ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বঙ্গবন্ধু শুধু একটি নাম নয়, একটি ইতিহাস

সুমনা গুপ্তা
বঙ্গবন্ধু শুধু একটি নাম নয়, একটি ইতিহাস

‘আমি হিমালয় দেখিনি, শেখ মুজিবকে দেখেছি’ কথাগুলো আমার নয়। বলেছিলেন কিউবার অবিসংবাদিত বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ট্রো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শারীরিকভাবেও ছিলেন বিশালাকায়। গড়পড়তা বাঙালিদের চেয়ে ছিলেন বেশি উচ্চতার। আর তার প্রবল ব্যক্তিত্ব ছিলো হিমালয়ের চেয়েও বিশাল। যে ব্যক্তিত্বের সামনে মাথা নত করতে হয়েছিল প্রবল প্রতাপশালী পাক জেনারেলদেরও। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু একটি নাম নয়, একটি ইতিহাস। যে ইতিহাস রচনা করেছে হাজার বছরের শৃঙ্খল মোচনের এক অমর মহাকাব্য। তিনি প্রজ্বলিত এক নক্ষত্র, অগনিত মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার এক প্রস্ফুটিত গোলাপ। বাঙালি বিশ্বের যেখানেই থাকুক না কেন- তার আত্মপরিচয়ের ঠিকানা, অহংকারের সাতকাহন, আত্মমর্যাদার প্রতীক- জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। বঙ্গবন্ধু বাঙালির চেতনার রাজ্যে মুকুটহীন রাজা, অপ্রতিদ্বন্দ্বী, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। এ দেশের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে জাজ্বল্যমান যে নামটি, তিনি হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। ২৩ বছরের গোলামীর জিঞ্জির ভেঙে তার ডাকেই ঘরে ঘরে গড়ে উঠেছিল দুর্গ। হাজার হাজার মাইল দূরের পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থেকেও তিনি ছিলেন মুক্তিসেনাদের ট্রেনিং ক্যাম্প আর শরণার্থীদের রিফিউজি ক্যাম্পের মানুষগুলোর হৃদয় মাঝে ভাস্বর হয়ে। তার নামেই উজ্জীবিত হয়ে জীবন বাজি রেখে এক মুহূর্তের জন্যও কুণ্ঠিত হয়নি বাঙালি। সেই উজ্জীবনাকে জাগিয়ে রাখতেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বার বার শব্দসৈনিকদের কণ্ঠে ঘোষণা ভেসে আসত, ‘বঙ্গবন্ধু আমাদের সঙ্গেই আছেন।’ যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এই গানটি হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধার প্রাণে শক্তির সঞ্চার করেছিল- ‘শোনো, একটি মুজিবরের থেকে/লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি/আকাশে-বাতাসে ওঠে রণি/বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ’। এই গানটি প্রেরণা জোগাত, আশার সঞ্চার করত মুক্তিকামী বাঙালির হৃদয়ে। প্রশিক্ষণ শিবিরে গেরিলারা হাতিয়ার তুলে বজ্রনিনাদে স্লোগান তুলতেন, ‘তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব, মহান জাতির মহান নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব’ অবস্থা এরকম চরম বিপরীতে চলে যাবে তা জল্লাদ ইয়াহিয়ার মতো মানুষও ধারণা করতে পারেননি, শেখ মুজিবকে ফাঁসি দিলে পূর্ববাংলার আপামর জনগণের বর্তমানের শান্ত পরিস্থিতি তো উত্তেজিত হবেই। বাঙালির চিন্তার জগতে, ভাবনার ভূবনে, মেধার উৎকর্ষে, কিংবা ভরসার আশ্রয়স্থল হিসেবে- সবস্থানেই খুঁজে পায় বঙ্গবন্ধুর বিশাল ব্যক্তিত্বকে। আর এরই ধারাবাহিকতায়, ৫২-এর টগবগে তরুণ মুজিব ৬৬ বা ৬৯ ছাড়িয়ে এ হয়ে যান বঙ্গবন্ধু, ৭১-এর ৭ মার্চে হ্যামিলনের বংশীবাদক, ২৫ মার্চের ঘোর অন্ধকারে এক জাদুকর। বঙ্গবন্ধুর ডাকে হাজার হাজার নিরস্ত্র জনতা ঝাঁপিয়ে পড়ে সশস্ত্র হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর ট্যাংকের সামনে, অবুঝ কিশোর তাজা রক্তের অক্ষরে লিখে যায় মাতৃভূমির রক্তঋণ শোধ করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা, কিংবা অশ্রুসজল জননী প্রাণপ্রতিম সন্তানকে মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়ে দেন অবলীলায়।

আবালবৃদ্ধ-বণিতা লিপ্ত হয়ে পড়ে সর্বাত্মক এক জনযুদ্ধে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন পরাধীন বাংলার রাজনৈতিক আকাশের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামের মহানায়ক, বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি, ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, বিশ্বনন্দিত নেতা। মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ ডামাডোল আর ধ্বংস স্তূপের মাঝে দাঁড়িয়েও বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান লেখক অন্নদাশঙ্কর রায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যথার্থই বলেছিলেন, ‘যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান/ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান। /দিকে দিকে আজ অশ্রুগঙ্গা রক্তগঙ্গা বহমান/তবু নাই ভয় হবে হবে জয়, জয় মুজিবুর রহমান।’ স্বাধীনতার পর পাক-হানাদার বাহিনীর বন্দিশালা থেকে ফিরে বঙ্গবন্ধু প্রথম যে দিন স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখলেন, তিনি সেদিন তার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলা, মাটি ও মানুষ, রক্ত ও লাশের স্তূপ দেখে নিজেকে সংবরণ করতে পারেননি। তিনি কেঁদেছিলেন। দিনটি ছিল ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। তার বুকে ছিল এক সাগর ভালোবাসা। অশ্রু ঝরছিল সেদিন এই স্বাধীন বাংলাদেশ দেখে যা তার বুকের গভীরে আঁকা ছিল। প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধু আমাদের অনুভূতি ও অন্তর আত্মায় মিশে আছেন। শেখ মুজিব মানেই বাংলাদেশ। শেখ মুজিব মানেই স্বাধীন বাংলাদেশ। জাতির পিতার প্রতি আমাদের ঋণ, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা অশেষ। শেখ মুজিব মানেই বাংলার মুক্ত আকাশ। শেখ মুজিব মানেই বাঙালির অবিরাম মুক্তির সংগ্রাম। কিন্তু এই বঙ্গবন্ধুই সপরিবারে নিহত হয়েছিলেন পঁচাত্তরের পনের আগস্ট দেশি-বিদেশি চক্রান্তের শিকার হয়ে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্যের হাতে। মুজিব কেবল মাত্র লোক চক্ষুর সামনে থেকে অদৃশ্য হয়েছেন, হারিয়ে যায়নি। হারাতে পারেন না কখনো। অলিতে-গলিতে, আকাশে-বাতাসে, চলাচলে সবখানে সবকিছুই জানান দিচ্ছে মুজিব আছে। মুজিব আছে প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ের আসনে। আজ এত বছর পরেও রাস্তা-ঘাট মানুষের এত স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ জানান দিয়ে যায় মুজিব এদেশের মানুষের অন্তরে কীভাবে গেঁথে রয়েছে। সমগ্র পৃথিবী অবাক হয়েছিল পঁচাত্তরের পনের আগস্ট, কারণ যে মুজিবকে হত্যার সাহস করেনি পাকিস্তান, সে বাঙালিপাগল মুজিব প্রাণ দিয়েছে তারই বাঙালির হাতে। প্রাণ দিয়েছে তার পুরো পরিবার, আত্মীয়-স্বজনসহ প্রায় ২৯ জন মানুষ সবাই। নিজের রক্তের সঙ্গে বিশ্বাস ঘাতকতার জন্য হয়তো ইতিহাস কখনোই বাঙালি জাতিকে ক্ষমা করবে না। একাত্তরে যে বীর বাঙালি শব্দটি উচ্চারিত হতো, পচাত্তরের ১৫ আগস্টের পরে এর পাশে কলংকিত ‘বেঈমান’ শব্দটি সংযোজিত করেছে ঘাতক মোশতাক। পাকিস্তানিদের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করেছিল বেঈমান মোশতাক। ৭১-এর হায়েনা পরাজিত শকুনদের পথ দেখিয়েছে মোশতাক, যারা বাঙালির বিজয়ে গর্তে লুকিয়ে ছিল।

পঁচাত্তরের পনের আগস্ট, শ্রাবণের বৃষ্টির ধারা আর বাঙালির জনকের রক্ত যেন একাকার হয়ে মিশে গিয়েছিল এক লক্ষ সাতচল্লিশ হাজার বর্গ কিলোমিটারে। সেই রক্ত আজো আকাশের মর্মছেঁড়া অশ্রুর প্লাবনে সুর তোলে নতুন করে। আমাদের ভুলতে দেয় না ঘাতকদের উদ্যত অস্ত্রের সামনে ভীতসন্ত্রস্ত বাংলাদেশ বিহ্বল হয়ে পড়েছিল শোকে আর অভাবিত ঘটনার আকস্মিকতায়। পনের আগস্টই মুজিবকে অদৃশ্য করে দিলেও বাঙালি ভোলেনি- এক মুজিব লোকান্তরে, লক্ষ মুজিব ঘরে ঘরে। একই সঙ্গে এই পিতা হারানোর শোক কাল থেকে কালান্তরে বহমান। কবি শামসুর রহমানের কবিতা থেকে বলে শেষ করছি- ‘মুজিব মরে না, মরেনি মুজিব, কোনো বুলেটের ঘায়। বুলেটে পতিত দেহই কেবল, অমর সে আত্মায়।

অবিরাম হেঁটে চলেছে মুজিব রক্তচাদর গায়, মুজিব, মুজিব, জনকের নাম, এতো সহজে কি মোছা যায়? শোকাহত আগস্টে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামের অবিসংবাদিত প্রাণপুরুষ, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাত বার্ষিকীতে তার ও তার পরিবারের সব শহীদদের পূণ্য স্মৃতির প্রতি জানাচ্ছি বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত