খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে কৃষিজমি সুরক্ষার বিকল্প নেই

অলোক আচার্য, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

প্রকাশ : ০৭ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বর্তমান পৃথিবীতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো খাদ্য নিরাপত্তা। যে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা যত শক্তিশালী সেখানে অর্থনৈতিক অবস্থা তত স্থিতিশীল থাকে। বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়। আর খাদ্য উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন কৃষিজমি। সেই কৃষি জমিই কমছে। সেই প্রক্রিয়া আজও চলমান। কৃষি জমি ভরাট করার ব্যাপারে সতর্কতা থাকলেও তা কেউ মানছে না। নিয়মের তোয়াক্কা না করেই এভাবে ভরাট করার ফলে কৃষিজমি কমছে এবং বিপরীতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার দরুণ খাদ্য উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটছে। যদি চাষযোগ্য জমিই না থাকে তাহলে ফসল উৎপাদন হবে কোথায়? শুধু বসতিই নয় সব ধরনের স্থাপনাই হচ্ছে কৃষি জমিতে। একদিকে আমরা চলেছি পুরোপুরি নগরায়ন সভ্যতার দিকে অন্যদিকে হারাচ্ছি কৃষিজমি। বাংলাদেশ আজো কৃষিনির্ভর দেশ। আমরা আজ যে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পেরেছি তা উন্নয়নের অন্যতম শর্ত। কিন্তু এভাবে কৃষিজমি হারাতে থাকলে একসময় খাদ্য উৎপাদনের ঝুঁকিতে পড়তে পরবে। কৃষি জমিতে নতুন নতুন বসতভিটা স্থাপন, রাস্তাঘাট, কল-কারখানাসহ নানা কারণে জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। এর আগে, পরিবেশ অধিদপ্তর আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে, বর্তমান হারে ভূমি অবক্ষয় চলতে থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে কোনো কৃষিজমি থাকবে না। বাংলাদেশে গড়ে প্রতি বছর প্রায় ৬৯ হাজার হেক্টর আবাদি জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। নগরায়ন প্রক্রিয়ায় চাষযোগ্য জমি ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে কৃষিজমির পরিমাণ ছিল ২ কোটি ১৭ লাখ হেক্টর। আর কমতে কমতে বর্তমানে কৃষিজমির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮১ লাখ ৫৮ হাজার হেক্টর। প্রতিদিন কমছে প্রায় ২২০ হেক্টর জমি। গত এক যুগে সারা দেশে নীট আবাদি জমি কমেছে প্রায় ৪ লাখ হেক্টর। প্রতিবছর ৭০ হাজার হেক্টর উর্বর কৃষি আবাদি জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। বর্তমানে প্রতি বছর এক হাজার হেক্টর জমি নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে। নির্মাণকাজে বছরে বিলীন হচ্ছে তিন হাজার হেক্টর জমি। গত ৩৭ বছরে শুধু ঘরবাড়ি নির্মাণ হয়েছে প্রায় ৬৫ হাজার একর জমিতে। অর্থাৎ একদিকে আমরা খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত, অন্যদিকে কৃষিজমি নষ্ট হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে পারছি না। এভাবে কৃষি জমি অকৃষি খাতে চলে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষার জন্য আমাদের একটি পরিকল্পনা করা প্রয়োজন যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকবে স্কুল, কলেজ, রাস্তাঘাট, বাজারসহ সব অবকাঠামো এবং সেইসঙ্গে কৃষি জমি। যেখানে কোনো ধরনের দখল বা নির্মাণ করা হবে না। আমাদের দেশে গ্রামগুলো শহরায়ন প্রক্রিয়া মূলত কয়েক দশক থেকেই শুরু হয়েছে। প্রথম দিকে এর গতি একটু ধীর হলেও গত এক দশকে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। হারিয়েছি বহু নদী, খাল-বিল আর বিনিময়ে পেয়েছি নাগরিক জীবনের কিছু সুবিধা। তাই খুব দ্রুত দৃশ্যপট পাল্টাচ্ছে।

নগর সভ্যতার ছোঁয়ায় আমাদের চেনা পরিচিত গ্রামগুলো তার চেনা দৃশ্য হারাচ্ছে। হারিয়ে গেছে মেঠোপথ। মেঠোপথের পরিবর্তে আজ তপ্ত পিচ ঢালা রাস্তা। সেসব মেঠো পথের ধারে ক্লান্ত পথিকের গা জুড়ানোর জন্য বটগাছ থাকত। এখন আর এসব বটগাছ চোখে পড়ে না। কান জ্বালানো ভু ভু জোলার শব্দে রাখালের মিষ্টি বাঁশির সুর শোনা যায় না। ফসলি জমিতে গড়ে উঠেছে জনবসতি। পরিবর্তন স্বাভাবিক নিয়ম। আমাদের জনসংখ্যা বাড়ছে। ক্রমবর্ধিত জনসংখ্যার জন্য প্রয়োজন বর্ধিত স্থান। কিন্তু বর্ধিত বাসস্থানের সুযোগ না থাকায় প্রথম টার্গেট কৃষিজমি ভরাট হচ্ছে। কৃষিজমি ছাড়াও বনজঙ্গল পরিষ্কার করে মাথাগোঁজার ঠাঁই করে নিচ্ছে। আমাদের দেশে বর্ধিত জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে আবাসন গড়ে উঠছে ঠিকই কিন্তু তা অপরিকল্পিতভাবে। এবং এ কারণেই আবাসন সংকট আরো ঘনিভূত হচ্ছে। আবাসন সংকট মেটাতে গিয়ে কৃষিজমির ওপর চাপ বৃদ্ধি পাওয়া সুখের খবর নয়। প্রকৃতপক্ষে আমাদের কৃষিজমি ভরাট হওয়াটাই আশঙ্কাজনক। যদিও খাদ্য উৎপাদনে গত কয়েক বছরে আমাদের অবস্থান বেশ শক্ত কিন্তু কৃষিজমি রক্ষায় আমাদের মনোযোগী হতেই হবে। আমরা যদি এখন থেকেই কৃষি জমি রক্ষা করার দৃঢ় পদক্ষেপ না নিতে পারি তাহলে ভবিষ্যতে সংকট এড়াতে পারব না। আমাদের দেশে চাষযোগ্য কৃষি জমির পরিমাণ ক্রমেই কমছে। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার জনবহুল দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। ভারতেও কৃষিজমি রক্ষার বিষয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরি হয়েছে। কিন্তু সেখানেও কৃষিজমি বাসস্থানসহ নানা আবাসিক প্রকল্প গড়ে উঠছে।

দ্রুত শহরায়নের বিস্তার আমাদের কৃষিজমিকে গিলে খাচ্ছে। এক সময় যেখানে সবুজ শ্যামল জমি ছিল এখন হয়তো সেখানে কোনো শিল্পকারখানা বা কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড টানানো। কয়েকদিন পরেই হয়তো সেখানে কোনো শিল্প গড়ে উঠবে। আমাদের উন্নয়নের প্রয়োজন আছে কিন্তু কৃষিজমিকে হত্যা করে অবশ্যই নয়। নগরায়নের ফলে দেশে অপরিকল্পিত শিল্পকলকারখানা গড়ে উঠছে এবং নতুন নতুন ইটভাটা গড়ে উঠছে। রাজধানীসহ সারা দেশেই এক অবস্থা। এক হিসেবে দেখা গেছে দেশে সাড়ে চার হাজারের বেশি ইটভাটা গড়ে উঠেছে। এসব ভাটায় যে পরিমাণ মাটি পোড়ানো হয় তাতে বছরে প্রায় ১১ হাজার হেক্টর জমি ফসল উৎপাদন থেকে বঞ্চিত হয়। এসব ছাড়াও আরো বড় একটি কারণ রয়েছে যা কৃষিজমি নষ্ট করে দিচ্ছে। তা হলো নদীভাঙন। হাজার হাজার মানুষ প্রতি বছর ভিটে মাটি ছাড়া হচ্ছে। এই ভাঙনে প্রতি বছর চাষযোগ্য ফসলি জমি আমাদের হারাতে হচ্ছে। এসব মানুষ বাধ্য হয়ে আশ্রয় নেয় শহরে অথবা মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নেয় কোনো নতুন ভিটেয়। যেখানে কোনো কৃষিজমি দখল হচ্ছে। এরকমটি চলতে থাকলে ২০২৫ সালের মধ্যে ৩ হাজার ৫৭৫ বর্গকিলোমিটার ভূমি নদীগর্ভে বিলীন হবে যার অর্ধেকেরও বেশি থাকে কৃষিজমি।

আবাসন সংকট মেটাতে সুষ্ঠু পরিকল্পনা দরকার। কারণ বর্ধিত জনসংখ্যা আবাসনের জন্য কৃষি জমির ব্যাবহার ঠেকাতে হবে। এজন্য পরিকল্পিতভাবে আবাসন গড়ে তুলতে হবে যেন একটি বহুতল ভবনে বহু পরিবার বাস করতে পারে। এটি একটি বিশাল ও ব্যয়বহুল পরিকল্পনা কিন্তু কার্যকর। বহুতল ভবনে বসবাসের সুযোগ পেলে কৃষিজমির উপর থেকে চাপ কমতে থাকবে। প্রতিদিন যে পরিমাণ কৃষি জমি কমছে তার অধিকাংশই ব্যবহৃত হচ্ছে বাড়ি নির্মাণের কাজে। দেশে ২০০৩ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ১১ বছরে মোট ২৬ লাখ ৫৫ হাজার ৭৩১ একর বা ৮০ লাখ ৩৩ হাজার বিঘা কৃষি জমি অকৃষি খাতে চলে গেছে। তারপর থেকেও এ ধারা অব্যাহত রয়েছে। জাতীয় ভূমি ব্যবহার নীতি ২০১০ এবং কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমি জোনিং আইন ২০১০’ অনুসারে কৃষিজমি কৃষিকাজ ব্যতীত অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে না। কোনো কৃষিজমি ভরাট করে বাড়িঘর, শিল্প-কারখানা, ইটভাটা বা অন্য কোনো অকৃষি স্থাপনা কোনোভাবেই নির্মাণ করা যাবে না উল্লেখ করে একটি আইন রয়েছে। গত ৩১ মার্চ কৃষিজমি অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করলে ৩ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রেখে একটি বেসরকারি বিল সংসদ গ্রহণ করেছে। এই আইন কার্যকর হলে কেউ কৃষি জমি অকৃষি কাজে ব্যবহার করলে অর্থদণ্ড ও কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এমন বিধান রাখা হয়েছে উত্থাপিত আইনটি কৃষি জমি (যথাযথ ব্যবহার ও সংরক্ষণ) আইন-২০২২ নামে অভিহিত করা হয়েছে (তথ্যসূত্র- দৈনিক ইত্তেফাক)।

কৃষিপ্রধান অর্থনীতিতে আমাদের হাতে কৃষি জমি রক্ষার কোনো বিকল্প নেই।

খাদ্য সংকট দেখা দেয়ার আগেই আমাদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এজন্য সরকারের যেমন সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে তেমনি আমাদের সাধারণ মানুষকেও এগিয়ে আসতে হবে। কৃষি জমি থেকে অপরিকল্পিত স্থাপনা গড়ে ওঠা ঠেকাতে হবে। বর্তমানে ১৬ কোটির বেশি মানুষের জন্য যে জমি রয়েছে সেই জমির অনেকটাই হুমকির মুখে রয়েছে তা স্পষ্ট। যেটুকু অবশিষ্ট রয়েছে তা রক্ষা করতেই হবে।

আধুনিক সভ্যতা গড়ে তুলতে হলে নগরায়নের বিস্তার রোধ করার কোনো উপায় নেই এবং সেটা রোধ করাও সম্ভব না। সেকারণে নগরায়ণের বিস্তারে কৃষি ও অকৃষিজমি পৃথক করে অকৃষি জমি শিল্প গড়ে তোলার কাজে ব্যবহার করতে হবে। অবৈধ ইটভাটা তুলতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সচেষ্ট হতে হবে।

আর কেউ যাতে কৃষি জমিতে ইটভাটা গড়ে তুলতে না পারে সেদিকে নজর রাখতে হবে। যেসব এলাকায় ভাঙনের জন্য কৃষিজমি কমে যাচ্ছে সেসব এলাকায় ভাঙনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। মোট কথা ভবিষ্যৎ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষিজমি রক্ষায় আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।