সুনীল অর্থনীতির বিপুল সম্ভাবনা

অলোক আচার্য, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

প্রকাশ : ৩১ জুলাই ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সমুদ্র অর্থনীতির সম্ভাবনার কথা বেশ কয়েক বছর ধরেই আলোচিত হচ্ছে। ব্লু ইকোনমি বা সমুদ্র অর্থনীতি হলো সমুদ্রনির্ভর অর্থনীতি। তাই বর্তমানে ব্লু ইকোনমি বা সমুদ্র অর্থনীতি বিশ্বের যেকোনো দেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। ক্রমেই স্থলভাগের সম্পদের থেকে সমুদ্রের জলরাশির নিচে ডুবে থাকা সম্পদের দিকে বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর চোখ পড়ছে। সত্যিকার অর্থেই সমুদ্র থেকে প্রাপ্ত সম্পদের প্রাপ্যতা ও তার সঠিক ব্যবহারের ওপরেই ভবিষ্যৎ অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি অনেকাংশে নির্ভর করছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ মোকাবিলা করা পৃথিবীর জনবহুল দেশগুলোর জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিপুল পরিমাণ অতিরিক্ত সম্পদ এসব ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে প্রয়োজন হচ্ছে। ভূখণ্ডের কৃষিজমি দখল করে মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজে নিচ্ছে মানুষ। বিপুল সংখ্যক মানুষ উদ্বাস্তু হচ্ছে প্রতি বছর। ফলে কৃষি জমির বাইরে খাদ্যের জন্য মানুষ অনেক আগে থেকেই সমুদ্রনির্ভর হয়েছে। সামুদ্রিক মাছ দেশের বাইরে রপ্তানি করে ও সামুদ্রিক প্রাণী শিকার করে তা দেশের বাজারে বিভিন্ন উপকরণ তৈরি করে বিক্রি করে অর্থনীতির চাকা গতিশীল রাখা হচ্ছে। এখানেই ব্লু ইকোনোমির ধারণা আরও জোরদার হচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বে ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের কর্মকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে সমুদ্র ঘিরে। বিশ্বের ৪৩০ কোটি মানুষের ১৫ থেকে ১৬ শতাংশ প্রোটিনের জোগান দিচ্ছে সামুদ্রিক মাছ ও উদ্ভিদ। ৩০ ভাগ জ¦ালানি তেল ও গ্যাস আসছে সাগর থেকেই। এই বিশাল সমুদ্রে বাংলাদেশেরও সম্ভাবনা রয়েছে। ২০১২ সালে আন্তর্জাতিক শালিশি আদালতের রায়ের মাধ্যমে মিয়ানমারের সঙ্গে মামলায় প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারেরও বেশি সমুদ্র এলাকার দখল পায় বাংলাদেশ, যা আরেকটি বাংলাদেশের সমান। এর পর মিয়ানমারের সঙ্গে মামলায় নতুন সমুদ্রসীমা অর্জনের দুই বছর পর ২০১৪ সালে বাংলাদেশে ও ভারতের মধ্যেকার বিরোধপূর্ণ সমুদ্রসীমার আনুমানিক ২৫ হাজার ৬০২ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে ১৯ হাজার ৪১৭ বর্গকিলোমিটারের অধিকার পায় বাংলাদেশ। এর পর থেকেই সমুদ্র ঘিরে স্বপ্ন গড়ে ওঠে। কাজও এগিয়ে চলেছে। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা ও প্রস্তুতিতে আরও সময় প্রয়োজন। সমুদ্রের অফুরন্ত সম্পদ আহরোণ করা উন্নত দেশের লক্ষ্যে একান্ত প্রয়োজন। এখান থেকে সি ফুডের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, বর্তমানে বছরে ৫০০ মিলিয়ন ডলালের প্রায় ৩০ হাজার মেট্রিক টন সি-ফুড বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। দেশের সমুদ্র অর্থনীতিকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে সক্ষম হলে আগামী ৫ বছর পর সি-ফুড রপ্তানি করে প্রতি অর্থবছরে ৫ বিলিয়ন ডলার আয় করা সম্ভব। পৃথিবীর জনসংখ্যা বাড়ছে। সেই বর্ধিত জনসংখ্যার সঙ্গে বৈশ্বিক খাদ্য চাহিদা পূরণ করতে হলে সি-ফুডের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। তাছাড়া পুষ্টির চাহিদা পূরণেও সি-ফুডের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। পৃথিবীর অধিকাংশ অংশই এই সুবিশাল সমুদ্র। আমাদের দেশের দক্ষিণে বিশাল সমুদ্র এলাকা ঘিরে এখন নতুন স্বপ্ন জেগে উঠেছে। অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে এই জলরাশির রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। যাতে করে আমাদের সম্ভাবনাময় অর্থনীতি আরো শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। পাল্টে যেতে পারে দেশের অর্থনীতির সামগ্রিক চিত্র। কিন্তু এই নীল জলরাশির যে অফুরন্ত সম্পদ রয়েছে তা অনেকের কাছেই বহুবছর অজানা ছিল। এই সমুদ্র ঘিরে প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। কলম্বাস থেকে শুরু করে সুম্রদের বুকে নিশানা টানিয়ে আবিষ্কারের নেশায় ছুটে বেড়িয়েছে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চিন্তাধারায় পরিবর্তন ঘটতে লাগল। সমুদ্র যে সম্পদে পরিপূর্ণ তা বুঝতে শিখল। অর্থনীতির উন্নয়নে সমুদ্রের বিশাল জলরাশির যে ভূমিকা আছে মানুষ তা জানে। আর জানে বলেই এক দেশ অন্য দেশের সঙ্গে সমুদ্রে আধিপত্য নিয়ে যুদ্ধ বা যুদ্ধ হুমকিতে জড়াচ্ছে। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। চীন বা জাপানের মতো বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলো আরও দুই তিনশ বছর আগে থেকেই সমুদ্র নির্ভর কর্মকান্ড এগিয়ে নিয়ে গেছে। অনেক দেশের সিংহভাগ জাতীয় আয়ই আসে সমুদ্র নির্ভর অর্থনীতি থেকে। বাংলাদেশের মৎস সম্পদের একটি বড় অংশই সমুদ্র থেকে আসে। যদিও উপকূল থেকে মাত্র ৫০ মিটার গভীর পর্যন্ত মাছ ধরার সামর্থ্য রয়েছে বাংলাদেশের। সেই সাথে সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকাও সমুদ্রের ওপরই সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল। বহু বছর ধরেই এসব জনগোষ্ঠী নৌকায়, ট্রলারে মাছ ধরে, জাল বুনে, মুক্তা ও চিংড়ি চাষ করে, লবণ শিল্প গড়ে তুলে আমাদের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। আমরা যদি আমাদের সমুদ্র ভিত্তিক অর্থনীতিকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারি তাহলে দেশের টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা এবং জাতীয় আয়কে আরও সমৃদ্ধ করা যেতে পারে। সেভ আওয়ার সি এর দেওয়া তথ্যে জানা যায়, বর্তমানে বঙ্গোপসাগরে প্রতি বছর ৮ মিলিয়ন টন মাছ ধরা পরে। এর মধ্যে ০.৭০ মিলিয়ন টন মাছ বাংলাদেশের মৎসজীবীরা আহরণ করে। নানা প্রজাতির মাছ ছাড়াও সমুদ্রসীমায় নানা ধরনের প্রবাল, গুল্মজাতীয় প্রাণী, ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি, তিন প্রজাতির লবষ্টার, ২০ প্রজাতির কাঁকড়া এবং ৩০০ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক পাওয়া যায়। উপকূলীয় উঞ্চলের ৫ লক্ষাধিক জেলের জীবন-জীবিকার যোগন আসে সমুদ্র থেকেই। লোনা পানির বিপুল পরিমাণ মৎস্য সম্পদ আহরোণ অনেক আগে থেকেই করে আসছে। তবে এ পরিমাণ অনেক অনেক কম। উন্নত প্রযুক্তি ও জাহাজের অভাবে অনেক সামুদ্রিক অনেক গভীর এলাকা থেকে মৎস্য আহরোণের পরিমাণ অনেক কম। এখন মানুষ জানতে পেরেছে রহস্যময় এ বিশাল জলরাশির ভেতর লুকিয়ে আছে ভবিষ্যত পৃথিবীর শক্তির অফুরন্ত উৎস। জ্বালানি তেল, গ্যাস এসব প্রাকৃতিক সম্পদ পৃথিবীর ভূখণ্ডের থেকেও বিপুল পরিমাণ সঞ্চিত রয়েছে সমুদ্র বক্ষের নিচে। রয়েছে বৈচিত্র্যময় জীববৈচিত্র্য, আগ্নেয়গিরি, পাহাড়-পর্বত। মানুষের চাহিদা মেটানোর সব উপকরণ সেখানে আছে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ২০৫০ সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা হবে ৯০০ কোটি। তখন বিপুল এ জনগোষ্ঠীর খাদ্যের জোগান দিতে সমুদ্রের মুখাপেক্ষী হতেই হবে। বর্তমানেই ৪৩০ কোটি মানুষের ১৫ ভাগ প্রোটিনের জোগান দিচ্ছে সমুদ্র। ভবিষ্যতে এই সংখ্যা আরও বাড়বে সন্দেহ নেই। কারণ স্বাদু প্রাণীর মাছের সংখ্যা কমছে। কারণ জনবসতি বাড়ছে। আর এ অতিরিক্ত মানুষের জায়গা করতে গিয়ে ভরাট হচ্ছে স্বাদু পানির বিভিন্ন উৎস। ভরাট হচ্ছে নদী। বাধ দিয়ে নদীকে মৃত বানানো হচ্ছে। নদী ভরাট করে গড়ে উঠছে স্থাপনা। তাছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দূষণের কারণে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে অনেক নদী। পৃথিবীর ৩০ ভাগ গ্যাস ও জ্বালানি তেল সরবরাহ হচ্ছে সমুদ্রতলের বিভিন্ন গ্যাস ও তেলক্ষেত্র থেকে। তাই তো বিশ্বের সব দেশের নজর এখন সমুদ্রের দিকে। স্থল ও আকাশে সামরিক শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি সমুদ্রে সক্ষমতা প্রমাণে উঠে পরে লেগেছে সব দেশ। নিজ সামদ্রিক সীমানা দখলে রাখতে মোটা অঙ্কের বাজেট তৈরি করছে। দেশের অর্থনৈতিক শক্তির ভবিষ্যৎ আধার সমুদ্রকে গুরুত্ব দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। ব্লু ইকোনমি ক্রমেই প্রতিটি দেশের কাছে জনপ্রিয় হচ্ছে। অধিকাংশ জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক সম্মেলনেই ব্লু ইকোনমি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে এর গুরুত্বই পৃথিবীর কাছে আলোচনার বিষয়বস্তু করে তুলেছে। ছোট-বড় সব দেশই এখন তাদের অর্থনীতি শক্তিশালী করতে সমুদ্রের ওপর জোর দিচ্ছে। অন্যসব দেশগুলোর মতো আমাদের চিন্তাভাবনাও আবর্তিত হচ্ছে কীভাবে সমুদ্র থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা আদায় করা যায়। স্থলভাগে প্রাপ্ত প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুত দ্রুতই নিঃশেষ হয়ে আসছে। কিন্তু আমাদের শক্তির প্রধান উৎস প্রাকৃতিক গ্যাস। তাই সমুদ্র এলাকায় গ্যাসের মজুত চিহ্নিত পূর্বক গ্যাস আহরোণের চেষ্টা করা হচ্ছে। যদিও প্রযুক্তি এখন পর্যন্ত আমাদের প্রধান বাধা।

ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ সমুদ্র অংশে কী পরিমাণ মৎস্য সম্পদ, খনিজ সম্পদ ও অন্যান্য কী ধরনের সুযোগ-সুবিধা রয়েছে, তা কর্তৃপক্ষ যাচাই করছে। আমাদের দেশের সমুদ্রনির্ভর অর্থনীতিতে ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও আমাদের পর্যাপ্ত দক্ষ জনবল এবং প্রযুক্তি না থাকায় আমরা সেই বিপুল সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারছি না। অথচ এই সমুদ্রকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বের অনেক দেশ আজ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে তুলছে। এক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতাও দায়ী। প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ এক্ষেত্রে জরুরি। সম্ভাবনাময় এই ক্ষেত্রের সঠিক ব্যবহারকে নিশ্চিত করতেই হবে।