শিক্ষায় জিপিএ-৫ এবং আমাদের প্রত্যাশা

রায়হান আহমেদ তপাদার

প্রকাশ : ০৯ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় অনেকের অজান্তেই গোড়ায় গলদ ঢুকে গেছে। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে এর সূচনা। মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে এসে পড়ছে এর প্রভাব। তাও মাধ্যমিক স্তরে ভালো গ্রেড পয়েন্ট অনেকে পান। ঠিক তেমনি উচ্চমাধ্যমিকেও। মহানগর আর জেলা সদরগুলোর নামকরা কিছু স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের মান বিবেচনায় নিয়ে গোটা দেশের মান হিসেবে ধরলে বড় ধরনের ভুল করা হবে। প্রতারিত করব নিজেদের। এরই মাঝে আমরা অনেক ঠকেও স্বীকার করতে চাইছি না। মানবসম্পদ উন্নয়ন একটি জাতিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে বিবেচনায় নিতে হয়। আমরা অবকাঠামো তৈরিসহ অনেক বিষয়ে এ লক্ষ্যে কিছু কাজ করেছি। কিন্তু মূলত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগ, তাদের প্রশিক্ষণ ও তদারকি ব্যবস্থার প্রতি এতটা জোর দেওয়া হয়নি। শিক্ষার্থীদের সিলেবাস ও মূল্যায়ন-প্রক্রিয়া গুরুতর ত্রুটিপূর্ণ বললে অত্যুক্তি হবে না। দৃঢ়তার সঙ্গে সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে কাজ করলে এ পরিস্থিতির পরিবর্তন না হওয়ার কথা নয়। ভাঙা ইমারতের ভিটায় নতুন নির্মাণের মনোবল এ জাতির আছে। দরকার শুধু শিক্ষা ব্যবস্থার সঠিক পরিকল্পনা। বর্তমান অবস্থায় একে অন্যকে দোষ দিতে থাকলে পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটবে না। দেশে উচ্চশিক্ষা অর্জনের হার যেমন বাড়ছে, তেমন উচ্চশিক্ষিতদের বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে সমান তালে। লাখ লাখ শিক্ষিত তরুণ দেশের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েও চাকরি না পেয়ে হতাশায় ভুগছেন। শিক্ষিত বেকার তরুণ-তরুণীর কাছে চাকরি হয়ে উঠেছে সোনার হরিণ। দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ ও শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতাসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রধানত শিক্ষার নিম্নমানই এর জন্য দায়ী। মানহীনতার পাশাপাশি প্রশিক্ষণের অভাব, দক্ষ জনবলের ঘাটতি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চাহিদা অনুযায়ী উপযুক্ত শিক্ষা দিতে না পারা ও শিক্ষায় কম বিনিয়োগ ইত্যাদি এর জন্য দায়ী। সব মিলিয়ে শিক্ষিত জনশক্তির জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা বর্তমানকালে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ২০২৩ সালের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফল। রেকর্ড পাসের হার ও জিপিএ-৫ পাওয়ায় আনন্দ-উল্লাসে ভাসছেন শিক্ষার্থীরা। তবে তাদের আকাশে চিন্তার মেঘও জমতে শুরু করেছে। কেননা কিছুদিন পরই শুরু হবে ভর্তিযুদ্ধ। আর এতে জিপিএ-৫ পেয়েও অধিকাংশ শিক্ষার্থী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে। এবারের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, দেশের ৩৯টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন রয়েছে ৩৯ হাজারের বেশি। আর এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৭৬ হাজার শিক্ষার্থী। ফলে জিপিএ-৫ পেয়েও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাবেন না ১ লাখ ৩৫ হাজার শিক্ষার্থী। তাছাড়া প্রতিবছর পরীক্ষায় পাস করে প্রায় ১০-১২ লাখ শিক্ষার্থী। কিন্তু পাবলিক-প্রাইভেট মিলিয়ে আসন রয়েছে ৪ লাখের কিছুটা বেশি। ফলে এ ক্ষেত্রেও বঞ্চিত হবে শিক্ষার্থীরা।

এই তথ্য তো শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের কপালে চিন্তার রেখা এঁকে দেওয়ার মতো! আমাদের সমাজের অধিকাংশ মানুষদের কাছে ফলাফল মানেই হচ্ছে জিপিএ-৫ কিংবা এ প্লাস! কোনো পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হলেই, শুরু হয় প্রশ্ন এ প্লাস পেয়েছ? কিংবা জিপিএ-৫ পেয়েছ? জবাবে না-সূচক জবাব বললেই গোমড়া হতে শুরু করে তাদের মুখ, তারা নানা কটুকথা শোনাতে শুরু করেন শিক্ষার্থীদের। তারা ভাবেন না, তাদের প্রতিটি কথা তীরের মতো বিঁধে একজন শিক্ষার্থীর মনে। আপনার কটুকথার কারণে খালি হয় একজন মায়ের বুক, অথচ সেই সন্তান নিয়ে হয়তো তার মা-বাবা অনেক স্বপ্ন বুনেছিলেন। কে নেবে এসবের দায়ভার? কোনো কারণে একজন শিক্ষার্থীর ফল খারাপ হতেই পারে, তাই বলে তাকে কটুকথা শোনাতে হবে? দুর্বিষহ করে তুলতে হবে তার জীবন? জীবনে ফলাফলই কি সব? হ্যাঁ, আমি মানছি যে ভালো ফলাফল জীবন গড়তে সহায়ক! খারাপ ফলাফল করলে তাকে কটুকথা শুনিয়ে কী লাভ? শুধু তা-ই নয়, আমাদের দেশে এখন নবম শ্রেণিতে ভর্তি হলেই প্রশ্ন ওঠে, তুমি কি বিজ্ঞান বিভাগে লেখাপড়া করছ? অনেকে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ছাড়া কেউ হলেই তাকে ইচ্ছামতো তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন, যেন সে বিজ্ঞান বিভাগ না নিয়ে বড্ড ভুল করে ফেলেছে। অথচ বিজ্ঞান বিভাগে পড়ুয়া মানুষদের মতো অন্যান্য বিভাগের শিক্ষার্থীরাও সমাজ বিনির্মাণে অনেক অবদান রাখছেন। একটি রাষ্ট্রের জন্য একজন বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী যেমন প্রয়োজন তেমনি একজন মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থী, বাণিজ্যিক বিভাগের শিক্ষার্থীসহ সব বিভাগের শিক্ষার্থীও তেমনি প্রয়োজন। বর্তমানে অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের কেন পড়াশোনা করছ প্রশ্নের জবাবে তাদের উত্তর হবে ভালো ফলাফলের জন্য। অথচ আমাদের মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন মানুষ হওয়ার জন্য পড়াশোনা প্রয়োজন!

লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক।