সংকটে প্রান্তিক ইন্টারনেট সেবাদাতারা

জিহান চৌধুরী, কলাম লেখক

প্রকাশ : ১০ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

প্রযুক্তির বদৌলতে বিশ্ব আজ হাতের মুঠোয়। বাংলাদেশের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতের উন্নয়ন এবং আধুনিকায়ন সহজতর করেছে মানুষের জীবনকে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান আওয়ামী সরকারের ডিজিটালাইজেশন উদ্যোগ বাংলাদেশকে বিশ্বের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, যোগাযোগ তথা অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ব্যাপক সুফল পাচ্ছে। তার প্রমাণ বিশ্বকে থমকে দেওয়া অতিমহামারি করোনাভাইরাস মোকাবিলায় রয়েছে অভাবনীয় সফলতা। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সহায়তায় ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণের স্বপ্নের অগ্রযাত্রায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং মূল উপকরণ কিংবাবিষয় হচ্ছে সন্দেহাতীতভাবে ইন্টারনেট। বর্তমানে ইন্টারনেটবিহীন এক সেকে- ও কি চিন্তা করা যায়! ১৯৯১ ও ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশের জন্য বিনা খরচে আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট গেটওয়ের (সাবমেরিন ক্যাবেল) সঙ্গে সংযুক্তির প্রস্তাব ছিল। কিন্তু আফসোসের বিষয় হচ্ছে যে, তৎকালীন বিএনপি সরকার ‘তথ্য ফাঁসের’ অজুহাতে এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। পরবর্তী সময়ে সর্বপ্রথম ১৯৯৬ সালে জাতির পিতার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকারের শুরুতেই কৃত্রিম উপগ্রহনির্ভর ভি-স্যাট প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রথম দেশে সবার জন্য উন্মুক্ত ইন্টারনেট সংযোগ স্থাপন করা হয়। তখন ব্যবহারকারীরা ডায়াল-আপ পদ্ধতিতে ইন্টারনেটে সংযুক্ত হতো। শুরুতে শুধু ৬৪ কেবিপিএস ইন্টারনেট দিয়ে যাত্রা শুরু হয়। যার জন্য ভি-স্যাটের মাসিক ভাড়া ছিল ১০ হাজার মার্কিন ডলার। দীর্ঘ সময়ের পর ২০০৬ সালের ২১ মে সাবমেরিন ক্যাবল সিমিউই-৪-এর সঙ্গে কক্সবাজার জেলা শহরের ঝিলংজা ল্যান্ডিং স্টেশনের মাধ্যমে যুক্ত হয় বাংলাদেশ। যার সক্ষমতা ৩০০ জিবিপিএস। পরবর্তী সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ দ্বিতীয় সাবমেরিন ক্যাবেল সিমিউই-৫-এর সঙ্গে পটুয়াখালীর কলাপাড়ার ল্যান্ডিং স্টেশনের মাধ্যমে যুক্ত হয়। যা প্রথমবারের থেকে ৬ গুণ বেশি ১৮০০ জিবিপিএস সক্ষমতার। বাংলাদেশে ২০১২ সালে থ্রিজি এবং ২০১৮ সালে ফোরজি চালু হয়। বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি)-এর তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে দেশে ইন্টারনেট গ্রাহকের সংখ্যা ১২ কোটি ৬১ লাখের ও বেশি। যার মধ্যে মুঠোফোন ১১ কোটি ৪০ লাখের বেশি এবং ব্রডব্যান্ডে ১ কোটি ২০ লাখের বেশি। বিটিআরসি গ্রাহক পর্যায়ে ইস্টারনেট সেবা প্রদানের জন্য জাতীয়, বিভাগীয়, জেলা, উপজেলা কিংবা থানা পর্যায়ে চার ধরনের লাইন্সেসের অনুমোদন দেয়। আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট গেটওয়ে প্রতিষ্ঠানরা এনটিটিএন (ন্যাশনাল টেকনিক্যাল ট্রান্সফার নেটওয়ার্ক)-এর সহায়তায় উল্লেখিত চার ধরনের প্রতিষ্ঠানকে ইন্টারনেট সেবা প্রদান করে। পরবর্তী সময়ে এই চার ধাপের ব্যবসায়ীরা গ্রাহক পর্যায়ে ব্রডব্যান্ড সংযোগ প্রদান করে থাকে। কিন্তু হতাশাজনক সত্য হচ্ছে, ব্রডব্যান্ড অবকাঠামোতে উপজেলা কিংবা থানা পর্যায়ের ইন্টারনেট ব্যবসায়ীদের নানান সীমাবদ্ধতা, সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হচ্ছে। বর্তমানে এ পেশায় দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। বাংলাদেশের সাধারণ কিংবা ভোকেশনাল শিক্ষা কারিকুলামে বাস্তবমুখী এই ধরনের প্রযুক্তিগত কোনোবিষয় বা ডিসিপ্লিন এখনও চালু হয়নি। কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এসব বিষয়ে কোর্স চালু করলেও তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল্য। যার ফলে দক্ষ জনবলের অভাবে গ্রাহক পর্যায়ে গুণগত মানের ইন্টারনেট সেবা পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। এতে নানা সময় প্যাকেট কিংবা পিং লসের কারণে ব্যান্ডউইথ অপচয় হয়ে থাকে। দক্ষ জনবল তৈরি করা গেলে এ খাতে প্রচুর শিক্ষিত বেকারের কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। এতে এ খাতের উপজেলা পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা যেমন বাঁচত, ঠিক তেমনি দেশের বাইরে ও এই খাতে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল রপ্তানি করা সম্ভব হতো। এতে বিদেশ হতে প্রচুর রেমিট্যান্স আসার খাত সৃষ্টি হতো। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন ২০০১ অনুযায়ী কোনো ইন্টারনেট সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠান পপ, ম্যাক, ডিশ ব্যবসায়ী অর্থাৎ রিসেলার কিংবা তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে ইন্টারনেট সেবা প্রদান করা সম্পূর্ণ অবৈধ। কিন্তু দেশের কিছু অসাধু ইন্টারনেট ব্যবসায়ীর কারণে বিভিন্ন জেলা এবং উপজেলাতে এর প্রেক্ষাপট ভিন্ন। ব্যাঙের ছাতার মতো অবৈধ ইন্টারনেট ব্যবসায়ীর দ্বারা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বৈধ উপজেলা বা থানা পর্যায়ে লাইন্সেসধারী ইন্টারনেট ব্যবসায়ীরা। কিছু অসাধু ইন্টারনেট ব্যবসায়ী প্রচুর মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে অবৈধ ইন্টারনেট ব্যবসায়ী সৃষ্টি করছেন; কিন্তু দিনের শেষে তাদেরও মুনাফার প্রাপ্তিশূন্য। আইনের বিধিনিষেধ সত্ত্বেও কিছু ডিশ ব্যবসায়ী ইন্টারনেট ব্যবসায়ে যুক্ত হওয়ার কারণে উপজেলা পর্যায়ের ইন্টারনেট ব্যবসায়ীরা সঠিক সংযোগ ফি থেকে ও বঞ্চিত হচ্ছেন। পাশাপাশি অধিক মুনাফার আশায় অবৈধ ইন্টারনেট ব্যবসায়ীরা গ্রাহকদের যথাযথ ও গুণগত ইন্টারনেট সেবা দিচ্ছে না। এতে একদিকে যেমন গ্রাহকরা ঠকছে, অপরদিকে প্রচুর রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। বিটিআরসি’র কার্যালয় আছে শুধু রাজধানী ঢাকাতে। তাই সংগত কারণে মাঠ পর্যায়ে ইন্টারনেট কার্যক্রম দেখভাল বা তদারকি করা তাদের পক্ষে অনেকাংশে অসম্ভব। পাশাপাশি বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনে জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অবৈধ ব্যবসায়ীদের দমনে সুস্পষ্ট তেমন কোনো দিকনির্দেশনা কিংবা বিধিবিধান নেই। পাশাপাশি (রিসেলার) গ্রাহকদের তথ্য ও লগ সার্ভার সংরক্ষণে অধিকাংশ সময় উদ্যোগ নেন না। এতে জাতীয় নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়ার আশংকা রয়েছে। বাংলাদেশে অধিকাংশ আর্থিক সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যাংকগুলো তথ্যপ্রযুক্তির বিভিন্ন খাতে অর্থলগ্নী করলেও ইন্টারনেট সেবা খাতে আগ্রহী না। ফলে এখনো প্রয়োজনীয় পুঁজির অভাবে মাঠ পর্যায়ে ব্রডব্যান্ড অবকাঠামো যথেষ্ট দুর্বল। গ্রাহক সচেতনতার অভাবে ও ইন্টারনেট সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দুই ধরনের সেবাগ্রাহকদের প্রদান করা হয়। তা হলো ডেডিকেটেড এবং শেয়ারড। ইন্টারনেট জগতে ডাটা আদান প্রদান হয় বিট এককে। অর্থাৎ ১ এমবিপিএস (মেগাবিট) হচ্ছে ১২৮ কেবিপিএসরে (কিলোবাইট) সমান। উদাহরণস্বরূপ- যদি একজন গ্রাহক ডেডিকেটেড ৫ এমবিপিএস সংযোগ নেন তিনি প্রতি সেকেন্ডে ৬৪০ (১২৮*৫) কেবিপিএস করে ডাউনলোড কিংবা আপলোড ব্যান্ডউইথ গতি পাবেন। অপরদিকে শেয়ার্ড সংযোগগুলো বিভিন্ন রেশিওতে হয়। যদি ১:৮ হলে ৮০ (৬৪০/৮) কেবিপিএস হতে ৬৪০ কেবিপিএস পর্যন্ত ডাউনলোড এবং আপলোড ব্যান্ডউইথ গতি পাবেন। কিন্তু অধিকাংশ গ্রাহক নিজের ব্যবহার চাহিদা অনুযায়ী ইন্টারনেট প্যাকেজ নিতে আগ্রহী নয়। অনেক গ্রাহক ৫০০ টাকার ৫ এমবিপিএস নিয়ে অত্যাধিক ডিভাইস ব্যবহার করতে চান। যার ফলে উপজেলা পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা মুনাফাপ্রাপ্তি তো দূরের কথা, বরং বিনিয়োগকৃত অর্থফেরত পাবার ব্যাপারে সন্দিহান। ব্যান্ডউইথ সীমাবদ্ধতার এই সুযোগটুকু অবৈধ ইন্টারনেট ব্যবসায়ীরা নিয়ে থাকেন। গ্রাহকদের নানা লোভনীয় প্যাকেজ বা অফার দিয়ে আকৃষ্ট করে। এতে উপজেলা পর্যায়ের বৈধ লাইসেন্সধারী ব্যবসায়ীরা মুখ থুবড়ে পড়ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো অনলাইনে ফ্রিল্যান্সিংয়ের চাহিদা বাংলাদেশে ও সৃষ্টি হয়েছে। গ্রামসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রচুর শিক্ষিত বেকারের এ সুবিধা গ্রহণ করার সুযোগ রয়েছে। উপজেলা পর্যায়ের ইন্টারনেট ব্যবসায়ীরাই গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গুণগত মানের নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সেবা অব্যাহত রাখতে পারে, যা ফ্রিল্যান্সিংয়ের মূল চালিকাশক্তি। এ খাতের যথাযথ ব্যবহার করে বেকার যুবকরা উপকৃত ও স্বাবলম্বী হতে পারে। এতে যেমন বেকারত্ব কমবে, তেমনি প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রাও আয় করা সম্ভব। বর্তমানে বাংলাদেশে উপজেলা পর্যায়ে দুই হাজারেরও অধিক লাইন্সেসধারী ব্যবসায়ী রয়েছে। যাদের অধিকাংশই অবৈধ ইন্টারনেট ব্যবসায়ীদের অপকাণ্ড ও দক্ষ জনবল সংকটের কারণে নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। সমস্যায় জর্জরিত ব্যবসায়ীরা ব্যবসাতে মুনাফা তো দূরের কথা, বিনিয়োগটুকু ফেরত পেলেই খুশি। আমি নিজেও চেষ্টা করছি, ব্যবসা বিক্রি করে দিতে। কারণ এ খাতে অসংখ্য সমস্যার যে কালো ছায়া প্রতিনিয়ত ভর করছে, তাতে পরবর্তী সময়ে ব্যবসা বন্ধ করা করা ছাড়া কোনো বিকল্প থাকবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) খাতের উন্নয়নের লক্ষ্যে দেশে ২৮টি হাইটেক পার্ক সম্পন্ন কিংবা চলমান রয়েছে। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি মাইলফলক। আমার বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, প্রধানমন্ত্রীর আইসিটিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার যথাযথ ও সময়োপযোগী উদ্যোগ নিয়ে উপজেলা বা থানা পর্যায়ের লাইন্সেসধারী ইন্টারনেট ব্যবসায়ীদের ব্যবসায়িক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারেন। যথাযথ হস্তক্ষেপ এবং দিকনির্দেশনার ফলে একদিকে ব্যবসায়ীরা যেমন বাঁচবেন, অপরদিকে গ্রাহকদের কাছেও গুণগত মানের ইন্টারনেট সেবা সহজলভ্য হবে, প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থান হবে, সরকারের রাজস্ব ও রেমিট্যান্স আয় বাড়বে ও জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি হ্রাস পাবে। অনেক সমস্যা-সংকটের পরেও আমরা আশায় বুক বাঁধি। বাংলাদেশের প্রতিটি এলাকা ইন্টারনেট প্রযুক্তির আওতায় এসে একদিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে উঠবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ ও সুযোগ্য নেতৃত্বে ডিজিটালাইজেশন’র মাধ্যমে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি স্মার্ট বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে নেতৃত্বের আসন নেবে। বাংলাদেশ রূপান্তরিত হবে উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশে। বিশ্বের বুকে তথ্যপ্রযুক্তিসহ সব খাতে বাংলাদেশ হবে একটি রোল মডেল।

লেখক : সাবেক প্রভাষক, বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব মহিলা কলেজ।