যে কারণে প্রবীণসেবার নসিহত কাজে লাগে না

হাসান আলী, কলাম লেখক

প্রকাশ : ২৮ জুলাই ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

নসিহত মানে কথার মাধ্যমে মনোজগতের কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন করা। আধুনিক জীবনে নসিহত বিষয়টি প্রেষণার ধারণার সঙ্গে যায়। মানুষ বোধহয় ভাষা রপ্ত করার পর থেকে নসিহত শুরু করেছিল। কাজ আদায় করার জন্য নসিহত করার রীতি এখনও বলবৎ রয়েছে। মানুষ শিকারি জীবনে অপেক্ষাকৃত প্রবীণদের কাছ থেকে পরামর্শ-নির্দেশনা পেত। শিকারের দক্ষতা, হাতিয়ার বানানো, ভৌগোলিক ধারণা, আত্মরক্ষার কৌশল, আবহাওয়ার পরিবর্তন ইত্যাদি বিষয়ে প্রবীণদের অভিজ্ঞতা নবীনদের কাজে লাগত। জীবনাচার, সন্তান লালনপালন, গুহায় বাস, আগুন সংরক্ষণের জ্ঞান ছোটরা বড়দের কাছ থেকে শিখত। সে সময় প্রবীণ মানে বড়জোর ৩০ বছর বয়স। প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করে দীর্ঘায়ু হওয়া প্রায় অসম্ভব ব্যাপার ছিল। প্রয়োজনের তাগিদে নবীনরা অপেক্ষাকৃত প্রবীণদের গুরুত্ব দিত। তখন প্রবীণসেবার নসিহত বড় করে সমাজে দেখা যায়নি। কৃষির প্রচলন শুরু হলে মানুষ স্থায়ী বসতি স্থাপনে আগ্রহী হয়। কৃষিনির্ভর সমাজের শুরুর দিকে চাষবাস, বীজ সংরক্ষণ, সেচ কাজ, ফসল গোলাজাতকরণ, জমির উর্বরতা বৃদ্ধি, পোকামাকড় দমন, ফসল রক্ষার কৌশল ইত্যাদি রপ্ত করার জন্য প্রবীণের অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দেয়া হতো। কৃষির উন্নয়ন মানুষের বেঁচে থাকার সুযোগ বৃদ্ধি করল। সম্পদ সৃষ্টি হলো এবং আরও সম্পদ সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিল। মানুষের গড় আয়ু বাড়তে থাকল। সমাজে প্রবীণ মানুষের সংখ্যা বাড়ল। এরই মধ্যে সমাজে বিভিন্ন ধর্মের আবির্ভাব শুরু হতে থাকল। প্রবীণ ব্যক্তিদের প্রয়োজন ও গুরুত্ব কমে যেতে থাকল। সম্পদশালী নবীনরা প্রবীণ জীবনের অবহেলা দেখে চিন্তিত হলো। ধর্ম প্রচারকরা এ সময়ে প্রবীণ ব্যক্তিদের সম্মান জানানোর জন্য জনসাধারণকে আহ্বান জানাতে থাকে। সনাতন ধর্মের প্রচারকরা প্রচার করতে থাকলেন, ‘পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম। পিতাহী পরমং তপঃ।’ বাবাকে সর্বোচ্চ সম্মান দিতে হবে। বাবাই আরাধনা-তপস্যা করার বিষয়। হিন্দুশাস্ত্রে বলা হয়েছে, ‘গর্ভধারিণী মা পিতা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।’ হাজার হাজার বছর ধরে ধর্মপ্রচারকরা এসব নীতিকথা মানুষকে শুনিয়েছেন। মানুষ কিছুটা মান্য করেছে বটে; কিন্তু যখনই প্রবীণ বোঝা হয়েছেন তখনই তার পুনর্বাসন হয়েছে। সমাজ তৈরি করল বৃদ্ধাশ্রম। এ বৃদ্ধাশ্রম গড়ে উঠলো মন্দিরকে কেন্দ্র করে। পূজারি পূজা দিত, সঙ্গে দিত ভোগ। এই চেয়ে-চিন্তে খেয়েদেয়ে প্রবীণ জীবন চলত। আমাদের হিন্দু সমাজে গয়াকাশিতে তীর্থস্থান হিসেবে প্রবীণ ব্যক্তিরা যেতেন। জীবনের শেষ দিনগুলো কাশিতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিধবা প্রবীণরা তীর্থস্থানে থাকতেন। ছেলেমেয়েদের কাছে থাকার সুযোগ হতো না। প্রবীণ আর্থিক সংকটে পড়ে এবং বয়স বৃদ্ধির কারণে পরিবারে কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালনে অক্ষম হয়ে পড়েন। আস্তে আস্তে আবেগ, নীতিকথা, ধর্মের বাণী দুর্বল হয়ে যায়। দ্রুত আচরণের পরিবর্তন ঘটতে থাকে। ছেলেমেয়েরা সামর্থ্যবান হলে মা-বাবাকে কাশিতে পাঠিয়ে থাকা-খাওয়ার খরচ বহন করতেন। যাদের সেই সামর্থ্যটুকু ছিল না তারা পথ খরচ জোগাড় করে তীর্থস্থানে হাজির হতেন। অনেকটা ভিক্ষাবৃত্তি করেই জীবন কাটাতে হতো। তীর্থস্থানগুলোয় বেশিরভাগ সময়ই অসহায় প্রবীণদের দেখা যায়। যারা অপেক্ষা করেন সামর্থ্যবানের দয়া-করুণার জন্য। ধর্মের নসিহত থাকার পরও অনেকেই মা-বাবার খোঁজখবর রাখেন না। সমাজের নীতিকথা উপেক্ষা করে মা-বাবাকে কষ্ট দেয়। সমাজ অভিশাপ দেয় নবীনদের। একদিন তাদের জন্য বার্ধক্য আসবে, তখন কী হবে? নবীনরা এসব অভিশাপকে গায়ে মাখে না। ইসলাম ধর্মের পবিত্র কোরআনে নির্দেশ রয়েছে মা-বাবার প্রতি সদ্ব্যবহার করার জন্য। বৃদ্ধ মা-বাবাকে বিরক্তসূচক কিছু বলা থেকে বিরত থকতে হবে। হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, যেসব ব্যক্তি বৃদ্ধ মা-বাবার সেবাযত্ন করবে না তাদের জান্নাত প্রবেশ হবে না। ধর্মীয় কঠোর নির্দেশ থাকার পরও আমাদের সমাজে সন্তানদের হাতে অনেক বৃদ্ধ মা-বাবা চরম নির্যাতনের শিকার হন। আবার বেশিরভাগ মা-বাবাই এসব নির্যাতন-অপমানের কথা কাউকে বলতে চান না। অব্যাহত নসিহত সন্তানদের মনঃপূত হচ্ছে না। পরকালে কঠিন শাস্তি এবং বেহেশতে প্রবেশ করা যাবে না- এমন ঘোষণা থাকার পরও প্রবীণরা নানা ধরনের হয়রানির শিকার হন। খ্রিস্টান-বৌদ্ধসহ অন্যান্য ধর্মে মা-বাবা এবং প্রবীণ ব্যক্তিদের শ্রদ্ধা, সম্মান, সেবাযত্নের নির্দেশ রয়েছে। ধর্মের নির্দেশ, সমাজের নসিহত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নৈতিকশিক্ষা প্রবীণ অবহেলা কমাতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। স্কুলজীবনে কমবেশি সবাই ‘মা-বাবার প্রতি কর্তব্য’ এ রচনাটি শিখেছেন এবং লিখেছেন। বাস্তব জীবনে অনেকেই এ কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হয়েছেন। প্রবীণের প্রতি সম্মানজনক আচরণের নসিহত কাজে লাগছে না। এ বিষয়ে গবেষণা হওয়া উচিত। শিল্পবিপ্লবের পর অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়। একই সঙ্গে সমাজের পরিবর্তন শুরু হয়। যৌথ পরিবার ভেঙে গিয়ে নতুন পরিবার গড়ে উঠে স্বামী-স্ত্রীকে কেন্দ্র করে। নতুন কর্মসংস্থান শুরু হলে লাখ লাখ নবীন পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। নতুন নতুন কলকারখানা, রেল, নৌপথ, সড়ক যোগাযোগ স্থাপন হওয়ায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পায়। চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিশাল বিশাল সাফল্য মানুষের গড় আয়ু বাড়িয়ে দেয়। ব্যাপক উন্নয়নের ফলে আমাদের সমাজে বার্ধক্য আসে। উল্লেখযোগ্য হারে প্রবীণ জনগোষ্ঠী বাড়তে থাকে। প্রবীণ এ জনগোষ্ঠী কোনো ধরনের প্রস্তুতি ছাড়া প্রায় শূন্য হাতে ওপরওয়ালার ওপর ভরসা করে বার্ধক্যে প্রবেশ করেন। বার্ধক্যে এসে অনেকে নতুন এ জীবন মেনে নিতে চান না। একদল মনে করে বুড়া হইনি, আরেকদল মনে করে যে কোনো সময় পরপারের ডাক আসবে। আবার কেউ কেউ নিজেকে নিয়তির কাছে সমর্পণ করেন। বার্ধক্যের এ নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে গিয়ে নালিশ, অভিযোগ-অভিশাপ, ক্ষোভ-বিক্ষোভ ইত্যাদির মধ্যে আটকে পড়ে। শুরু হয় নসিহত। তরুণদের মধ্যে ভেতরে ভেতরে ক্ষোভ দানা বাঁধে। সেই ক্ষোভ একসময় ঘৃণায় রূপান্তরিত হয়ে প্রবীণের কষ্ট বাড়িয়ে দেয়। একসময় যিনি প্রবীণ হতেন তার হাতে নগদ টাকা-পয়সা অথবা জমিজিরাত থাকত। ছেলে-মেয়েরা মৃত্যুর পর ওইসব সম্পদের মালিক হবে- সেই আশায় প্রবীণ মা-বাবার সঙ্গে কিছুটা হলেও শোভন আচরণ করত। এখন আয়-রোজগার বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রায় প্রত্যেক নবীনই কিছু না কিছু আয়-রোজগার করছে। বাবার সহায়-সম্পদকে তেমন একটা গুরুত্ব দেয় না। আর যেসব প্রবীণ সহায়-সম্বলহীন অবস্থায় প্রবীণ হয়েছেন তাদের দুর্দশার অন্ত নেই। তাদের মধ্যে কেউ কেউ পত্রিকা বা টেলিভিশনে সংবাদ হিসেবে আসেন। অনেকেই দুঃখে কাতর হন, প্রতিবাদ জানান। সুশীল সমাজ গোলটেবিল বৈঠক, সভা, সেমিনার, মানববন্ধন করে আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস পালন করেন। প্রবীণদের দাবি-দাওয়া নিয়ে সোচ্চার হন। আইন প্রণয়নের দাবি তোলেন। সরকার অবশেষে ‘পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন-২০১৩’ প্রণয়ন করে। আইনে বলা হলো, সন্তান মা-বাবার ভরণপোষণ করতে বাধ্য। না করলে ৩ মাসের জেল এবং ১ লাখ টাকা জরিমানা। মা-বাবার ভরণপোষণ ছেলেমেয়ের অবর্তমানে সাবালক নাতি-নাতনীদের করতে হবে। ছেলের বউ, মেয়ের স্বামী কিংবা উভয়পক্ষের আত্মীয়স্বজন মা-বাবার ভরণপোষণে বাধা সৃষ্টি করলে একই দণ্ড ভোগ করতে হবে। ৩ বছরে মাত্র দুটি মামলার সংবাদ শোনা যায়। আসলে কেউই সন্তানের বিরুদ্ধে মামলা দিতে রাজি হন না। অনেকেই বলেন, এ আইন আমাদের দেশের বাস্তবতায় গ্রহণযোগ্য হয়নি। মামলায় সন্তানদের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী মনোমালিন্য তৈরি হবে। জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক, ইমাম, সমাজকর্মী, ক্লাব, সংগঠন, সাংবাদিকরা সংগঠিত হয়ে তাদের পক্ষ থেকে কেউ মামলা করলে কিছুটা সুফল হয়তো পাওয়া যেতে পারে। ধর্মীয়-সামাজিক উদ্যোগ যখন প্রবীণকে নিরাপত্তা দিতে পারল না তখন রাষ্ট্র আইন প্রণয়ন করল ভরণপোষণের জন্য। প্রবীণদের স্বস্তিময়, কর্মময়, আনন্দদায়ক জীবনের জন্য প্রবীণ নীতিমালা-২০১৩ গৃহীত হয়েছে। রাষ্ট্রপতি ৬০ বছরের অধিক ব্যক্তিদের সিনিয়র সিটিজেন ঘোষণা দিয়েছেন। স্কুলের পাঠ্যবইয়ে প্রবীণের সোবাযত্ন, মর্যাদা নিয়ে গল্প-প্রবন্ধ লেখা হয়েছে। কিন্তু অবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। প্রকৃতিগতভাবেই মানুষ কিছুটা স্বার্থপর, লোভী। এ স্বার্থপরতা প্রথমে ছিল নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কিংবা টিকে থাকার জন্য। পরবর্তী সময়ে এ স্বার্থপরতা তৈরি হয়েছে সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করার অসুস্থ প্রতিযোগিতা হিসেবে। প্রতিনিয়ত পৃথিবীর নানা ধরনের পরিবর্তন ঘটছে। কোনোটা আমাদের নজরে আসছে কোনোটা আবার নজরে আসেনি। পরিবর্তিত নতুন পরিস্থিতিতে প্রবীণ সেবার বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে। শুধু নসিহতনির্ভর কিংবা কঠিন আইন প্রণয়নের মাধ্যমে প্রবীণসেবা নিশ্চিত করা যাবে বলে আমি মনে করি না। প্রবীণ হওয়ার প্রস্তুতি নেয়া অর্থাৎ শারীরিক, মানসিক, আর্থিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার চেষ্টা করা। যারা স্বয়ংপূর্ণ হতে ব্যর্থ হবে তাদের জন্য সরকারিভাবে বরাদ্দ থাকবে। যেমন এখন বয়স্ক ভাতা দেয়া হয়। সেই ভাতা বাড়িয়ে আরও সম্মানজনক করা যায়। সবকিছুতেই সরকারনির্ভর হলে বিড়ম্বনা বাড়বে। শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য যৌবনকালে সম্ভব হলে শিশুকাল থেকেই প্রবীণ হওয়ার প্রস্তুতি নিতে হবে। যৌবনে মাদক গ্রহণ, অপুষ্টিকর খাবার, দুশ্চিন্তা, মারামারিসহ নানা ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে বার্ধক্যে উপনীত হলে শান্তি হবে না। টাকা-পয়সা সুস্বাস্থ্য নিয়ে বার্ধক্যে উপনীত হতে হবে। সন্তানসন্ততি, আত্মীয়স্বজনকে সহযোগিতা করার মনোভাব তৈরি করতে হবে। কাউকে কষ্ট না দেয়া, নিজে কষ্ট না পাওয়া- এ ধরনের ভাবনা নিয়ে এগোতে হবে। শুধু সন্তানের আশায় বার্ধক্যে উপনীত হওয়া খুবই ঝুঁকিপূর্ণ বলে আমার মনে হয়েছে। নিজের বুঝ রাখতে হবে। সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে নিজের যোগাযোগ অব্যাহত থাকলে মানসিক প্রশান্তি লাভ হবে। শুধু প্রবীণ সেবার নসিহত সংকট কাটাতে সহায়ক হবে না।