ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

শিশুর মানবিক মূল্যবোধ শিক্ষার মাধ্যমে বিকশিত হোক

মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ, সাবেক প্রকৌশলী ও শিক্ষক, ঢাকা
শিশুর মানবিক মূল্যবোধ শিক্ষার মাধ্যমে বিকশিত হোক

স্কুল পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে বই বিতরণ শুরু হচ্ছে আজ। বছরের শুভ সূচনালগ্নে শিশুর কাছে নতুন বইয়ের গন্ধ শিক্ষার্থীদের কাছে সুখবার্তা বয়ে নিয়ে আসে। শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীদের মধ্যে লেখাপড়ায় নতুন উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের এ ধরনের পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। প্রতি বছর শিক্ষাবর্ষের শুরুতেই দেশের প্রতিটি স্কুলে শিশুদের বিনামূল্যে বই বিতরণের সঙ্গে বেতনও ফ্রি করে দেওয়া হয়েছে। এ থেকে বাদ যাচ্ছে না, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিও। এ নিয়ে শিশুদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের মাঝেও পড়াশোনার বিপুল উৎসাহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তবে শিক্ষার্থীদের শুধু বিনামূল্যে বই বিতরণই সুষ্ঠু শিক্ষাদানের সব কথা নয়। শিশুকাল থেকেই ওরা যাতে শিক্ষার মাধ্যমে মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটাতে পারে, তেমন বিষয়বস্তু সমৃদ্ধ পুস্তক প্রণয়ন করা দরকার। শিশুকে পাঠদানে শিক্ষককে হতে হবে যত্নশীল। নিজের সন্তানের মতো আদর-যত্ন নিয়ে শিশুদের পড়াতে হবে। শিশুর বয়সের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পাঠের বিষয়বস্তু নির্ধারণ করাও জরুরি। শিশুদের জন্য সহজ বোধযোগ্য সিলেবাস, শিক্ষাদান পদ্ধতি, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, মূল্যায়ন ও ফলাফল নিয়ে রয়ে গেছে নানা বিতর্ক। বিশেষ করে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিকে শিশুর জন্য বইয়ের বোঝার বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। শিশুর ওজনের ১০ শতাংশের বেশি বইয়ের বোঝা বহনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারিও করা হয়েছে। সকাল হতে না হতেই দলে দলে শিশু পিঠে বিশাল আকারের স্কুলব্যাগ নিয়ে স্কুলের পথে রওনা হয়। ব্যাগ যত ভারিই হোক না কেন, শিশুকেই তা বহন করে স্কুলে সময়মতো পৌঁছতে হয়, অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে। দেশে আজও শিশুদের গমনাগমনের জন্য স্কুল বাস ব্যবহারের সুযোগ গড়ে ওঠেনি। পরিবারের নিজস্ব গাড়িও ব্যবহারের সুযোগ বেশিরভাগ শিশুর নেই। কাজেই অনেককে রিকশা বা ভ্যানে করে স্কুলে যাওয়া-আসা করতে হয়। নিম্ন ও নিম্নবিত্তের অনেক শিশুকে হেঁটে ভারি ব্যাগ পিঠে ঝুলিয়ে স্কুলে যেতে তাদের ভার বহনজনিত স্বাস্থ্য জটিলতা দেখা দিতে পারে। শিশুশিক্ষার সুবচনগুলো আজ নির্বাসনে। ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারা দিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি’ ‘সদা সত্য কথা বলিবে’ এ ধরনের কোনো নীতিবাক্য আজ শিশুদের মুখে উচ্চারিত হতে শোনা যায় না। ভালো কাজের চর্চা শিশুদের মাঝে খুব একটা চোখ পড়ে না। আজকের দিনের শিশু-কিশোররা কেউ খুব বেশি প্রয়োজন না হলে সকালে ঘুম থেকে ওঠে না। তারা অনেক রাত করে ঘুমায়, ওঠে দেরি করে। সকালের সূর্যের আলো, নির্মল বাতাস সবই ওদের অচেনা। আজকাল আমাদের দেশে শিশুশিক্ষার পাঠ্যক্রমে মূল্যবোধ বিকাশের জন্য অতি প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো, তেমন স্থান কম। সীতানাথ বসাকের আদর্শলিপির সুবচনগুলো নির্বাসনে গেছে সেই কবে। বাবা-মায়েরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সন্তানের বেড়ে ওঠার ব্যাপারে সচেতন নন। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকরা পাঠ্যক্রমের বাইরে তার শিক্ষার্থীকে, তেমন কিছু শেখানোর তাগিদ অনুভব করেন বলে মনে হয় না। আজকাল ধর্মশিক্ষার নামে পাঠ্যপুস্তকে যা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে তার অন্তর্নিহিত সূক্ষ্মবিষয়গুলো শিক্ষার্থীদের হৃদয়ঙ্গম করে বাস্তব জীবনে প্রতিষ্ঠিত করার তেমন সুযোগ নেই। সন্তানের মা-বাবারাও তাদের জীবনের স্থূল চাহিদায় এত ব্যস্ত থাকেন যে, সন্তানের চরিত্র গঠনের দিকে খেয়াল রাখার সুযোগ তাদের কম। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গৃহকর্মীর ওপর সন্তানের দায়-দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চান তারা। কখন পাঠিয়ে দেন শিশুপালন কেন্দ্রে চাকরিজীবী নারীর এ ছাড়া উপায়ও থাকে না অনেক ক্ষেত্রেই। শিশু মন হচ্ছে কাদামাটির মতো। তাকে যেভাবে ইচ্ছা গড়ে তোলা সম্ভব। প্রয়োজন শুধু সুষ্ঠু পরিচর্যা। এসবের প্রতি যত্নশীল না হয়ে আজকাল কর্মব্যস্ত জীবনের জাঁতাকলে পিষ্ট মা-বাবা সন্তানের মানসিক বিকাশের পথরুদ্ধ করে দিচ্ছেন। জাগতিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য লাভের প্রত্যাশায় শিশুর সামনে তুলে দিচ্ছেন কতগুলো ভারি বই। সারাদিন তাকে ব্যস্ত রাখেন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদানে। শুধু ভালো একটি স্কুলে ভর্তির টার্গেট নিয়ে একজন শিশুর জীবনের যে শুরুটা হয়, তার পরিসমাপ্তি ঘটে নামি-দামি বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্ণিল একটি সনদপত্র প্রাপ্তির মাধ্যমে। শিক্ষা হচ্ছে চরিত্র পরিবর্তনের সুস্পষ্ট লক্ষণ, সচ্চরিত্র গঠনই শিক্ষার মুখ্য উদ্দেশ্য। ঘরে বাবা-মা, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক বা পারিপার্শ্বিকতার থেকে শৈশব-কৈশোরে যে মানবিক মূল্যবোধের সূক্ষ্ম বিষয়গুলোর বীজ বপন করেন তা সঞ্চারিত হয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এবং এসব গুণাবলি একজন মানুষের জীবনে স্থায়ী প্রভাব ফেলে। আর তা মানুষকে সব পাপাচার থেকে দূরে রেখে সুন্দর পরিচ্ছন্ন জীবনযাপনে সাহায্য করে। বাংলাদেশে শিক্ষার হার বাড়ছে। প্রতি বছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছে। বিশাল শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর অনেকেই নিয়োজিত হচ্ছেন দেশ-বিদেশের নানা কর্মকাণ্ডে। কেউ কেউ বহাল হচ্ছেন রাষ্ট্রের অনেক দায়িত্বপূর্ণ পদে। আমাদের দেশে আজকাল একজন শিক্ষার্থীর ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যারিস্টার, ব্যবসায়ী বা বড় আমলা হওয়ার ইচ্ছা মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। একজন ভালো মানুষ হয়ে গড়ে ওঠার আসল লক্ষ্য হয়ে যায় গৌণ। জীবনে বিত্তশীল হয়ে ওঠার নেশায় নষ্ট করে দেওয়া হয় শৈশব-কৈশোরের সব আনন্দ আয়োজন। বন্ধ ঘরে বই আর কম্পিউটারের চাপে তাকে নিয়ত থেকে হয় পিষ্ট। মাঠে, খোলা সবুজে মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস টেনে, কিছু সময় দিয়ে প্রকৃতি থেকে কিছু শিখে বড় হওয়ার কোনো সুযোগই আজকালকার শিশুদের নেই। নেই খেলাধুলা করে শারীরিক ও মানসিক উৎকর্ষ লাভের কোনো স্থান। তারা খানিক সুযোগ পেলে রাস্তায় ক্রিকেটের ব্যাটবল নিয়ে খেলার নামে প্রহসন করে। শিল্প, সংস্কৃতি চর্চা থেকে একেবাবেই দূরে সরিয়ে রেখে শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশ সম্ভব নয়। সীমিত গণ্ডির মাঝে বিচরণ করে বৃহত্তর পরিসরে আত্মীয়স্বজন পরিবেশ সান্নিধ্যে থেকে সুকুমার বৃত্তি চর্চার তেমন কোনো সুযোগ থাকে না। ঘরে, শিক্ষায়তনে চারপাশের কোথাও তেমন মূল্যবোধের বিকাশ ঘটানোর খুব একটা সুযোগ তার নেই। জীবনে বিপুল অর্থ-সম্পদ গড়ার পেছনে ছুটে চলার দুর্নিবার নেশা তাকে চেপে ধরে জীবনের শুরুতে। বিত্তবৈভব আর প্রাচুর্যে জীবনকে রাঙিয়ে তোলার প্রবল বাসনা মানুষের ভেতরকার জীবনবোধকে ক্রমেই কুরে কুরে খেতে থাকে। একসময় সে নিজের অজান্তেই হারিয়ে ফেলে জীবনের মূল চালিকাশক্তি সততা ও নিষ্ঠার মতো গুণাবলি। আজকাল প্রয়োজন ছাড়াই অনেক মা-বাবা অথবা অভিভাবক সামান্য স্কুলপড়ুয়া ছোট্ট ছেলেমেয়েদের হাতে তুলে দেন নামিদামি ব্র্যান্ডের মোবাইল ফোনসেট। এ যুগে কেউ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রসরমান ধারার বিপক্ষে নয়। অনেক ক্ষেত্রে মোবাইল ফোনের অপব্যবহারে শিশু-কিশোর অপরাধ সংঘটিত করতে সাহায্য করছে। আমরা আমাদের সন্তানকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে ব্যর্থ হচ্ছি। একজন শিশু-কিশোরকে যদি তার মা-বাবাই বিপথগামী হতে বাধা দিতে না পারেন তাহলে স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বা অন্য কারও পক্ষে এ কাজটি করা সহজ নয়। আজ বাংলাদেশের সর্বত্র নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য, জীবন রক্ষাকারী ওষুধপত্রে ভেজাল মিশিয়ে মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। মানুষ নামধারী একদল অমানুষ অবুঝ শিশু-কিশোরকে পিটিয়ে মেরে উল্লাস করে, নিজেরাই ভিডিও চিত্র ধারণ করে, তা নেটে ছেড়ে নিজেদের বীরত্ব জাহির করে। কোনো মানুষ কি তার স্ত্রীর মুখে এসিড ছুড়ে পুড়িয়ে মারতে পারে? বোমা মেরে শত শত নিরীহ মানুষ হত্যা কোনো মানুষের দ্বারা সম্ভব? নারী নির্যাতন, যৌতুকের বলি, অবুঝ শিশু ধর্ষণ মানুষ কীভাবে করে! একজন কিশোর কীভাবে ধর্ষণের মতো কাজে লিপ্ত হয়! শিশু ধর্ষণের মতো অপরাধ কেমনে সংঘটিত হয় একটি সভ্য সমাজে? মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। মানবতা সব ধর্মের মূলমন্ত্র। উপযুক্ত শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে মানুষের মনে সঠিক দায়িত্ব পালন এবং কর্তব্যবোধের সৃষ্টি হয়। সুশিক্ষা বিকাশ ঘটায় মানবিক মূল্যবোধের। ঘরে বাবা-মা, অভিভাবকের কাছ থেকে শিশুকালে যে শিক্ষা শুরু হয়, তার ধারাবাহিকতা চলে আমৃত্যু। মা-বাবাই শিশুর শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। পরবর্তী সময়ে শিক্ষক এবং পারিপার্শ্বিকতা থেকে উপযুক্ত শিক্ষা গ্রহণই মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটাতে পারে। শিক্ষায়তনে সুশিক্ষা বিস্তৃত হলে সেখান থেকে একজন মানবিকতা গুণসম্পন্ন হয়ে ওঠার সুযোগ পেতে পারে। তাই শিশুশিক্ষা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের শিক্ষার মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ ঘটানোর মতো পাঠ্যক্রম সন্নিবেশিত করে যোগ্য শিক্ষকের মাধ্যমে পাঠদান নিশ্চিত করা প্রয়োজন। যাতে জীবনের শুরুতেই একজন মানুষ সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পরিচিত হতে পারে। কেননা- সততা, নিষ্ঠাবোধ ছাড়া মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টি হয় না। আর মানবিক মূল্যবোধ ব্যতীত মানুষ কখনো মানুষ হয়ে বেঁচে থাকতে পারে না। কাজেই সমাজ কাঠামোর প্রতিটি স্তরে মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধের পরিবেশ সৃষ্টি করার দায়িত্ব নিতে হয় পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে। মানুষ হচ্ছে এ সমাজ ও রাষ্ট্রের চালিকাশক্তি। সুশিক্ষার মাধ্যমে অর্জিত মানবিক মূল্যবোধ দ্বারাই গড়ে তোলা সম্ভব বৈষম্যহীন, সবার বসবাসযোগ্য আলোকিত পৃথিবী। আজকের শিশু আগামী দিনে সুনাগরিক হয়ে দেশ ও দশের সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারে, সেই চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে জন্মের ঊষালগ্ন থেকে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত