ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

প্রযুক্তিনির্ভরতা ও জেনারেশন জেড

অভিজিৎ বড়ুয়া অভি, গবেষক ও প্রাবন্ধিক
প্রযুক্তিনির্ভরতা ও জেনারেশন জেড

১৯৯০-এর শেষের দিকে এবং ২০১২-এর শুরুর দিকের প্রজন্মকে জেনারেশন জেড নামে ডাকা হয়। কারণ, এই প্রজন্মটি ইন্টারনেট এবং সোশ্যাল মিডিয়ার সঙ্গে বড় হয়েছে। জেনারেশন জেড প্রযুক্তি, ইন্টারনেট এবং সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে বেড়ে ওঠে, যারা প্রযুক্তি-আসক্ত। তাদের জীবনের প্রথম দিক থেকেই তারা ইন্টারনেট, সোশ্যাল নেটওয়ার্ক এবং মোবাইল সিস্টেম ব্যবহার করার সুযোগ পায়। জেনারেশন জেড হলো সবচেয়ে ইন্টারনেট-নির্ভর প্রজন্ম এবং যারা প্রযুক্তি ব্যবহারের অগ্রগামী।

আমরা প্রযুক্তি দ্বারা চালিত একটি যুগে বসবাস করছি। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রযুক্তির হলো ইন্টারনেট। দৈনন্দিন কাজকর্ম, অফিসিয়াল কাজ, সোশ্যাল মিডিয়া, অনলাইন নিউজ রিপোর্ট, আবহাওয়ার পূর্বাভাস, অনলাইন ব্যবসা, কেনাকাটা, অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থা বিষয়ে আমরা প্রযুক্তির ওপর নির্ভশীল। শিশু, তরুণ, যুবক, প্রাপ্তবয়স্ক, বৃদ্ধ সবাই বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। প্রত্যেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীল। ইন্টারনেট আমাদের জীবনযাপন, কাজ এবং যোগাযোগের পদ্ধতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। ইন্টারনেট আমাদের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে নতুন জেনারেশন জেডের জন্য। বর্তমানে আমাদের ব্যক্তিগত এবং পেশাদার জগতের অনেক কিছুই ডিজিটাল প্রযুক্তির সঙ্গে জড়িত। বর্তমান জেনারেশন জেড আধুনিক প্রযুক্তিকে খুব সহজে আয়ত্ত করতে পারে। প্রশ্ন হলো জেনারেল জেড কি সত্যিই ডিজিটাল উইজার্ডের একটি প্রজন্ম? জেনারেল জেড কি প্রযুক্তি নির্ভর? জেনারেল জেড কি ডিজিটাল বিশ্বে মগ্ন? সোশ্যাল মিডিয়া কি খুব দ্রুত জেনারেল জেডের মনজগৎকে দখল করে নিয়েছে?

জেনারেল জেড সত্যিকারভাবে ডিজিটাল দুনিয়ায় আসক্ত। এ প্রজন্মের ৯৫ শতাংশের স্মার্টফোন আছে। যাদের প্রায় সবাই স্মার্টফোন ব্যবহার করে মধ্যরাতে। তারা এত বেশি ইন্টারনেট ব্যবহারে নির্ভর যে, কয়েক ঘণ্টার বেশি ইন্টারনেট ব্যবহার থেকে দূরে থাকালে অস্থির হয়ে ওঠে। এই প্রজন্ম মানসিক চাপে ভোগে যদি তাদের কাজের সময় তাদের ফোন ব্যবহার করার বা দেখার অনুমতি না দেওয়া হয়। তারা মানসিক রোগের গুরুতর পরিণতির মুখোমুখি হতে পারে, কারণ প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে মস্তিষ্কের তথ্য প্রক্রিয়া করার ক্ষমতা পরিবর্তিত হয়। প্রযুক্তির প্রতি এই আসক্তি মানসিক, শারীরিক এবং সামাজিক ব্যাধির কারণ হতে পারে, যেমন : হতাশা, উদ্বেগ, ঘুমের অভাব। এর ফলে এই প্রজন্মের মস্তিষ্কের তথ্য প্রক্রিয়া করার ক্ষমতা এবং বাহ্যিক, সামাজিক পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করার ক্ষমতার হ্রাস পেতে থাকে, যার ফলে মানসিক রোগের লক্ষণ এবং উপসর্গ দেখা দেয়। অত্যধিক সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার, ইন্টারনেট সার্ফিং থেকে শুরু করে কেনাকাটা বা গেমিংয়ের মতো অনলাইন কাজে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যয় করার ফলে রউরংড়ৎফবৎ হয়। তারা তাদের প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এই প্রজন্মের একটি অংশ জানে না প্রযুক্তি ছাড়া জীবন কেমন। মোবাইল ফোন ব্যবহার আসক্তির ফলে সাইকোপ্যাথলজিকাল লক্ষণ দেখা দিতে পারে। জেনারেশন জেডের মোবাইল আসক্তি তাদের সামাজিক জীবনে প্রভাব ফেলতে থাকে। ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদির মতো সামাজিক ওয়েবসাইটগুলিতে ব্যক্তিগত জীবন শেয়ার করে নেওয়ার মাধ্যমে জেনারেল জেড এমন একটি নতুন এবং ভিন্ন সামাজিক পরিবেশ স্তরে পৌঁছেছে, যা বাস্তব জীবনের চেয়ে ভিন্ন, যা তাদের সামাজিক জীবন এবং মনোজগতের ওপর ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলে। সোশ্যাল মিডিয়ার অত্যধিক ব্যবহারের ফলে তাদের বই পড়া কমে গেছে। সাইবার বুলিং-এর অনুপাত অনেক বেশি পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার জেনারেল জেডের সৃজনশীলতাকে প্রভাবিত করে এবং তাদের মনকে বিক্ষিপ্ত করে।

প্রযুক্তি জেনারেল জেডদের বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। প্রযুক্তির বিরূপ প্রভাব তাদের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর পড়ছে। তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি তাদের কর্মজীবন এবং তাদের লক্ষ্যে একটি বাধা হয়ে উঠে। শারীরিক স্বাস্থ্য সমস্যা হলো দৃষ্টি সমস্যা, পিঠব্যথা, শ্রবণ সমস্যা। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাগুলি হলো: দুশ্চিন্তা, বিষণ্ণতা, সংকীর্ণতা, মুহুর্তের আনন্দের আকাঙ্ক্ষা এবং নিরুৎসাহতা। ইন্টারনেটের অত্যধিক ব্যবহারের ফলে তাদের উৎপাদনশীলতা হ্রাস পেয়েছে, দুর্বল একাডেমিক সক্ষমতা এবং সামাজিক দক্ষতার অভাব সৃষ্টি হয়েছে। জেনারেল জেডদের উপর ইন্টারনেটের আরেকটি উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক প্রভাব হলো সাইবার বুলিং। ইন্টারনেট জেনারেল জেডদের আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কের মানও কমিয়ে দিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলি অন্যদের সাথে সংযোগ করা সহজ করে তুলেছে, কিন্তু তারা অতিমাত্রায় সম্পর্কের সংস্কৃতিও তৈরি করেছে। প্রযুক্তি জেনারেল জেডদের কল্পনাশক্তি বাড়ায়, ফলে জেনারেল জেড যারা খুব বেশি সামাজিক মিডিয়া ব্যবহার করে তারা ব্যপকহারে হতাশায় ভোগেন এবং তাদের মধ্যে আত্মহত্যার ঝুঁকি বাড়ছে। সোশ্যাল মিডিয়া অল্প বয়সি মেয়েদের ওপর বিশেষ প্রভাব ফেলে। কারণ মেয়েরা সাধারণত ছেলেদের তুলনায় হতাশার মতন মানসিক সমস্যায় ভোগেন। সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করা মেয়েদের মধ্যে বিষণ্ণতা মাত্রা ছেলেদের চেয়ে বেশি।

তবে জেনারেল জেডের ওপর প্রযুক্তির ইতিবাচক এবং নেতিবাচক প্রভাব দুটিই রয়েছে। প্রযুক্তি একই সঙ্গে শেখার, বিনোদন এবং বিভ্রান্তির একটি বড় উৎস। প্রযুক্তির প্রভাব সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে কীভাবে এটি ব্যবহার করা হচ্ছে। আধুনিক প্রযুক্তির ডিভাইসের বিভিন্ন ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে আজকের জেনারেল জেডের ওপর। তাদের ওপর প্রযুক্তির ইতিবাচক প্রভাব হলো, প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়া বর্তমান তাদের একটি দিন কাটানো প্রায় অসম্ভব। জেনারেল জেড প্রযুক্তির সাহায্যে মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে অনেক নতুন জিনিস সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে পারে। জেনারেল জেডদের ওপর প্রযুক্তির অগণিত সুবিধা রয়েছে, এটি তাদের জীবনকে সহজ করেনি বরং তাদের জীবনে ইতিবাচক বৈচিত্র্য এবং বৈচিত্র্যের উৎস করে তুলেছে। প্রযুক্তি জেনারেল জেডদের সৃজনশীলতা বাড়িয়েছে। তাদের সৃজনশীলতা এবং মানসিকতা বাড়ার কারণে প্রযুক্তি তাদের মধ্যে শক্তিশালী পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা তৈরি করেছে। তারা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং প্রযুক্তির সাহায্যে জিনিসগুলো অনুভব করছে, যার ফলে তাদের সৃজনশীলতা বাড়ছে। তারা ইন্টারনেটে উপস্থিত তথ্যের সহজ অ্যাক্সেসের মাধ্যমে শিখছে, ফলে প্রযুক্তি জেনারেল জেডদের সৃজনশীলতা বাড়াতে কৌশল গ্রহণ করতে সাহায্য করছে। শেখার এই আগ্রহ তাদের কৌতূহলকে বৃদ্ধি করে। এই কৌতূহল তাদের অনুপ্রেরণা খোঁজার দিকে নিয়ে যায়। এই অনুপ্রেরণা বর্ধিত সৃজনশীলতার দিকে পরিচালিত করে। প্রযুক্তি তাদের নিজেদের চেষ্টা করে নতুন জিনিস শিখতে সক্ষম করেছে। তরুণরা এখন শেখার প্রক্রিয়ায় স্বাধীন হয়েছে। শেখার প্রক্রিয়া তাদের সমস্যা সমাধানকারী করে তুলেছে। প্রযুক্তি নতুন জিনিস শেখার এবং অভিজ্ঞতার প্রতি তরুণদের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তন করেছে।

উন্নত শেখার প্রক্রিয়া তাদের লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করে। প্রযুক্তি সিদ্ধান্ত গ্রহণের দক্ষতা উন্নত করেছে। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ। প্রযুক্তি তাদের ক্ষমতায়ন করছে। প্রযুক্তির অন্যতম সুবিধা হল আজকের আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে জেনারেল জেড ক্ষমতায়ন হচ্ছে। তারা নতুন এবং উদ্ভাবনী কিছু শিখতে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করছে। শেখার পরে, তারা তাদের দক্ষতা প্রকাশ করতে পারছে এবং অনলাইনে আয় করতে পারছে। প্রযুক্তি তাদের নিজেদের এবং অন্য অনেকের জন্য চাকরি তৈরি করে তাদের ক্ষমতায়ন করতে সাহায্য করছে। প্রযুক্তি জেনারেল জেডকে নিজেদের ব্র্যান্ড করতে সক্ষম করছে।

প্রযুক্তির সাহায্যে, তারা তাদের প্রতিভা প্রদর্শন করতে পারছে এবং প্রত্যেককে তারা তাদের দক্ষতা সম্পর্কে জানাতে পারছে। প্রযুক্তির মাধ্যমে ব্যক্তিগত ব্র্যান্ডিং প্রচার করা তাদের জন্য বিভিন্ন সুযোগের পথ খুলে দিয়েছে। ইন্টারনেট ব্যবহারের ফলে জেনারেল জেড বিশ্বজুড়ে যা ঘটছে তার সম্পর্কে জানতে পারে, তবে কিছু তথ্য মাঝে মাঝে তাদের বিভ্রান্তও করে।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে বুঝা যায় যে, প্রযুক্তি কীভাবে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক উভয় উপায়েই জেনারেল জেডদের প্রভাবিত করে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, যে কোনো ক্ষতিকারক পরিস্থিতি এড়াতে প্রযুক্তি ব্যবহারে জেনারেল জেডদের অবশ্যই নিজের ওপর সঠিক নিয়ন্ত্রণ এবং ভারসাম্য থাকতে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত