষার স্তর ভেদে সব স্তরে পরিস্ফূটন ঘটবে। ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও কারিগরি শিক্ষার বিষয়গুলো শ্রেণি ভেদে আলাদা পাঠ্যপুস্তক ব্যতীত, আবশ্যিক বিষয়গুলো- প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার (অনার্স, মাস্টার্স ও উচ্চতর ডিগ্রি ব্যতীত) সব পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শ্রেণিতে বহাল থাকবে। কিন্ডারগার্টেন, সরকারি, বেসরকারি, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আবশ্যিক বিষয়গুলো শ্রেণি বা স্তর অনুযায়ী একই পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত থাকবে। যদি প্রাথমিক স্তর হয়- তবে প্রাথমিক স্তরের ১ম শ্রেণি, ২য় শ্রেণি, ৩য় শ্রেণি, ৪র্থ শ্রেণি, ৫ম শ্রেণির সব পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেমন : সরকারি, বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কিন্ডারগার্টেন, মাদ্রাসাসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একই পাঠ্যপুস্তক থাকবে। কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা কোনো কর্তৃপক্ষ আলাদা কোনো কারিকুলাম বা পাঠ্যপুস্তক তৈরি করতে পারবে না। একইভাবে ৬ষ্ঠ, ৭ম, ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত সব পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিষয়ভিত্তিক শ্রেণিওয়ারি অভিন্ন পাঠ্যপুস্তক অনুযায়ী পাঠদান ব্যবস্থা থাকবে, তেমনি ৯ম, ১০ম শ্রেণি স্তরে মানবিক শাখা, বিজ্ঞান শাখা ও বাণিজ্য শাখার সব বিভাগে; এভাবে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণি ও উচ্চশিক্ষার স্তরে অভিন্ন আবশ্যিক বিষয়গুলো বজায় রেখে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন এবং পরীক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন।

যদি আরো একটু পরিষ্কার করে বলি যে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১ম শেণিতে বাংলা, অঙ্ক, ইংরেজি, সমাজ বিজ্ঞান ও সাধারণ জ্ঞান এমন ৫টি বিষয় পড়ানো হয়। এ বিষয়গুলো দেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত প্রাথমিক লেবেলের সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেমন : কিন্ডারগার্টেন, মাদ্রাসা, সরকারি, বেসরকারি সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১ম শ্রেণিতে একই পাঠ্যপুস্তক রূপে বিদ্যমান থাকবে। আলাদা কোনো পাঠ্যপুস্তক থাকবে না। তবে এভাবে শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন ঘাটাতে হলে ‘জাতীয় শিক্ষা বোর্ড’ গঠন করতে হবে। যেখান থেকে দেশের বিভাগীয় সব শিক্ষা বোর্ড পরিচালিত হবে একই কারিকুলামে। কোনো বোর্ডের সঙ্গে কোনো শিক্ষা বোর্ডের পার্থক্য থাকবে না। এ জন্য একটি জাতীয় শিক্ষা কমিটি থাকতে হবে। আমরা দেখেছি একই দেশের ভেতরে অবস্থিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পাঠ্যপুস্তক, পাঠ্যসূচির মধ্যে বিস্তর ব্যবধান। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের আবশ্যিক বিষয়গুলো যেমন বাংলা, অঙ্ক, ইংরেজি, সমাজবিজ্ঞানসহ অন্য আবশ্যিক বিষয়ের পাঠ্যপুস্তকগুলো সম্পূর্ণ আলাদা। আবার মাদ্রাসা বোর্ডের আবশ্যিক বিষয়গুলোও তাদের কারিকুলাম অনুযায়ী ভিন্নভাবে লেখা হয়েছে এবং পরীক্ষা ব্যবস্থাও ভিন্ন। ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষা কুারিকুলামে পরিচালিত এ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা গ্রহণের পর শিক্ষার্থীরা যখন কর্মজীবনে অর্থাৎ পেশাগত জীবনে প্রবেশ করছে যোগ্যতার মাপকাঠিতে প্রচলিত আবশ্যিক বিষয়ের জ্ঞানে বিশেষ করে কারিগরি এবং মাদ্রাসা বোর্ডের শিক্ষার্থীরা অনেক দুর্বল। সাধারণ শিক্ষা কারিকুলামে পাস করা একজন শিক্ষার্থীর মেধা স্কোর যদি ৮০ হয়। কারিগরি বা মাদ্রাসা বোর্ডের একজন শিক্ষার্থীর মেধা স্কোর ৩০। অথচ চাকরি ক্ষেত্রে গিয়ে তারা শতভাগ অধিকার ভোগ করছে। এ ছাড়া রয়েছে আরেকটি শিক্ষা কারিকুলাম ‘ওপেন ইউনিভারসিটি’ বা ’উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়’। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন মাধ্যমিক স্তর থেকে শুরু করে উচ্চ পর্যায়ে শিক্ষা গ্রহণের সুব্যবস্থা রযেছে। এখানে কারা পড়ছে? সঠিক শিক্ষা গ্রহণে ব্যর্থ, শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া, উড়নচণ্ডি, বাউ-ুলে যত শিক্ষার্থীর জন্য এই ব্যবস্থার প্রচলন। উদাহরণটা এমন যে, আমাদের বাড়ির অপ্রয়োনীয় জিনিস এবং যত ময়লা, আবর্জনা কুড়িয়ে যেমন ঝুড়িতে বা ডাস্টবিনে জমা করি। পরবর্তী সময়ে এসব ময়লা সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নকর্মীরা গাড়িতে ভরে নিয়ে কোনো নির্ধারিত ডোবা বা নিচু স্থানে জমা করে। মেধাহীন, মেধায় দুর্বল এমন ধরনের সব স্তরের শিক্ষার্থীর জন্য একটি সুনির্দিষ্ট শিক্ষার স্থান ওপেন ইউনিভারসিটি। অথচ এই উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন থেকে পাস করা অনেকেই এ দেশের প্রাথমিক, মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। বিশেষ করে রেজিস্ট্রিকৃত সরকারি, বেসরকারি প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খুঁজলে এমন বহু শিক্ষককে খুঁজে পাওয়া যাবে। আজকে এমন ধরনের বহু শিক্ষক সমমর্যাদায় সমান অধিকার ভোগ করছেন। আবার তারা বেতন-ভাতা বাড়ানোর জন্য আন্দোলন করছেন। বড় আশ্চর্য সেলুকাস। শিক্ষক নিয়োগের নীতিমালায় কোনো ‘স্টপেজ নীতি’ না থাকার কারণে সেখানে একজন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় এবং কারিগরি শিক্ষা বোর্ড, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড থেকে পাস করা ডিগ্রিধারী সরকারি প্রাইমারি, সরকারি-বেসরকারি হাইস্কুল, কলেজে এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষক হিসেবে আবেদন করার সুযোগ পাচ্ছেন আবার নিয়োগপ্রাপ্তও হচ্ছেন। সুতরাং শিক্ষাকে যদি জাতীয়করণ বা জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রচলন করতে হয়। তাহলে আগে দেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত সব পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থায় অভিন্ন পাঠ্যসূচি এবং অভিন্ন শিক্ষা কারিকুলাম প্রণয়ন করতে হবে। একই সঙ্গে বিশেষ করে শিক্ষানীতিতে কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে কিছু ‘স্টপেজ’ থাকতে হবে। বিশেষ করে দেশের যে কোনো স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরিদানের ক্ষেত্রে। এগুলো না থাকার কারণে একজন শিক্ষিত বেকার না বুঝে যে কোনো স্থানে আবদেন করে বসেন এবং ব্যাংক ড্রাফট বা পে-অর্ডারে অহেতুক টাকা নষ্ট করেন। কর্তৃপক্ষ নিয়োগ কোটা পূরণ করতে গিয়ে, ব্যাংক ড্রাফট/পে-অর্ডারের টাকা হালাল করতে গিয়ে, সব আবেদনকারীর আবেদনকে বৈধ হিসেবে গণ্য করে চাকরি প্রার্থীকে ভাইবা বোর্ডে আহ্বান করে। এভাবে দেশের সরকারি-বেসরকারি, অফিস-আদালত, কোর্ট-কাচারি, ব্যাংক-বিমাসহ বিভিন্ন অধিদপ্তরে মেধাশূন্যরা মামা, খালু আর টাকার জোরে এ দেশে চাকরি ক্ষেত্রে জায়গা দখল করে নিয়েছে/নিচ্ছে। সেখানে মেধাবীদের শিক্ষার সনদ নিরর্থক! পরিশেষে বলব যে, যদি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে জাতীয়করণ বা জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় রূপদান করতে হয়- উপস্থাপিত ওই বিষয়গুলোর ওপর নজর দিয়ে সঠিক পর্যালোচনাপূর্বক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যেতে পারে।