ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ভরা মৌসুমে ইলিশ নেই

জলবায়ু পরিবর্তনের অনিবার্য পরিণতি
ভরা মৌসুমে ইলিশ নেই

ইলিশের ভরা মৌসুমে নদনদী ও সাগরে ইলিশ নেই। সে কারণে বাজারেও ইলিশের সরবরাহ কম। আর সেই সুযোগটি কাজে লাগাচ্ছেন এক শ্রেণির ব্যবসায়ী। ১৬শ’ থেকে ২ হাজার টাকা ইলিশের কেজি। একজন সাধারণ ক্রেতার পক্ষে এক কেজি ইলিশ কিনে সন্তানের মুখে তুলে দেয়ার সামর্থ্য নেই বললেই চলে। সারা বছর ইলিশের দাম বেশি থাকে। মানুষ আশা করে শ্রাবণ মাসে অবিরাম বৃষ্টি হলে নদনদী ও সাগরে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়বে। বাজারে প্রচুর ইলিশ উঠবে। আর তুলনামূলক কম দামে ইলিশ কিনে নানা উপাদেয় খাবার তৈরি করা হবে। কাছের আত্মীয়স্বজনকে দাওয়াত দিয়ে ‘সর্ষে ইলিশ’ কিংবা ‘ইলিশ পোলাও’ খাওয়ানোর লোভ অনেকে লালন করেন। কিন্তু এ বছর সেই সুযোগটি এখনো আসেনি। এবারের বর্ষা মৌসুমে আর আসবে কি-না- সেটাও অনিশ্চিত। যদি সেই সুযোগটি আর না আসে তা হলে সেটা হবে দুর্ভাগ্য।

আমাদের এই পরিণতির জন্য আর কেউ দায়ী নয়। দায়ী হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব। চলতি বছর বিশেষ করে সদ্য সমাপ্ত মাসটি ছিল বিশ্বে ১ লাখ ২০ হাজার বছরের মধ্যে সবচেয়ে উষ্ণতম মাস। ইউরোপ-আমেরিকায় একদিকে চলছে তাপপ্রবাহ অন্যদিকে চলছে দাবানল। আর আমরা যারা দক্ষিণ এশিয়ার বাসিন্দা, তারা গরমে অস্থির হয়ে পড়েছি। নানা কারণে আজ নদী ও সাগর ইলিশশূন্য হয়ে পড়েছে। শুধু যে এ বছরই ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না, তা নয়। গত দুই-তিন বছর ধরেই উপকূলীয় এলাকার নদনদীতে প্রত্যাশা অনুযায়ী ইলিশ মিলছে না। জেলেরা বলছেন, বন্দরগুলোর আড়তে নেই কাঙ্ক্ষিত ইলিশের সরবরাহ। মৎস্যবিজ্ঞানীরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নদীতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, অনাবৃষ্টি, বর্জ্য থেকে পানিদূষণ, নির্বিচারে জাটকা নিধন ও ইলিশের অভয়াশ্রমের প্রবেশপথ ভরাট হয়ে যাওয়াই ভরা মৌসুমে ইলিশের দেখা না মেলার মূল কারণ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সংলগ্ন সমুদ্রে দীর্ঘ ডুবোচর থাকায় রামনাবাদ, আগুনমুখা, আন্ধারমানিক ও বলেশ্বর নদীর মোহনায় ইলিশের আনাগোনা কমে গেছে। বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ইলিশ সবসময় ঝাঁকে চলে। চলার পথে বাধা পেলে সেখান থেকেই ফিরে যায়। ফলে সাগর থেকে নদীতে প্রবেশমুখে ডুবোচরে বা কোনো বাঁকে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে ইলিশের ঝাঁক বাধাপ্রাপ্ত হলে আর ভেতরে প্রবেশ করে না। ফলে জেলেদের জালে ইলিশ ধরা পড়ছে না। জেলেরা বলছেন, প্রতি বছর অক্টোবর মাসে গভীর সাগর থেকে মা ইলিশ ডিম ছাড়তে নদীর মিঠা পানিতে ছুটে আসে। তার পর ইলিশের পোনা উপকূলীয় নদনদী ও পদ্মা-মেঘনায় বিচরণ করে। এ সময় তাদের আকার বাড়তে থাকে। শুধু মার্চ ও এপ্রিল- এ দুই মাস জাটকাকে সুরক্ষা দিতে সব ধরনের মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা হয়। সাধারণত বৈশাখ মাস থেকেই শুরু হয় ইলিশের মৌসুম। এ সময় জেলেদের জালে ধরা পড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ। কিন্তু এবার এর ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হচ্ছে।

ইলিশের প্রজনন মৌসুম উপলক্ষে গত ১৯ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিন সাগরে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা প্রতিপালিত হয়। নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও সাগরে প্রত্যাশা অনুসারে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না। অগভীর সমুদ্রে জালে মাঝারি ও ছোট আকারের ইলিশ ধরা পড়লেও তা পরিমাণে কম। প্রত্যাশা অনুযায়ী বড় আকারের ইলিশ ধরা পড়ছে না। গভীর সমুদ্রে বড় ফিশিং ট্রলারেও ইলিশের দেখা মিলছে না। শ্রাবণের ভরা মৌসুমে সব নদী পানিতে টইটম্বুর। তারপরও জেলেদের জালে ইলিশ ধরা না পড়াটা অনেকটাই হতাশার। ইলিশকেন্দ্রিক বাণিজ্য মূলত এই সময়টাতেই জমে। তা না হলে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যবসায়ী, আড়তদার ও জেলেদের আর্থসামাজিক অবস্থার ক্ষেত্রে নেতিবাচক পরিবর্তন আসবে।

মৎস্য গবেষকদের মতে, সরকার ইলিশ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে এসব পদক্ষেপে ফলাফল আসছে না। অসাধু জেলেরা নির্বিচারে ইলিশের পোনা নিধন করছে। এ কারণে ইলিশের উৎপাদন কমেছে। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যা তো আছেই। মা ইলিশ রক্ষা এবং জাটকা যদি বাঁচানো যায়, তাহলে এই পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হতে পারে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত