এমনিতেই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলাফলস্বরূপ বৈশ্বিক আবহাওয়ার অস্বাভাবিক আচরণ দেখছে বিশ্ব। মরুভূমির উত্তপ্ত বালুতে যেখানে এক ফোঁটা পানির জন্য হাহাকার করতে হতো, সেই মরুর বুকে বৃষ্টি আর সবুজের চিত্র ফুটে উঠেছে। অপরদিকে বছরের অধিকাংশ সময়ে ঠান্ডা থাকা ইউরোপে দেখা যাচ্ছে বিপরীত চিত্র। অত্যধিক তাপমাত্রায় যুক্তরাজ্যের রাস্তার সিগন্যাল বাতি গলে যাওয়ার ছবি ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত জাতিসংঘের আন্তসরকার প্যানেল (আইপিসিসি) তাদের সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলেছে, বৈশ্বিক তাপমাত্রা এখনই কমানো না গেলে খুব দ্রুতই বিশ্বকে মারাত্মক পরিণতি ভোগ করতে হবে। শুধু শীতপ্রধান ইউরোপই নয়, বৈশ্বিক উষ্ণতায় পুড়ছে পুরো পৃথিবী। বহু বছর ধরেই জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে মেরু অঞ্চলে বরফ গলা ও সাগরের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার সংবাদ প্রকাশিত হলেও বা পরিবেশবাদীদের ক্রমাগত উদ্বেগ প্রকাশ করা সত্ত্বেও দিন দিন বেড়ে চলছে দূষণ। চরম আবহাওয়া পরিস্থিতিতে ইউরোপে গত ৪০ বছরে মারা গেছেন প্রায় ১ লাখ ৯৫ হাজার মানুষ। শুধু প্রাণহানিই নয়, এ কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে ৫৬০ বিলিয়ন ইউরোর বেশি। বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে একদিকে যেমন শীতের সময়কাল কমে আসছে অন্যদিকে দীর্ঘ হচ্ছে গ্রীষ্ম ও তীব্র হচ্ছে গরম। এছাড়া, ৫৬০ বিলিয়ন ইউরোর আর্থিক ক্ষতির মাত্র ১৭০ বিলিয়ন ইউরোর ইন্স্যুরেন্স ছিল। সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, তাপপ্রবাহের কারণে ৮১ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে। এ কারণে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১৫ শতাংশ। গত বছরের জুলাইয়ে মারা গেছেন ৫৩ হাজার মানুষ। মাসভিত্তিক গড় হিসাবে ২০১৬-১৯ সালের তুলনায় তা ১৬ শতাংশ বেশি। তবে সব মৃত্যুই সরাসরি তাপপ্রবাহের সঙ্গে যুক্ত নয় বলেও জানানো হয়েছে। স্পেনে তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে গত জুন, জুলাই ও আগস্টে ৪ হাজার ৬০০’র বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০২২ সালে মরুকরণের ঝুঁকি ৫ থেকে ৬ গুণ বেড়েছে। একই বছরে দাবানলে সাম্প্রতিক বছরগুলোর তুলনায় দ্বিগুণ পরিমাণ বনাঞ্চল ধ্বংস হয়েছে। ইইউর বিশেষজ্ঞ আলেক্সান্ডার কাজমিয়েরকজাক বার্তাসংস্থা এএফপিকে বলেন, আরো ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে জরুরিভিত্তিতে চরম আবহাওয়ার কারণে সৃষ্ট বিপর্যয়গুলো মোকাবিলা করতে হবে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়, তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে গত এপ্রিলে ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী দেশ স্পেন, মরক্কো ও আলজেরিয়া এবং পার্শ্ববর্তী দেশ পর্তুগালে খরায় ফসল পুড়ে যায় এবং অনেক জলাধার শুকিয়ে যায়। বিজ্ঞানীদের মতে, বৈশ্বিক উষ্ণতা ছাড়া এমন চরম পরিস্থিতি প্রাকৃতিকভাবে ঘটতে পারে ৪০ হাজার বছরে মাত্র একবার। প্রভাবশালী সাময়িকী ফরেন পলিসির এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনের শিরোনাম করা হয়, যে ভূমধ্যসাগরকে আমরা চিনি তা হারিয়ে যাচ্ছে। এতে আরো বলা হয়, সবুজ বেলাভূমি ও আনন্দদায়ক বাতাসের জন্য খ্যাত ভূমধ্যসাগরের উপকূল চরম আবহাওয়ার কারণে শিরোনাম হচ্ছে। দুর্বিষহ গরম, দাবানল ও শুকিয়ে যাওয়া নদীর জন্য পরিচিত হয়ে উঠছে এই অঞ্চলটি। গত বছর স্পেন ও পর্তুগাল ১ হাজার বছরের বেশি সময়ের মধ্যে সবচেয়ে শুষ্ক আবহাওয়ায় পড়েছিল। গরম থেকে বাঁচতে গ্রিস ও ফ্রান্স থেকে হাজার হাজার মানুষ ঘর ছেড়েছিলেন। সে সময় স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ বলেছিলেন, দেখতে পাচ্ছি, জলবায়ু পরিবর্তন মানুষ হত্যা করছে। আমাদের জীব বৈচিত্র্য ও বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস করছে। আমাদের ঘরবাড়ি, ব্যবসা, খামার নষ্ট করে দিচ্ছে। পৃথিবীর অন্যতম শীতল অঞ্চল রাশিয়ার সাইবেরিয়াও তাপপ্রবাহ থেকে মুক্তি পাচ্ছে না। পরিবেশবিষয়ক সাময়িকী নেচারের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়, সাইবেরিয়ায় বর্তমানের গরম গত ৭ হাজার বছরেও দেখা যায়নি। ২০২০ সালের তথ্য দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, সে সময় সাইবেরিয়ার তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছিল। একই সময়ের তথ্য দিয়ে সিএনএন জানায়, বিজ্ঞানীদের ভাষ্য মতে সাইবেরিয়ায় এমন তাপপ্রবাহের পেছনে জলবায়ু সংকট দায়ী থাকার সম্ভাবনা আছে। কেননা, মানুষের কারণে জলবায়ু পরিবর্তন না হলে আর্টিক অঞ্চলে এমন পরিবর্তন দেখা যেতে পারে প্রতি ৮০ হাজার বছর পর পর। গত গ্রীষ্মে উত্তর আমেরিকা থেকে ইউরোপ হয়ে চীন পর্যন্ত বিস্তৃত উত্তর গোলার্ধ খরায় কেটেছে। এর ফলে ফসলহানি, পানির সংকট ও দাবানল দেখা গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমাঞ্চলে পানির স্তর নেমে যাওয়ায় খরা দেখা দিয়েছে। গরমের কারণে চীন ও ইউরোপে কয়েক হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট চরম আবহাওয়ার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো উত্তর গোলার্ধের গত বছরের গ্রীষ্ম। এই তাপপ্রবাহ দীর্ঘ সময় বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে অবস্থান করেছিল। বিশ্বের সবচেয়ে দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চল আফ্রিকার শিং হিসেবে খ্যাত পূর্ব আফ্রিকায় গত টানা ৩ বছর ধরে খরা চলছে। ফলে, সেই অঞ্চলে সোমালিয়া, ইথিওপিয়া ও কেনিয়ার বিস্তৃত এলাকায় ফসলহানির পাশাপাশি পানির তীব্র সংকট চলছে। গবাদিপশুগুলো খাবারের অভাবে শুকিয়ে মরছে। এই খরাকে গত ৪০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ হিসেবে উল্লেখ করে সিএনএন জানায়, এর প্রভাব মানুষের ওপর চরমভাবে পড়ছে। সেখানে মারা গেছেন অন্তত ৪০ হাজার মানুষ। এছাড়া, ২ কোটি মানুষ পড়েছেন তীব্র খাদ্য সংকটে। সোমালিয়ার অর্ধেক মানুষ খরাপীড়িত। ৩০ লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, খরার কারণে আফ্রিকার পূর্বাঞ্চলে ৫ কোটি মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
বিস্তৃত পরিসরে আরো ১০ কোটি মানুষের ক্ষতি হচ্ছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর ওপর দিয়ে যে তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে তা ২০০ বছরে একবার দেখা যায় বলে জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম সিএনএন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তা প্রায়ই দেখা যাবে বলেও এতে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। রেডিও ফ্রি এশিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়, রেকর্ড ভাঙা গরমে অতিষ্ঠ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জনজীবন। গরমের কারণে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। অনেককে হাসপাতালে ভর্তি করা হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হচ্ছে। কৃষকরা ক্ষেতে যেতে পারছেন না। ব্যবসায়ীরা আর্থিক ক্ষতিতে পড়ছেন। এই রেকর্ডগড়া গরমের কারণে থাইল্যান্ড, চীন ও দক্ষিণ এশিয়ায় সাধারণ মানুষকে আরো অনেক বছর স্বাস্থ্যগত সমস্যায় ভুগতে হবে। এটি জনজীবনকে হুমকিতে ফেলেছে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, বিশেষ করে দরিদ্র মানুষকে ভুগতে হবে সবচেয়ে বেশি। এ বছর ভিয়েতনামে গরম ৪৪ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়। মিয়ানমারের মধ্যাঞ্চলীয় মাগওয়ে অঞ্চলে তাপমাত্রা ছিল ৪৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শুধু তাই নয়, এ বছর পর্যটনসমৃদ্ধ থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। লাউসের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪৩ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দক্ষিণ এশিয়ার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া তাপপ্রবাহ, বিশেষ করে বাংলাদেশে গরমের কথা পাঠকদের কাছে বিশেষভাবে তুলে ধরা বাহুল্যই বটে। বিশ্লেষকদের বরাত দিয়ে সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারত ও বাংলাদেশে যে তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে হয়তো মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তা অন্তত ৩০ গুণ বেড়ে এমনটি হয়েছে। অর্থাৎ, কল-কারখানার ধোঁয়া, বনাঞ্চল উজাড়সহ মানবসৃষ্ট দূষণ না হলে এমনটি হতো না। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, দেশটির কয়েকটি অঞ্চলের ওপর দিয়ে গত এপ্রিলে ২৪ দিন ও মে মাসে ২২ দিন তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে।
শুধু তাই নয়, এই ২ মাসে দেশটিতে গড় বৃষ্টি ছিল ৩০ বছরের মধ্যে কম। ভারতের তাপপ্রবাহ নিয়ে গত ৩০ মে জার্মানির গণমাধ্যম ডয়চে ভেলের এক প্রতিবেদনের শিরোনাম করা হয়, ভারতের তীব্র তাপপ্রবাহ অবর্ণনীয় কষ্টের কারণ হয়েছে। এ বছর ভারতের কোনো কোনো অঞ্চলে পারদ উঠেছিল ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। বিশেষজ্ঞরা দুর্বল জনগোষ্ঠীদের জরুরিভিত্তিতে রক্ষার আবেদন করেছিলেন। পাকিস্তানে তীব্র গরমের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৪ জুন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল দেশটির জনগণকে রক্ষার আবেদন করে। সংস্থাটির প্রতিবেদনে দক্ষিণ এশিয়ার সংকটপীড়িত দেশটির জনগণের স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগও প্রকাশ করা হয়। গত এপ্রিলে দ্বীপদেশ শ্রীলঙ্কার অধিকাংশ অঞ্চল তীব্র তাপপ্রবাহে পুড়েছিল বলে জানা যায়। জাতিসংঘের ওয়েবসাইটে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ ও প্রভাব শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে-জীবাশ্ম জ্বালানি তথা তেল, গ্যাস ও কয়লাকে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারণ বলা যেতে পারে। কেননা, বিশ্বব্যাপী গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের ৭৫ শতাংশ ও কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণে এগুলোর অবদান ৯০ শতাংশ। এতে আরো বলা হয়, গ্রিনহাউজ গ্যাসগুলো পৃথিবীকে চাদরের মতো মুড়িয়ে রাখে বলে সূর্যের তাপ বায়ুমণ্ডলে আটকে যায়। ফলে পৃথিবীতে তাপমাত্রা বেড়ে যায় এবং জলবায়ুর পরিবর্তন দেখা দেয়। ইতিহাসের মধ্যে পৃথিবীর তাপমাত্রা এখন যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি বেড়ে যাচ্ছে। এটি প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করছে। মানবজাতিসহ পুরো প্রাণিজগতের অস্তিত্ব হুমকিতে ফেলেছে। মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যদিও এর আগের জলবায়ু পরিবর্তনের পেছনে সূর্যের অবদান ছিল কিন্তু তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে যে, চলমান জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সূর্যকে দায়ী করা যায় না।
বাংলাদেশ নাতিশীতোষ্ণ তাপমাত্রার দেশ হিসেবে পরিচিত হলেও বিগত কয়েক বছরে তাপমাত্রার অস্বাভাবিক আচরণে সেই পরিচিতি ম্লান হয়ে যাচ্ছে। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে কৃষিভিত্তিক উৎপাদনের জন্য যেখানে ছিল যথাযোগ্য তাপমাত্রা, ছিল ছয়টি আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত ঋতু, সেখানে দিন দিন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঋতু হারিয়ে যেতে বসেছে এবং তার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা সবকিছুতে আমূল পরিবর্তন আসছে। ফলে অনিয়মিত, অপর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত, সেচের পানির অপর্যাপ্ততা, উপকূলীয় অঞ্চলে বর্ষা মৌসুম ছাড়াও বিভিন্ন সময় উপকূলীয় বন্যা ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে লবণাক্ত পানিতে জমি ডুবে যাওয়া এবং শুষ্ক মৌসুমে মাটির নিচের লবণাক্ত পানি উপরের দিকে বা পাশের দিকে প্রবাহিত হওয়ার মতো নানাবিধ সমস্যায় বাংলাদেশের কৃষির ভবিষ্যৎ চরম হুমকির মুখে পড়বে বলে বিশেষজ্ঞ মহলের অভিমত।