ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ডেঙ্গু পরিস্থিতি

জরুরি অবস্থা মোকাবিলায় দরকার সমন্বয়মূলক ব্যবস্থা

ডা. মুশতাক হোসেন
জরুরি অবস্থা মোকাবিলায় দরকার সমন্বয়মূলক ব্যবস্থা

২৩ বছরে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে সর্বোচ্চ মৃত্যুর খবর ৪ আগস্ট সংবাদমাধ্যমে জানা যায়। ডেঙ্গু এরই মধ্যে মহামারির রূপ নিয়েছে। তবে ডেঙ্গু যে এবারই মহামারির রূপ ধারণ করেছে- বিষয়টি এমনও নয়। ২০২২ সালেও ডেঙ্গু মহামারির রূপ ধারণ করেছিল। সেই হিসেবে এই মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ ২০২২ সালে ছিল এবং তৃতীয় ঢেউটি চলছে চলতি বছর। ধারাবাহিক এই ২ বছর হাসপাতালগুলো ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় ব্যস্ত সময় পার করছে। সংবাদমাধ্যম বলেছে, ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে সচেতনতার অভাবে। রোগী দেরিতে আসছেন হাসপাতালে। ঘাটতি আছে কৌশলগত পর্যবেক্ষণে। ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরো নাজুক হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। এমতাবস্থায়, ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনা আরো কঠিন হতে পারে। দ্রুত এসব কিছু আমলে রেখে পরিকল্পনা অনুযায়ী আরো দূরদর্শি কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার বিকল্প নেই। ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগিতা চেয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তরফেও সহযোগিতার আশ্বাস পাওয়া গেছে। ডেঙ্গুর টিকা পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। সর্বসাধারণকে টিকা দেওয়ার মতো অবস্থা এখনও তৈরি হয়নি। তারপরও এই টিকা ডেঙ্গুর চারটি ধরনকেই কিছুটা হলেও প্রতিহত করতে সাহায্য করবে এবং মৃত্যুঝুঁকি কিছুটা হলেও নিম্নগামী করবে। আপাতত এই টিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থার অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদনের পাশাপাশি ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমোদন নেওয়ারও প্রয়োজন হবে। যদি সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের অনুমোদন পাওয়া যায়, তাহলে অবশ্যই আমরা টিকাদান কর্মসূচি চালু করতে পারব এবং করাটা জরুরিও বটে। ডেঙ্গু আমাদের জনস্বাস্থ্যের জন্য নতুন হুমকি নয়। অতীতেও কয়েকবার ডেঙ্গু সংক্রমণ আমাদের সামনে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তখন ডেঙ্গু প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার সতর্কবার্তার পাশাপাশি নানা পরামর্শ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং কীটতত্ত্ববিদরা একাধিকবার দিয়েছেন। এ সতর্কবার্তা ও পরামর্শ সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা কতটা আমলে নিয়েছেন- এ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে জনস্বাস্থ্য অধিক হুমকির মুখে পড়ছে। বাড়ছে নানারকম সংক্রমণের আশঙ্কা। বিশেষত মশাবাহিত রোগ বড় ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কীটতত্ত্ববিদরা এরই মধ্যে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে মশার বংশবৃদ্ধির উপায় পরিবর্তনের বিষয়ে সতর্ক করেছেন। ডেঙ্গু মোকাবিলার কৌশলের পরিবর্তন আনার তাগাদা এখনও অনেকে দিয়ে যাচ্ছেন। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা নানা পদক্ষেপ নিয়েছেন। কিন্তু কোনো পদক্ষেপই দৃশ্যমান সুফল এনে দেয়নি। সময়োপযোগী পরিকল্পনা নিতে না পারায় স্বাস্থ্য খাতে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগও কম নয়। ডেঙ্গু মোকাবিলায় জনস্বাস্থ্য সচেতনতা কার্যক্রম চালু হয়েছে। কিন্তু দায়িত্বশীল কারও কারও অবহেলা এবং মানুষের মধ্যে নিজেকে নিরাপদ রাখার বিষয়ে সচেতনতার অভাব থাকায় সমন্বয়সাধন হচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা ডেঙ্গুকে একটি মৌসুমি রোগ হিসেবে বিবেচনা করে বছরের নির্দিষ্ট সময় ডেঙ্গুর লার্ভা নিধনের জন্য ওষুধ ছিটিয়েই দায়িত্বপর্ব সম্পন্ন করতেন। সম্প্রতি তারা বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন এবং কিছু পদক্ষেপও নিতে শুরু করেছেন। বিলম্বিত উদ্যোগের এই সুফল কতটা মিলবে তা এখনই বলা যাবে না। পরিস্থিতি যখন মহামারির আকার ধারণ করে, তখন ভালো পদক্ষেপও পদে পদে বাধাগ্রস্ত হতে শুরু করে। ডেঙ্গু নিয়ে সারা বছর কাজ করতে হবে এবং তা যেন কোনোভাবেই ভয়াবহ রূপ ধারণ না করে, সেজন্য যেকোনো পর্যায়ে প্রস্তুতি রাখতে হবে, এ ধারণা দায়িত্বশীলদের বোধে অনেক দেরিতে এসেছে। এই বোধ আসার পরও ডেঙ্গু মোকাবিলার জন্য আমরা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় প্রস্তুত নই এ অভিযোগও উড়িয়ে দেয়ার নয়। যেকোনো মহামারি কিংবা স্বাস্থ্য খাতে জরুরি অবস্থায় পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য একটি সমন্বিত কেন্দ্র প্রয়োজন হয়। আমাদের এখনও এই সমন্বিত কেন্দ্র গড়ে ওঠেনি। ডেঙ্গু প্রতিরোধে সবাই আলাদা আলাদা কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু মহামারি মোকাবিলায় যে সমন্বয় প্রয়োজন, তা এখনও গড়ে ওঠেনি। ইন্টিগ্রেটেড কন্ট্রোল সেন্টার স্থানীয় সরকার কিংবা জাতীয় পর্যায়ে থাকতে পারে। তা ছাড়া একটি সিঙ্গেল কমান্ড সিস্টেম থাকবে, যারা এই জরুরি অবস্থা মোকাবিলায় নেতৃত্ব দেবেন। ফলে একটি সরলরেখা তৈরি হবে এবং জবাবদিহিও নিশ্চিত হবে। যদি তা না করা হয়, তাহলে যেকোনো মহামারি আমাদের নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। স্বাস্থ্য খাতে জরুরি অবস্থা দেখা দিলে নেতৃত্ব, জবাবদিহি, পরিকল্পনার দ্রুত বাস্তবায়ন এবং সমন্বয়সাধন অত্যন্ত জরুরি। কারণ স্বাস্থ্য খাত আর ১০টা খাতের মতো নয়। এ ব্যাপারে দেখা গেছে, দায়িত্বশীলরা একে অপরের ওপর দায় চাপাচ্ছেন। এমন জরুরি অবস্থায় এভাবে দায় চাপালে অবস্থার পরিবর্তন তো ঘটবেই না, বরং পরিস্থিতি ক্রমেই নাজুক হবে। শুধু জরুরি পরিস্থিতি নয়, সাধারণ পরিস্থিতিতেও এমনটি কাম্য নয়। সরকার ও জনসাধারণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশের প্রতিটি ব্যবস্থা সুসংহত হবে। কিন্তু আমরা তা না করে একে অপরের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে দিই। তবে আশার কথা হলো, সম্প্রতি তারা এই পথ ত্যাগ করে নিজেদের দায়িত্ব আন্তরিকতার সঙ্গে পালনের চেষ্টা করছেন। তবে এখন একটি সমন্বিত ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা স্থানীয় সরকার যে কেউই দায়িত্ব নিতে পারে। প্রয়োজনে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে একটি ভালো ব্যবস্থা গড়ে নেওয়া বাদেও মন্ত্রিপরিষদ দ্বারা বিশেষ ব্যবস্থা পরিচালিত হতে পারে। সদিচ্ছা থাকলে সমন্বয়ের জন্য নানা কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা যায়। করোনা মহামারির সময়ে এবং টিকাদান কর্মসূচির সময় এমন সমন্বয় আমরা দেখতে পেয়েছি। তখন ক্যাবিনেট ডিভিশনের তদারকি করেছে। ডেঙ্গুর ক্ষেত্রেও আমাদের এমন একটি সমন্বয়মূলক নেতৃত্ব ও ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে দ্রুত। করোনা মহামারিতে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাব্যয়ের মধ্যে বিস্তর ফারাক দেখা গেছে। একই অবস্থা দেখা যাচ্ছে ডেঙ্গু পরিস্থিতিতেও। বিষয়টি শুধু সমন্বয়ের অভাব বললে ভুল হবে। বলা যায়, সরকারি নীতির অভাবের ফলে স্বাস্থ্য খাতে অবাধ বাণিজ্যের পথ উন্মুক্ত। খাদ্য, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা মানুষের মৌলিক চাহিদা। অবশ্যই ব্যবসা হবে এবং মুনাফাও লাভ করবে, কিন্তু তা অবাধ বাণিজ্যে পরিণত হতে পারে না। পশ্চিমা বিশ্বও খাদ্য, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাকে উন্মুক্ত বাজারে ছেড়ে দেয়নি। তারা সরকারি নীতিমালা প্রণয়ন করেছে এবং তার মাধ্যমে স্বচ্ছতা-দায়বদ্ধতা-জবাবদিহি নিশ্চিতকরণে দৃঢ় থেকেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবশ্য স্বাস্থ্য খাতকে উন্মুক্ত বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তারপরও সেখানে কিছু নীতিমালা রয়েছে। এই নীতিমালা সেবাগ্রহীতা এবং যারা সেবাপ্রদান করবেন তাদের সুনির্দিষ্ট নিয়ম অনুসরণের তাগাদা দেয় এবং এর ব্যত্যয় ঘটলে উপযুক্ত শাস্তির বিধান রয়েছে। শুধু জরুরি অবস্থাই নয়, সাধারণ অবস্থাতেও সরকারি নীতিমালার বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। আমাদের এখানে তেমন কোনো নীতিমালা নেই। বিশেষত জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষায় জরুরি পরিস্থিতিতে আমাদের অবাধ বাণিজ্যের পথরুদ্ধ করার দিকে মনোযোগ আরো গভীর করতেই হবে। জরুরি অবস্থায় বেসরকারি খাত মুনাফা নিয়ন্ত্রণ করে সেবাপ্রদান করবে। সেবাপ্রদান করতে গিয়ে তাদের কোনো ক্ষতি হলে এর দায়ভার নেবে সরকার। করোনা মহামারি সময়ের মোকাবিলায় আমাদের অভিজ্ঞতা যথেষ্ট পুষ্ট। মানুষকে জিম্মি করে অবাধ বাণিজ্য উচিত নয়। এক্ষেত্রে সরকারকে দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে। বেসরকারি খাতের অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে কিছু বিষয়কে ঐকমত্যে পৌঁছতে হবে। বাজারে এই মুহূর্তে স্যালাইনের সংকট দেখা দিয়েছে। অনেকের অভিযোগ, অসাধু মহল বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করছে। স্যালাইন উৎপাদনে আমাদের সক্ষমতা রয়েছে। হতে পারে জরুরি এই পরিস্থিতিতে বাজারে স্যালাইন সরবরাহে কিছুটা ঘাটতি রয়েছে। মহামারির সময় কোনো ওষুধের অভাব হতেই পারে। তবে পরিস্থিতি বিবেচনা করে অনেক আগে থেকেই কিছু বিষয়ে প্রস্তুতি রাখা প্রয়োজন ছিল। যেহেতু স্যালাইন উৎপাদনে আমাদের সক্ষমতা রয়েছে, তাই দ্রুত বাজারে স্যালাইন সরবরাহের ব্যবস্থা নিতে হবে এবং স্যালাইনের দাম যেন অহেতুক না বাড়ে, সেজন্য বাজারে তদারকি বাড়াতে হবে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান জরুরি। ম্যালেরিয়ার প্রকোপ যখন বেড়েছিল, তখন ম্যালেরিয়া ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মাধ্যমে ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ করা গিয়েছিল। ডেঙ্গুর ক্ষেত্রেও একই বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। পরিস্থিতি অনুযায়ী করণীয় সব কিছু করতে হবে। করোনার আগে মশাবাহিত রোগ নিয়ে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে তা বাস্তবায়ন আর সম্ভব হয়নি। এখন জরুরি হলো, বিদ্যমান পরিস্থিতি আমলে রেখে সমন্বিত এবং কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত