বাল্কহেডের বেপরোয়া চলাচল

ক্ষয়ক্ষতি রোধে দরকার কঠোর পদক্ষেপ

প্রকাশ : ০৯ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বাল্কহেড নামক একপ্রকার ইঞ্জিনচালিত নৌযান আমাদের দেশের নদ-নদীতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিতে এবং চাঁদাবাজদের হাত থেকে রক্ষা পেতে দিনের বেলায় বাল্কহেডগুলো সাধারণত চলাচল করে না। রাতের অন্ধকারে এসব নৌযান চলাচল করে। এসব নৌযান সাধারণত বালু পরিবহন করে। বিভিন্ন নদ-নদী থেকে একটি চক্র অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করার পর সেগুলো এসব বাল্কহেড দিয়ে পরিবহন করে। অবৈধভাবে সংগ্রহ করা বালু অবৈধ বাল্কহেড দিয়ে পরিবহন করার কারণে এসব নৌযানগুলোর মধ্যে পলায়ন মনোভাব কাজ করে। ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত বালু বহন করতে গিয়ে পানির ওপর এই নৌযানটির সামান্য অংশ দৃশ্যমান থাকে। ইঞ্জিনের ওপর মিটমিট করে বাতি জ্বললেও তা দূর থেকে দেখা যায় না। রাতের আঁধারে অন্যান্য নৌযান বাল্কহেডের গতিবিধি নজরে আনতে পারে না। ফলে বাল্কহেড অন্য কোনো যাত্রী নৌযান বিশেষ করে ট্রলারকে ধাক্কা দিয়ে ডুবিয়ে দিতে পারে। আবার লঞ্চের সঙ্গে বাল্কহেডের ধাক্কাধাক্কিতে উভয় নৌযানের আরোহীদের প্রাণ হারানোর ঘটনাও ঘটছে। সবশেষ গত শনিবার মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার পদ্মার শাখা নদীতে একটি বালুবাহী বাল্কহেডের ধাক্কায় পিকনিকের ট্রলারডুবির ঘটনায় নারী শিশুসহ ১০ জনের মতো লোক মারা গেছে। রাত ৮টার দিকে ট্রলারটি নারী-শিশুসহ ৪৭ জন যাত্রী নিয়ে ডুবে যায়। পদ্মা নদীতে পিকনিক শেষে ট্রলারটি উচ্চশব্দে গান বাজাতে বাজাতে খাল দিয়ে বাড়ি ফিরছিল। এ সময় বিপরীত দিক থেকে একটি বাল্কহেড বালু আনতে পদ্মা নদীর দিকে যাওয়ার পথে ট্রলারটিকে আঘাত করে। ফলে ট্রলারটি পানিতে তলিয়ে যায়। এ ঘটনায় মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসন পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তবে সমস্যা হচ্ছে এই কমিটির প্রতিবেদন পেতে পেতে মানুষ হয়তো ঘটনাটি ভুলে যাবে। আবার কমিটি যেসব সুপারিশ করবে সেগুলোও কার্যত প্রতিপালিত হয় না। এর আগে বালুবাহী বাল্কহেডের ধাক্কায় ১৬ জুলাই রাতে ঢাকার সদরঘাটের কাছে বুড়িগঙ্গা নদীতে ডুবে যায় ওয়াটার বাস। নারায়ণগঞ্জ থেকে উদ্ধারকারী জাহাজ ‘রুস্তম’ এসে ১২ ঘণ্টা পর ওয়াটার বাসটি টেনে তোলে। ওয়াটার বাসটি ডুবে যাওয়ার পর সাঁতার কেটে অনেকে তীরে উঠতে পারলেও বেশ কয়েকজন মারা যায়। ইঞ্জিনচালিত ট্রলার জাতীয় এই ধরনের নৌযান রাতে ঢাকা-বরিশাল নৌপথে মেঘনাসহ অধিকাংশ নদীতে চলাচল করে। এসব যান রাতে চলাফেরায় একটা বেপরোয়াভাব ফুটে ওঠে। যদিও যাত্রীবাহী নৌযান চলাচল নির্বিঘ্ন করতে সন্ধ্যার পর বাল্কহেড চলাচল নিষিদ্ধ করেছে বিআইডব্লিউটিএ। তবে তদারকির অভাবে তা কার্যকর হচ্ছে না। গত বছর এক সরকারি হিসাবে ৪ হাজার ৭০০টি নিবন্ধিত বাল্কহেডের কথা বলা হয়েছিল। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ধারণা, সারা দেশের নদীতে প্রায় ১১ হাজারের বেশি বাল্কহেড চালু আছে। এসব বাল্কহেড দিয়ে দেশের বিভিন্ন বালুমহাল থেকে উত্তোলন করা বালু বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়। ফিটনেস দূরে থাক, এসব অবৈধ বাল্কহেড চলছে দক্ষ মাস্টারের পরিবর্তে অদক্ষ সুকানি দিয়ে। চালকদের প্রায় সবাই চালাতে চালাতে শিখেছে। প্রশিক্ষণ বলে কোনো কিছুর কথা তারা কখনো শোনেননি। কোনো একটা ঘটনার পর নৌপুলিশ নদীতে অভিযান চালিয়ে অবৈধ বাল্কহেড জব্দ এবং অনেককে আটক করে। তবে যাদের আটক করা হয় তারা মূলত খেটে খাওয়া দিনমজুর। ফলে ধরাশোয়ার বাইরে থেকে যায় মালিকপক্ষের লোকজন। রাতে নদ-নদীতে অগণিত বাল্কহেডের চলাচল যে কী ভয়াবহ হতে পারে, সেটা দুর্ঘটনার আগে চিন্তায় আসে না। বাল্কহেডের ক্ষেত্রে সূর্যাস্ত আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ এবং সন্ধ্যার আগেই সব বাল্কহেডকে তাদের চলাফেরা বন্ধ করে দিতে হবে। ডিজিটাল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সদরঘাটে বসেই বাল্কহেডগুলো পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব। তবে বাল্কহেডের মালিকদের অভিযোগ, প্রতি মাসে বিভিন্ন মহলকে একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের মাসোয়ারা দিতে হয়। নকশা নিয়ে জটিলতা ও হয়রানি এবং মোটা অঙ্কের টাকা উৎকোচ দাবি করায় অনুমোদন বা নিবন্ধন নিতে সাধারণত মালিকপক্ষ আগ্রহী হয় না। নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে তারা মামলা করতে দেরি করে না। তবে মামলার নিষ্পত্তি সময়মতো না হওয়ায় তেমন কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হচ্ছে না।