সংকটময় পরিস্থিতিতে পানিসম্পদ কৌশলে শিক্ষা

ত্রিয়মা রায়

প্রকাশ : ২৯ জুলাই ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ব্যবহার্য পানি নিয়ে যত হইচই, হা-হুতাশ, হাহাকার, আলোচনা, সমালোচনা অন্য কোনো ব্যবহার্য বস্তুকে নিয়ে তার ধারেকাছেও থাকে না। সুনির্দিষ্ট কারণও আছে। একেবারে নির্দিষ্ট করা। পানির অপর নাম জীবন। পানি মানুষের সাহসী, নির্ভীক, অকৃত্রিম বন্ধু। মানবদেহের মোট ওজনের তিন ভাগের দুই ভাগই পানি।

পানি থেকে কেবল মানুষ বিশেষ আনুকূল্য লাভ করে তা নয়; পশুপাখি, কীটপতঙ্গ, গাছপালা, যে কোনো প্রাণ বেঁচে থাকার জন্য চাই পানি। পরিবেশের যে মায়াময় রূপ, প্রশান্ত, স্নিগ্ধতা- এর পুরোটাই নির্ভর করে পানিপ্রবাহের ওপর। মানুষের নিরোগ জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজন বিশুদ্ধ পানি। প্রবাদ আছে, ‘বিশুদ্ধ পানি হলো পৃথিবীর প্রথম এবং সবচেয়ে প্রয়োজনীয় ওষুধ।’ বিশুদ্ধ পানিকে ‘নীল স্বর্ণ’ বলে পানিবিজ্ঞানীরা আখ্যা দিয়েছেন।

পানি আছে বলেই আমরা ভাগ্যক্রমে বেঁচে আছি। জীবন ভোগ করছি, ভরাট গলায় স্বাচ্ছন্দ্য বাক্যে চমৎকারভাবে আলোচনা করছি। পানি নিয়ে গান, কবিতা, গল্প লেখা হচ্ছে, চিত্রশিল্পীরা মাধ্যম হিসাবে জলরং ব্যবহার করছেন। সিনেমায় বৃষ্টির পানিকে আবেগী অনুভূতির অনুষঙ্গ বলে উপস্থাপন করছেন। এই সবই করা হচ্ছে আমাদের ব্যবহার্য পানি থেকে।

দিগন্তজোড়া যে বিস্তৃত পানির সাগর-মহাসাগর তা কিন্তু ব্যবহার উপযোগী নয়। পৃথিবীর চার ভাগের তিন ভাগজুড়ে পানি থাকা সত্ত্বেও মানবজাতির ব্যবহারযোগ্য পানির পরিমাণ মোট পানির মাত্র ১ শতাংশেরও কম। সমুদ্র-মহাসমুদ্রে রয়েছে ৯৭ শতাংশ, হিমবাহ-তুষারস্রোতে রয়েছে ২ শতাংশ। মানুষের ব্যবহার উপযোগী যে ১ শতাংশ পানি তার অর্ধেক রয়েছে ভূপৃষ্ঠের আধা মাইল নীচে, মানুষের আয়ত্তের বাইরে। অবশিষ্ট পানি রয়েছে নদী, খাল, বিল, লেক ও অগভীর ভূগর্ভে। মেঘ থেকে বৃষ্টি হওয়ার পানিচক্রের মাধ্যমে পুনর্ব্যবহারোপযোগী পানির পরিমাণ মাত্র দশমিক তিন ভাগ।

সময় মতো ও পরিমাণ মতো বৃষ্টি না হওয়ার অতি সম্প্রতি ব্যবহার্য পানির সরবরাহে মারাত্মক ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়েছিল। দম আটকানো অবস্থার মধ্যে যাও ছিটেফোঁটা পাওয়া গিয়েছিল, তা ছিল মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ত। নিতান্তই অপ্রতুল এই পানি ব্যবহার করে নানা রকম রোগবালাইয়ে আক্রান্ত হওয়ার খবর তো দেশের প্রায় সব মিডিয়া নিষ্ঠার সঙ্গে প্রচার করেছে।

নিত্যনৈমিত্তিক কাজে ব্যবহারযোগ্য মাত্র দশমিক ৩ শতাংশ পানিও আবার পৃথিবীর সব অঞ্চলে সমভাবে পাওয়া যায় না। বাংলাদেশ সেই দিক থেকে সৌভাগ্যবান। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্রায় সব মৌসুমেই সোনায় সোহাগা হিসাবে মিঠাপানি পাওয়া যায়। আনন্দের অধিকারী হয়ে বিশুদ্ধ পানির জন্য দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ অগভীর নলকূপের ওপর নির্ভর করে।

পৃথিবীর অনেক দেশ তাও পায় না। ধনী রাষ্ট্র সিঙ্গাপুর নিজস্ব পানি শোধনাগার থাকার পরও ৪০ শতাংশ পানি আমদানি করে মালয়েশিয়ার জোহর নদী থেকে। মেক্সিকো, জাপান, চীন, ইতালি, ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশ বিশুদ্ধ পানি আমদানি করে। তেলের মতো পানিও জাহাজ দিয়ে, বোতলজাত করে বা আন্তঃদেশীয় পাইপলাইন স্থাপন করে আমদানি-রপ্তানি করে। ব্রিটেন ব্যবহারযোগ্য ৬২ শতাংশ পানির চাহিদা পূরণ করে স্পেন, মিশর, মরোক্কো, দক্ষিণ আফ্রিকা, পাকিস্তান ও উজবেকিস্তান থেকে আমদানি করে। যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকো বিশুদ্ধ পানি আমদানি করে কানাডা থেকে।

সরাসরি ছাড়াও কৃষিপণ্য ও ভোগ্যপণ্যের মাধ্যমে প্রকারান্তরে পানি আমদানি করা হয়। অপরাজেয় এইসব দেশ ছাড়াও বিশ্বের ২৬ শতাংশ মানুষ বিশুদ্ধপানি পায় না। ৪৬ শতাংশ মানুষ ভালো ব্যবস্থাপনার পয়ঃনিষ্কাশন সেবা থেকে বঞ্চিত। বেদনার এই করুণ চিত্র তুলে ধরেছে বহু ভূমিকায় অবতীর্ণ ‘জাতিসংঘ’। তাদের বিশ্ব পানি উন্নয়ন প্রতিবেদন ২০২৩-এ তা বিশদভাবে বর্ণনা আছে। ‘জিওফিজিক্যাল রিসার্চ লেটারস্’ সম্প্রতি তাদের গবেষণা প্রতিবেদনে দাবী করেছে মাটির তলদেশ থেকে ক্রমাগত খাবার পানি, কৃষি কিংবা শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় পানি তুলতে তুলতে পৃথিবীর আবর্তনের অক্ষ বদলে যাচ্ছে।

অন্তরালের এই তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সব ঝঞ্ঝা হটানোর জন্য পানিসম্পদ বিষয়ে বিশ্বব্যাপী শিক্ষা, কৌশল, প্রকৌশলবিদ্যায় বিশেষজ্ঞ তৈরি করা হচ্ছে। পানি, পানির উৎস, পানি বণ্টন, ব্যবহার, আইনকানুন, নীতিনির্ধারণ, রাজনীতি ইত্যাদি ছাপিয়ে প্রধান সহায়ক শক্তি হয় পানিসম্পদ প্রকৌশলী, পানিবিজ্ঞানী ও পানি বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশেও পানিভিত্তিক খাল-বিল, হাওর-নদী, সমুদ্রসংলগ্ন কিংবা তলদেশে প্রয়োজনীয় সেতু, বাঁধ, স্পিলওয়ে গেট ইত্যাদি অবকাঠামো নির্মাণ, পরিকল্পনা, রক্ষণাবেক্ষণ, ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণে, কিংবা পানি সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণ শনাক্তকরণ, দুর্যোগপ্রবণ এলাকা শনাক্তকরণ, দুর্যোগের পূর্বাভাস, প্রতিকার ও প্রতিরোধের জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক সমাধান লক্ষ্যে, কৃষি, শিল্প ও প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে পানির যথাযথ সরবরাহ নিশ্চিত, সুপেয় পানির উৎসকে সংরক্ষণ, সঙ্গে বৃদ্ধির তৎপরতা চালানো, পানির লবণাক্ততা পরিহার, পানযোগ্য পানি নিশ্চিতকল্পে পানি শোধনাগার তৈরির পরামর্শ, সমুদ্রের ঢেউয়ের গতিপ্রকৃতি, নদীর পলি জমার কারণ, সুষম প্রতিকার, স্বাভাবিক পানিপ্রবাহের বৈশিষ্ট্য, নির্গমন নিশ্চিত করার জন্য উপযুক্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নতকরণের মাধ্যমে সরল নির্গমন পথ তৈরি, সর্বোপরি বৈশ্বিক বাস্তবতার আলোকে মানবসভ্যতার টেকসই উন্নয়নে পানিসম্পদ সম্পর্কিত স্থাপনা নির্মাণের লক্ষ্যে পানিসম্পদ কৌশল শিক্ষা চালু করা হয়েছে।

দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার লক্ষ্যভেদী বিকাশের নিছক গৎবাঁধা বিশ্লেষণধারার বাইরে এই শিক্ষা কেবল বুয়েট, চুয়েট এবং এমআইএসটিতে সীমিত পরিসরে শুরু করা হয়েছে। ব্যাপক-বিস্তৃত-আলোচিত গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ পানিকে উপজীব্য করে বিশেষায়িত এই শিক্ষা আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটেও অপার গুরুত্ব বহন করে। দক্ষ পানিসম্পদ কৌশলীই নদীমাতৃক বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে উজ্জ্বল অবদান রাখতে পারে।

আমাদের প্রতিনিয়ত দুর্যোগে পরিবেশগত বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন পরিবেশবান্ধব পানিসম্পদ প্রকৌশলী। সুনামের সঙ্গে চলমান দেশসেরা এইসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পানিসম্পদ কৌশল বিভাগের শিক্ষার্থীরা ভাবনার মৌলিকত্বে নিজস্বতায় এগিয়ে যাবে। দেশের গণ্ডি ছাপিয়ে সুপেয় পানিবঞ্চিত বিশ্বের লাখো-কোটি মানুষের কল্যাণে পানিসম্পদ প্রকৌশলীরা সুখকর অবদান রাখবে, এই প্রত্যাশা করি।

পানিসম্পদ কৌশল বিভাগ

চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়-চুয়েট