ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মতামত

অবৈধ হাসপাতাল ও ক্লিনিক বন্ধ করতে হবে

উম্মে কুলসুম কাইফা, শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
অবৈধ হাসপাতাল ও ক্লিনিক বন্ধ করতে হবে

আমাদের দেশে যেখানে সেখানে গড়ে উঠছে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। হাসপাতাল ও ক্লিনিকের সংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি চিকিৎসাসেবার মান। চিকিৎসা ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ফেরানোর লক্ষ্যে সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অভিযানে গবেষণা জরিপের ফল প্রকাশ করেছে, আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, আইসিডিডিআর,বি। বাংলাদেশে অবস্থিত একটি আন্তর্জাতিক চিকিৎসা-সংক্রান্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির জরিপে উঠে এসেছে দেশে বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকের শুধু ছয় শতাংশ বৈধ। স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৫৯ শতাংশ নতুন লাইসেন্স পেতে কিংবা নবায়নের আবেদন করেছে, তবে এখনও পায়নি। ৩৫ শতাংশ লাইসেন্স পাওয়া কিংবা নবায়নের আবেদন না করেই চলছে। পৃথিবীতে মানবসেবার যত পেশা রয়েছে, তারমধ্যে চিকিৎসা অন্যতম। কিন্তু একশ্রেণির অর্থলোভী মানুষ এ মহান পেশার সুযোগ নিয়ে গড়ে তুলছে অবৈধ ক্লিনিক ও হাসপাতাল। বাংলাদেশের বেশিরভাগ লোক দরিদ্র এবং অধিকাংশ লোক গ্রামে বাস করছে। যেখানে এ দেশের অনেক মানুষ এখনো দুইবেলা পেট ভরে খেতে পারে না, সেখানে রোগব্যাধি যেন ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’। দরিদ্র জনগোষ্ঠী প্রথমেই যে কোনো তথাকথিত ভালো ডাক্তারের শরণাপন্ন হন বিষয়টা ওমন না। তারা প্রথমেই গ্রাম্য ডাক্তারের কাছে সেবা নিতে যান, সেখানে সুস্থ না হলে সরকারি হাসপাতালে যান এবং সেখানে চিকিৎসা ভালো না পেলে সেই অবৈধ ক্লিনিকগুলোর চটকদার সাইনবোর্ড দেখে বাঁচার আশায় তাদের কাছে যান। ফলস্বরূপ একদিকে জীবন বাঁচাতে তারা তাদের ভিটেমাটি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে ও অন্যদিকে ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুর খবর প্রায়ই সংবাদ শিরোনামে হয়।

এখন দেখা যাক, সমাজের যারা আর্থিকভাবে সচ্ছল তাদের দিকে। যেহেতু তারা সচ্ছল তাই তাদের চিকিৎসা ও চিকিৎসকের অভাব হয় না। দেশে ভালো চিকিৎসা না হলেও তাদের কোনো সমস্যা হয় না, তারা উন্নতসেবার জন্য বিদেশে পাড়ি দেন। বিভিন্ন প্রতিবেদনে আমরা দেখতে পাই, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের হাসপাতালে ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ রোগীই বাংলাদেশের।

আমাদের দেশের অধিকাংশ লোক দরিদ্র। কিন্তু তারপরও দেখা যায়, বর্তমানে দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ স্বাস্থ্যসেবার জন্য নির্ভর করে বেসরকারি হাসপাতালের ওপর। কেননা, আমাদের দেশের চিকিৎসা মানসম্পন্ন নয়। দেশের কোনো হাসপাতালে লিভার ট্রান্সপ্লান্টের ব্যবস্থা নেই, হাতে গোনা দুইটি বা তিনটি হাসপাতাল ছাড়া কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট হয় না। দেশে কোনো হাসপাতালে জেনেটিক বা বায়োমলিকুলার ল্যাব নেই, আইসিইউ সুবিধা অপর্যাপ্ত, সব মেডিকেল কলেজে নেই হার্টে রিং পরানোর ব্যবস্থা, কিডনি ডায়ালাইসিসের কোনো সুবিধা নেই। এ সব সীমাবদ্ধতাকে পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করে একশ্রেণির স্বার্থপর ব্যবসায়ী মহল গড়ে উঠছে অসংখ্য অবৈধ হাসপাতাল। তারা ব্যবসার উদ্দেশে সাইনবোর্ড ব্যানারে সর্বাধুনিক চিকিৎসা ও প্রযুক্তির ব্যবহারের নিশ্চয়তা ও দেশি-বিদেশি ডিগ্রিধারী চিকিৎসকের কথা বলে থাকে। সুতরাং বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বেসরকারি হাসপাতালের অপর নির্ভরশীলতা কারণ হলো, সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ নানা সংকট।

অবৈধভাবে গড়ে ওঠা হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে কোনো নিয়ম মেনে তৈরি করা হয় না।

সেই হাসপাতাল ও ক্লিনিকে না থাকে রোগীর জন্য সুস্থ পরিবেশ, থাকে না পর্যাপ্ত পরিমাণে অভিজ্ঞ ডাক্তার। তাদের কাছে মানুষের জীবনের চেয়েও বড় হয়ে উঠে অর্থ। সুস্থ হতে এসে সঠিক চিকিৎসার অভাবে অনেক মানুষকে মৃত্যুরকোলে ঢলে পড়তে হয়। নিম্নবিত্ত মানুষদের অনেক সময় বিলাপ করতে দেখা যায় যে, সৃষ্টিকর্তা তাদের ওমন রোগ কেন দিলেন। তাদের করুণ পরিণতির জন্য ভাগ্যকে দোষ দিয়ে থাকেন, আমাদের দেশের নিম্নবিত্ত মানুষরা।

বিভিন্ন মিডিয়ার বদৌলতে প্রায়ই ভুল অস্ত্রোপচারে নবজাতকের মৃত্যু, ভুল চিকিৎসায় শিশুর মৃত্যুসহ এমন অসংখ্য নিউজ আমরা দেখতে পাই। আগেই বলা হয়েছে, অবৈধভাবে যেসব হাসপাতাল ও ক্লিনিক তৈরি করা হয়, সেখানে থাকে না কোনো অভিজ্ঞ ডাক্তার, এমনকি ভুয়া সার্টিফিকেট নিয়ে অনেকে চিকিৎসা করে থাকেন, ফলে তাদের হাতে হতভাগ্য মানুষ নিজের মূল্যবান জীবন হারায়। বর্তমানে আমাদের সরকারি হাসপাতালের অবস্থা এমন যে, যেকোনো সরকারি হাসপাতালের গেট থেকেই শুরু ওষুধের দোকান, প্যাথলজি সেন্টার, ক্লিনিক, অ্যাম্বুলেন্সের বহর, দালাল, ধান্দাবাজ ও প্রতারণার চক্রের দল। সরকারি হাসপাতালের ওপর আস্থা হারিয়ে অনেককেই চিকিৎসা নিতে যান এবং গবেষণায় দেখা যায়, ভারতে চিকিৎসা বছরে প্রায় ৪০০ কোটি ডলার বাইরে চলে যায়। জনসাধারণকে বাঁচাতে হলে আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। আমাদের দেশে আইন তৈরি হলেও হয় না। আইনের যথাযথ প্রয়োগ কারণ হিসেবে বলা যায়, আমাদের দেশে প্রতিটা সেক্টরে রয়েছে ক্ষমতাশালীদের প্রভাব ও দুর্নীতি। সুতরাং প্রশাসনকে দুর্নীতি রোধে সামগ্রিক পদক্ষেপ নিতে হবে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব দেশের মানুষের জান ও মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আমাদের দেশে সরকারি পর্যায়ে চিকিৎসার মান যদি ভালো হতো, তবে অবৈধ হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে জনসাধারণ ভিড় করত না। বিভিন্ন কারণে আমাদের দেশের সরকারি হাসপাতালের সেবা নিয়ে সংশয় ও যথেষ্ট সীমাবদ্ধতা রয়েছে, এ কথা স্বীকার করতেই হবে। এখন যদি যৌথ বা ব্যক্তিমালিকাধীন পর্যায়ে যদি বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক গড়ে ওঠে, সেটা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় উদ্যোগ।

কিন্তু চিকিৎসার মতো মহান পেশার আড়ালে যারা অবৈধ হাসপাতাল ও ক্লিনিক তৈরি করে প্রতারণা করছে ও মানুষের জীবন নিয়ে খেলছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। যথোপযুক্ত আইন প্রণয়ন করে এই অপরাধী চক্রকে দীর্ঘ বা আজীবন কারান্তরাল নিশ্চিত করতে হবে ও সরকারি চিকিৎসা সেবার মান বাড়াতে হবে, তবেই দেশের নিম্নবিত্ত এবং সীমিত আয়ের ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষরা বাঁচতে পারবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত