মারাত্মক আকার ধারণ করছে হলুদ সাংবাদিকতা

আরিফ আনজুম, কালাম লেখক

প্রকাশ : ০৮ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

আজকের এই অনলাইন ভর করেই দেশে কয়েক হাজার নামসর্বস্ব পত্রিকা চলছে। আবার এই অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলো চলছেও নিজের গতিতেই। কপি পেস্ট প্রক্রিয়ায় চালাতে প্রয়োজন হচ্ছে না প্রতিবেদকের। প্রয়োজন হচ্ছে না কোনো সোর্সের। একটি বা দুটি কম্পিউটার আর নেটলাইন থাকলেই হলো। মুহূর্তের খবর পৌঁছে দেয়। বর্তমানে বাংলাদেশে অনলাইন নিউজ পোর্টালের সংখ্যা কমপক্ষে পাঁচ হাজার। এর মধ্যে পেশাদারিত্ব এবং মোটামুটি পেশাদারিত্ব আছে এমন নিউজ পোর্টালের সংখ্যা পাঁচ বা ছয়টির বেশি নয় (টিভি ও দৈনিক পত্রিকার ওয়েবসাইট বাদে)। অর্থাৎ হাজারে একটা। শতাংশ হিসেবে তা ০.১। তার মানে ৯৯.৯ ভাগ নিউজ পোর্টালে পেশাদারিত্ব নেই। এই পোর্টালগুলো অন্য পোর্টালের সংবাদ নির্লজ্জভাবে চুরি করে কিছুটা পরিবর্তন করে তা হুবহু প্রকাশ করে থাকে। এগুলোতে নেই কোনো বিনিয়োগ। প্রয়োজনের তুলনায় নিজস্ব সংবাদকর্মীও নেই। এদের একমাত্র মূলধন ওই চৌর্যবৃত্তি। মানে কপি এবং পেস্ট করা। কপি ঠেকানোর কোনো কার্যকর ব্যবস্থা থাকলে এ পোর্টালগুলোর জন্মের পরই মৃত্যু হতো। হয়তো জন্মই হতো না। গণমাধ্যমের মূল দায়িত্ব সংবাদ সরবরাহের চেয়ে এরা ব্যক্তিস্বার্থ উসুলের উদ্দেশ্যেই অনলাইনগুলো চালু করেন। সব থেকে কষ্টের বিষয় হচ্ছে, ‘এই অনলাইনে ভর করেই মারাত্মক আকার ধারণ করছে হলুদ সাংবাদিকতা।’ আমাদের দেশে এক সময় প্রচুর শোনা যেত, ‘কবির চেয়ে কাকের সংখ্যা বেশি। এখন নির্দ্বিধায় বলা যায়, যে কোনো পাখির চেয়ে সাংবাদিক বেশি। এই গণসাংবাদিক তৈরিতেও নগ্ন ভূমিকা রয়েছে অনলাইনগুলোর। নিউজের চেয়ে এরা সাংবাদিক উৎপাদনেই বেশি কার্যকর বলা যায়। আর এই গণহারে উৎপাদিত সাংবাদিকরাও কোনো প্রকারের সাংবাদিকতা জ্ঞান ছাড়াই চর্চা করে যাচ্ছেন হলুদ সাংবাদিকতা। অধিকাংশই জানেন না সাংবাদিকতার এথিক্স আছে। জানলেও তা মানার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন না। পাঁচশ’ টাকা খরচ করলেই এখন ঝকঝকে প্রেসকার্ড ও ভিজিটিং কার্ড করে চালিয়ে যান হলুদ সাংবাদিকতা। কিন্তু তার প্রসার বর্তমানে মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, সাংবাদিকতা ইয়েলো জার্নালিজম বা হলুদ সাংবাদিকতা শব্দটি এসেছে উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে। দুই ভুবনবিখ্যাত সাংবাদিক জোসেফ পুলিৎজার ও উইলিয়াম হার্স্টের এক অশুভ প্রতিযোগিতার ফসল আজকের এই ‘হলুদ সাংবাদিকতা’। ১৮৮৩ সালে নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড নামে একটি সংবাদপত্র কিনেন প্রখ্যাত সাংবাদিক জোসেফ পুলিৎজার। পত্রিকাটির আগের মালিক ছিলেন জে গোল্ড। অন্যদিকে উইলিয়াম হার্স্ট ১৮৮২ সালে ‘দ্যা জার্নাল’ নামে একটা পত্রিকা কিনে নেন জোসেফ পুলিৎজারের ভাই আলবার্ট পুলিৎজারের কাছ থেকে। কিন্তু পরিবারের সদস্যের পত্রিকা হার্স্টের হাতে চলে যাওয়ার বিষয়টিকে সহজভাবে নিতে পারেরনি পুলিৎজার। শুরু হয় হার্স্টের সঙ্গে পুলিৎজারের স্নায়ুযুদ্ধ। পুলিৎজার নিউইয়র্ক ওয়াল্ড কিনেই ঝুঁকে পড়লেন চাঞ্চল্যকর খবর, চটকদারি সংবাদ ইত্যাদি প্রকাশে। রিচার্ড ফেল্টো আউটকল্ট নামে একজন কার্টুনিস্টকে চাকরি দিলেন তার কাগজে।

ওই কার্টুনিস্ট ‘ইয়েলো কিড’ বা ‘হলুদ বালক’ নামে প্রতিদিন নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ডের প্রথম পাতায় একটি কার্টুন আঁকতেন এবং তার মাধ্যমে সামাজিক অসঙ্গতি থেকে শুরু করে এমন অনেক কিছু বলিয়ে নিতেন, যা ছিল অনেকটাই পক্ষপাতদুষ্ট। এক সময় হার্স্ট পুলিৎজারের নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ডের কার্টুনিস্ রিচার্ড ফেন্টো আউটকল্টকে অধিক বেতনের প্রলোবনে নিয়ে এলেন তার ‘জার্নাল’ পত্রিকায়। হার্স্ট তাতেই ক্ষান্ত থাকেননি, মোটা বেতনের লোভ দেখিয়ে নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ডের ভালো সব সাংবাদিককেও টেনে নেন নিজের পত্রিকায়। বেচারা পুলিৎকার রেগে আগুন। তিনি অগত্যা জর্জ চি লুকস নামে আরেক কার্টুনিস্টকে নিয়োগ দেন। এদিকে জার্নাল, ওদিকে নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড - দুটিা পত্রিকাতেই ছাপা হতে লাগল ইয়েলো কিডস বা হলুদ বালক কার্টুন। শুরু হয়ে গেল পত্রিকার কাটতি নিয়ে দুটো পত্রিকার মধ্যে দ্বন্দ্ব। জার্নাল এবং নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ডের বিরোধ সে সময়কার সংবাদপত্র পাঠকদের কাছে ক্রমেই আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল। দুটো পত্রিকাই তাদের হিট বাড়ানোর জন্য ভিত্তিহীন, সত্য, অর্ধসত্য ব্যক্তিগত কেলেঙ্কারিমূলক খবর ছাপা শুরু করল। এতে দুটো পত্রিকাই তাদের মান হারাল। তৈরি হলো একটি নষ্ট মানসিকতার পাঠকশ্রেণি, যারা সব সময় চটকদার, ভিত্তিহীন, চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী, অর্ধ-সত্য সংবাদ প্রত্যাশা করত এবং তা পড়ে তৃপ্তি পেত। এভাবেই জোসেফ পুলিৎজার ও উইলিয়াম হার্স্ট দু’জনেই হলুদ সাংবাদিকতার দায়ে অভিযুক্ত এবং ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে রইলেন। আর তাদেরই উত্তরসূরী হয়ে এই হলুদ সাংবাদিকতা যুগ যুগ জিইয়ে রাখছেন কিছু সাংবাদিক। যার ফলে ব্যহত হচ্ছে মূল ধারার সাংবাদিকতা। বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে পেশাদারিত্বের জায়গায়। ফ্রাম্ক লুথার মট হলুদ সাংবাদিকতার পাঁচটি বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন। তা হলো- ‘সাধারণ ঘটনাকে কয়েকটি কলামজুড়ে বড় আকারের ভয়ানক একটি শিরোনাম করা। ছবি আর কাল্পনিক নকশার অপরিমিত ব্যবহার। ভুয়া সাক্ষাৎকার, ভুল ধারণার জন্ম দিতে পারে এমন শিরোনাম, ভুয়া বিজ্ঞানমূলক রচনার ব্যবহার। সম্পূর্ণ রঙিন রবিবাসরীয় সাময়িকী প্রকাশ, যার সঙ্গে সাধারণত কমিক্স সংযুক্ত করা হয়। স্রোতের বিপরীতে সাঁতরানো পরাজিত নায়কদের প্রতি নাটকীয় সহানুভূতি।’ যার সবগুলোই বর্তমানের ব্যাঙের ছাতার ন্যায় বেড়ে ওঠা অনলাইনগুলোর মধ্যে রয়েছে। জনপ্রতিনিধিসহ ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদের ব্যক্তিরাও অনলাইন নিউচ পোর্টালের প্রতি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন বিভিন্ন সময়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই এই ধারার গণমাধ্যমকে কঠোর নিয়মের মধ্যে রাখার কথাও তারা বলেছেন। এমনকি সরকার ঘেঁষা সাংবাদিকরাও সে কথা সমর্থন করেছেন। শেষ পর্যন্ত তারা নীতিমালা তৈরিতেও হাত দিয়েছেন। তবে এক সময় অনেক তোড়জোড় থাকলেও খসড়া নীতিমালা প্রকাশের পর নানা সমালোচনার মুখে তা আলোর মুখ দেখেনি এখনো। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী এখন সে বিষয়ে আর কোনো কথাও বলেন না। এক গণমাধ্যম হাউজের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানে সাংবাদিকতার শিক্ষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ স ম স আরেফিন সিদ্দিক তার নিজের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে বলেছিলেন, ‘তথ্য যাচাই-বাছাই না করে কোনো ধরনের সম্পাদনা ছাড়াই অধিকাংশ অনলাইন নিউজ পোর্টালের সংবাদ প্রকাশ করার ফলে সাংবাদিকতায় বস্তুনিষ্ঠতা নষ্ট হচ্ছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘সম্পাদনাই হচ্ছে সাংবাদিকতার প্রাণ।

কিন্তু অধিকাংশ অনলাইন সংবাদপত্রের সংবাদে সম্পাদনার চিহ্নমাত্র নেই। যিনি সংবাদ সংগ্রহ করছেন, তিনিই সেটা আপলোড করছেন এবং সেটা নিয়ে আমরা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিচ্ছি, বহু কিছু করছি, কিন্তু মূল জায়গায় অর্থাৎ এটা যে কোনো সাংবাদিকতাই নয়, সেটা অনেক সময় বোঝা যাচ্ছে না।’ সরকারের নির্দিষ্ট কোনো নীতি না থাকায় অনলাইনগুলো আরো বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এগুলো দমনে সরকারের যেমন ভূমিকা থাকা জরুরি তেমনি মূল ধারার সাংবাদিকদেরও সচেতনতা জরুরি। একজন পেশাদার সাংবাদিকের যে পরিমাণ মায়া এ পেশার প্রতি রয়েছে তা অন্য কেউ উপলব্ধি করতে পারবে না। সেই অনুধাবন থেকে হলেও হলুদ সাংবাদিকতা রোধে পেশাদার সাংবাদিকদের এগিয়ে আসতে হবে সবার আগে। রুখতে হবে গণমাধমের শত্রু হলুদ সাংবাদিকদের।

লেখক : সহকারী শিক্ষক,

আমতলী মডেল উচ্চ বিদ্যালয়, শিবগঞ্জ, বগুড়া