ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বৌদ্ধ পারিবারিক আইন খসড়া ও প্রাসঙ্গিকতা

অভিজিৎ বড়ুয়া অভি, গবেষক ও প্রাবন্ধিক
বৌদ্ধ পারিবারিক আইন খসড়া ও প্রাসঙ্গিকতা

বৌদ্ধ পারিবারিক আইন প্রণয়নে সব ধরনের সহযোগিতা করবেন বলে জানিয়েছেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক। রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট আয়োজিত ‘বৌদ্ধ পারিবারিক আইন প্রণয়ন: আমাদের প্রত্যাশা’ শীর্ষক এক সেমিনারে এ কথা বলেন মন্ত্রী। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মের মানুষের জন্য মুসলিম পারিবারিক আইন, হিন্দু ধর্মের মানুষের জন্য হিন্দু পারিবারিক আইন এবং খ্রিস্টান ধর্মের মানুষের জন্য খ্রিস্টান ধর্মীয় আইন প্রচলিত আছে। কিন্তু বাংলাদেশের সমতলীয় বৌদ্ধধর্মের মানুষের জন্য কোনো পারিবারিক আইন নেই, এটা চিন্তার বিষয়। বৌদ্ধ পারিবারিক আইন প্রণয়নে তিনি সব ধরনের সহযোগিতা করবেন। রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের সচিব সম্পদ বড়ুয়া সেমিনারের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের ভাইস-চেয়ারম্যান সুপ্ত ভূষণ বড়ুয়ার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আইন, লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের সচিব মো. মইনুল কবির, আইন ও বিচার বিভাগের সচিব মো. গোলাম সারওয়ার, ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মু আ হামিদ জমাদ্দার, শিক্ষাবিদ ড. বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়া, প্রফেসর ডা. প্রভাত চন্দ্র বড়ুয়া, ড. নীরু বড়ুয়া, ট্রাস্টি ববিতা বড়ুয়া প্রমুখ বক্তব্য দেন। এখন প্রশ্ন হলো বৌদ্ধধর্মের মানুষের জন্য পারিবারিক আইন যদি হয়, তবে পাহাড়ে বসবাসরত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠী চাকমা, মারমা বা অন্যরা কি এই আইনের অধীন? আদিবাসীদের নিজস্ব রীতি বজায় রেখে এই আইনের খসড়া কি হয়েছে? মুসলিম পারিবারিক আইন, হিন্দু পারিবারিক আইন স্ব স্ব ধর্ম ও ধর্মীয় গ্রন্থের আলোকে। সেখানে ধর্মীয় অনুশাসন প্রতিফলিত। কিন্তু বৌদ্ধ পারিবারিক আইনে ত্রিপিটকের অনুশাসনকে গুরুত্ব দেয়া কি হয়েছে? ত্রিপিটক হলো বুদ্ধের আইন, যা বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী ও বৌদ্ধ ভিক্ষুরা মেনে চলে। মুসলিম পারিবারিক আইনের উৎস কোরান। খ্রিষ্টান আইনের উৎস বাইবেল, হিন্দু আইনের উৎস শ্রুতি, স্মৃতি, পুরাণ, সংহিতা, প্রথা, বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্ত, বিধিবদ্ধ আইনসমূহ, ফ্যকটাম ভ্যলেটে। তাহলে প্রশ্ন হলো বৌদ্ধ পারিবারিক আইনের উৎস কি? বা একটি আইন প্রণয়নের সময় বৌদ্ধ ভিক্ষুসংঘের মতামত নেয়া হয়েছে কি না? কারণ বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী স্ব স্ব গ্রাম বা অঞ্চলে বিহারকে কেন্দ্র করে তাদের সামাজিকতা বজায় রাখে। প্রতিটি বৌদ্ধ বিহারে একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু বা অধ্যক্ষ থাকেন। ভিক্ষুসংঘ কর্তৃক উনি অনুমতিপ্রাপ্ত হন। সুতরাং বিহারকে কেন্দ্র করে বসবাসরত এই বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর ও ভিক্ষুসংঘের মতামত নেয়া খুবই সহজ। কিন্তু এক্ষেত্রে তার ব্যত্যয় হয়েছে। যে কোন আইনের খসড়া প্রণয়ন বা প্রণয়নকারী বা প্রস্তাবকারী হওয়া উচিত ওই জনগোষ্ঠী প্রতিনিধি। এক্ষেত্রে আইনের খসড়া প্রণয়ন বা প্রণয়নকারী বা প্রস্তাবকারী কি সর্বসম্মতিক্রমে বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীকে প্রতিনিধিত্ব করে? আইন মন্ত্রীর ভাষায়, ‘বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের কার্যাবলীকে আরো বিস্তৃত করে এর কার্যক্রমকে গতিশীল ও ব্যাপকভাবে তৃণমূল পর্যায়ের জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর লক্ষ্যে ট্রাস্টের অধ্যাদেশকে ২০১৮ সালে আইনে পরিণত করা হয়েছে।’ তাহলে প্রশ্ন তৃণমূল পর্যায়ের জনগণের মতামত না নিয়ে কেন এ ধরনের আইনের খসড়া প্রণয়ন করা হলো? এবং আইনের খসড়া প্রণয়ন বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের কার্যাবলীতে পরে কি? এখন বৃহত্তর বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর প্রশ্ন, কেন এই বৌদ্ধ পারিবারিক আইন, কার স্বার্থে? ২০২২ সালের আদমশুমারি অনুসারে বাংলাদেশে বৌদ্ধ জনসংখ্যা ১, ১০৭, ৪৬৬। যেখানে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা বর্তমানে সাড়ে ১৬ কোটি ৫১ হাজার। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ০.৬১ শতাংশ, যা আগের সুমারিতে ছিল ০.৬২ শতাংশ। এই ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ভূমি মালিকানাও খুবই সামান্য, এই বাস্তবতা ও সংখ্যালঘু বাস্তবতায় মেয়েদের সম্পত্তির অংশিদার মালিকানা বিষয়টি ভাবা উচিত। বাংলাদেশে ১৯৩৭ সালের হিন্দু আইন অনুযায়ী মেয়েরা কোনো সম্পত্তির উত্তরাধিকারী নয়। হিন্দু আইনে মৃতের সম্পত্তির উত্তরাধীকার বিষয়ে দুই ধরনের উত্তরাধীকার পদ্ধতি চালু আছে: (ক) মিতক্ষরা পদ্ধতি (খ) দায়ভাগ পদ্ধতি। বাংলাদেশে বসবাসরত হিন্দু ধর্মীয় লোকজন মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি বণ্টনের ক্ষেত্রে দায়ভাগ পদ্ধতি অনুসরণ করেন। দায়ভাগ মূলত জীমূতবাহন রচিত হিন্দু ধর্মীয় সম্পত্তির উত্তরাধীকার বিষয়ক আইন গ্রন্থ। এ আইনগ্রন্থ অনুযায়ী, যারা মৃত ব্যক্তির আত্মার কল্যাণের জন্য পি-দানের অধিকারী, কেবলমাত্র তারাই মৃত ব্যক্তির সপি- এবং যোগ্য উত্তরাধিকারী হিসেবে মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি পেয়ে থাকেন। মিতক্ষরা পদ্ধতি অনুসারে জন্ম হওয়ামাত্রই যেমন একজন পুত্র সন্তান পূর্বপুরুষের সম্পত্তিতে পিতার সমান অংশীদারী হন, দায়ভাগ আইনে তেমনটা হয় না। পাঁচ শ্রেণির মহিলা কোনো সম্পত্তি পেলেও সীমিত কিছু শর্ত (যেমন- মৃতের দাহ ও শ্রাদ্ধ, মৃতের কৃত ঋণ পরিশোধ, নাবালক সন্তানের ভরণ-পোষণ, শিক্ষা, চিকিৎসা ব্যয় পরিচালনা; দূরবর্তী সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ অসম্ভব হলে, প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ের বিবাহের খরচ পরিচালনা ইত্যাদি) ছাড়া তা হস্তান্তর করতে পারে না। তারা মূলত জীবনস্বত্ব ভোগ করতে পারে (যত দিন বেঁচে থাকবেন, ততদিন প্রাপ্ত সম্পত্তির দখল ভোগ করবেন)। তাদের মৃত্যুর পর সম্পত্তি পূর্ব মূল মালিকের কাছে ফিরে যাবে, যা পূর্ব মূল মালিকের নিকটস্থ সপি- পাবেন। কোনো পুরুষ উত্তরাধিকারী সম্পত্তি না পাওয়া পর্যন্ত এভাবে সম্পত্তি বারবার মৃত মূল মালিকের কাছে ফিরে যাবে। দায়ভাগ আইনে স্বামীর মৃত্যুর পর নাবালক সন্তানের লালন-পালনের জন্য স্ত্রী নাবালকের স্বাভাবিক অভিভাবক নিযুক্ত হন এবং নাবালকের স্বার্থে সীমিত বিশেষ কারণে নাবালকের সম্পত্তি হস্তান্তর করতে পারেন। মৃত ব্যক্তির স্ত্রী না থাকলে, এক বা একাধিক পুত্র থাকলে পুত্রই সমুদয় সম্পত্তি পাবেন। এ আইনের বিধান অনুসারে, নিকটবর্তী পুরুষ ওয়ারিশ থাকলে পরবর্তীরা সম্পত্তি পাবেন না, যেমন পুত্র থাকলে পুত্রের-পুত্র সম্পত্তি পাবেন না। মৃত ব্যক্তির একই সঙ্গে পুত্র ও স্ত্রী জীবিত থাকলে, মৃতের বিধবা স্ত্রী এক পুত্রের সমান অংশ পাবে। একাধিক স্ত্রী থাকলে স্ত্রীর অংশ বিধবা স্ত্রীদের মধ্যে তুলাংশে বণ্টন হবে। মৃতের স্ত্রী যেরূপ অংশ পাবেন, জীবিত থাকলে পুত্রের স্ত্রী, পুত্রের পুত্রের স্ত্রী কিংবা পুত্রের পুত্রের পুত্রের স্ত্রীও অনুরূপ অংশ পাবেন। দায়ভাগ আইনে মৃত ব্যক্তির জীবিত উত্তরাধীকারীগণের মধ্যে সম্পত্তি বণ্টনের সময় যদি কোনো উত্তরাধীকারী মৃত থাকেন, তবে মৃত ব্যক্তির জীবিত ওয়ারিশগণ সম্পত্তির উত্তরাধীকারী হবেন। স্বামীর মৃত্যুর পর মৃতের জীবিত স্ত্রী মৃতের সম্পত্তিতে জীবনস্বত্ব ভোগ করেন (যত দিন বেঁচে থাকবেন, মৃতের সম্পত্তির দখল ভোগ করবেন)। তার মৃত্যুর পর তার ভোগ-দখলকৃত সম্পত্তি পুত্রগণ প্রাপ্ত হবেন। পুত্র জীবিত না থাকলে সম্পত্তি মূল মালিকের নিকট ফিরে যাবে। গত ১ আগস্ট বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টে রায় ঘোষণা করা হয়েছে, হিন্দু বিধবারা স্বামীর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে, তবে অর্পিত সম্পত্তি কোনো প্রকার বিক্রি, হস্তান্তরযোগ্য নয়। শুধু ভোগদখলকৃত বলে গণ্য হবে। যে আইন বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর জন্যও ছিল। কিন্তু বর্তমান বৌদ্ধ পারিবারিক আইন খসড়া অনুসারে নারীর উত্তরাধিকার ধারাটি ত্রিপিটক ও বর্তমান বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর সামাজিকভাবে পালিত নিয়মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি না তা আরো গভিরভাবে খতিয়ে দেখা উচিত। বিবাহবন্ধন ধারার কিছু উপধারা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বর্তমান সামাজিক নিয়মের সঙ্গে অমিল। বিবাহবন্ধন ধারার উপধারায় ‘নিষিদ্ধ রক্ত’ সম্পর্ক বিষয়টি বলা হয়েছে, যার প্রকৃত ব্যাখ্যা নেই। আবার ধারা ২ এর উপধারা (চ) এর ব্যাখ্যা অনুসারে ‘নিষিদ্ধ রক্ত’ সম্পর্ক বিষয়টি কি? বিবাহবন্ধনের নিবন্ধন ধারায়, এর দায়িত্ব বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দেয়া হয়েছে।

কিন্তু এটি বৌদ্ধ ত্রিপিটকের বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বিনয় নিয়মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি না তা আরো গভিরভাবে খতিয়ে দেখা উচিত। কারণ বৌদ্ধ ত্রিপিটকের বিনয় অনুসারে বৌদ্ধ ভিক্ষুর নির্দিষ্ট বিনয় বিধান আছে। যা বৌদ্ধ ভিক্ষুরা মেনে চলেন। একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু বিবাহ ও তালাকের দায়িত্বপ্রাপ্ত হতে পারেন কি না এ বিষয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষুসংঘের মতামত নেয়া প্রয়োজন। বিবাহ বন্ধন বাতিল, একাধিক বিবাহ ও বিবাহ বিচ্ছেদ ধারার উপধারাগুলো বর্তমান বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর সামাজিকভাবে পালিত নিয়মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি না তা আরো গভিরভাবে খতিয়ে দেখা উচিত। পিতামাতার ভরণ-পোষণ ধারায় এটি পরিষ্কার করা হয়নি সংসার ত্যাগকারী ব্যক্তি কিরূপে পিতামাতার ভরণ-পোষণ করবেন। তাছাড়া এই ধারার উপধারাগুলো ত্রিপিটক ও বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর সামাজিকভাবে পালিত নিয়মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি না তা আরো গভিরভাবে খতিয়ে দেখা উচিত।

অপ্রাপ্তবয়স্কতা ও অভিভাবকত্ব ধারার উপধারা অনুসারে কোনো ব্যক্তি সংসার ধর্ম ত্যাগ করলে অপ্রাপ্তবয়স্ক কোনো বৌদ্ধ সন্তানের অভিভাবক হবার যোগ্য হবে না। তা ত্রিপিটক ও বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর সামাজিকভাবে পালিত নিয়মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি না তা আরো গভিরভাবে খতিয়ে দেখা উচিত। সম্পত্তির অধিকার ও অপ্রাপ্তবয়স্কতা ও অভিভাবকত্ব ধারা দুটি আরো বিচার বিশ্লেষণ প্রয়োজন। সম্পূর্ণ খসড়া আইনের কিছু ধারার বিষয়ে আলোচনা করা হলো। কিন্তু এটি সঠিক যে, এই খসড়া আইনটির বিষয়ে তৃণমূল পর্যায়ের বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর মধ্যে সুস্পষ্ট বিভক্তি প্রতীয়মান।

সরকারের শেষ সময়ে এই নির্বাচনের বছরে যা কাম্য ছিল কি? এখন যখন বিভিন্ন প্রকার রাজনৈতিক, কূটনৈতিক বিষয়ে সরকার ব্যস্ত, ঠিক সে সময়ে বৌদ্ধ ধর্মের জনগোষ্ঠীর জন্য পারিবারিক আইনের বিষয়টিকে কেন সামনে আনা হলো? যে কারণে বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর মধ্যে সুস্পষ্ট বিভক্তি প্রতীয়মান।

লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত