পোশাকশিল্পে সম্ভাবনার অপ্রচলিত বাজার

অলোক আচার্য, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

প্রকাশ : ১২ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

পোশাকশিল্প আমাদের অর্থনীতির প্রাণ। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির অগ্রযাত্রারা সঙ্গে আশির দশকে যে শিল্পযাত্রা শুরু করে, সেই পোশাকশিল্পই আজ আমাদের অর্থনীতির প্রধান নিয়ামক। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে আমরা পেছনে ফেলেছি পোশাক রপ্তানির বড় বড় দেশকে। আজ বাংলাদেশ তৈরি পোশাকের এক অন্যতম দেশ। যাত্রা শুরুর পর থেকে অর্থনীতিতে এ খাতের অবদান ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়েছে। কয়েকটি থেকে কয়েক হাজার পোশাক কারখানা হয়েছে। পোশাকশিল্প আমাদের অর্থনীতিতে গতির সঞ্চার করে দেশকে একটি গতিশীল অর্থনীতির দেশে পরিণত হতে সাহায্য করেছে। আমাদের অর্থনীতিতে সর্বাধিক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত তৈরি পোশাকশিল্প। এই খাতে সৃষ্টি হয়েছে বিপুল সংখ্যক কর্মসংস্থান। আর কর্মসংস্থানের একটি বড় অংশই নারী। যা দেশের নারীদের সাবলম্বী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। এ নারীদের একটি বড় অংশই অল্পশিক্ষিত বা অশিক্ষিত। করোনা অতিমারি শুরু হওয়ার পর থেকে অন্যান্য খাতের মতোই পোশাক খাতেও তার আঘাত লাগে। ক্রেতারা অর্ডার বাতিল করতে থাকে। পরিস্থিতি সামাল দিতে কেউ কেউ কর্মী ছাঁটাইয়ের পথে হাঁটতে বাধ্য হয়। করোনা অতিমারিতে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। করোনার দুর্দিন কাটিয়ে এখন সুদিন ফিরতে শুরু করেছে পোশাকশিল্পে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে পোশাকশিল্পকে কেন্দ্র করে দেশের অর্থনীতি বেগবানের স্বপ্ন গড়ে উঠছে। আমাদের স্বপ্ন এখন ম্যান মেইড ফাইবারে পোশাক উৎপাদন করে অন্য দেশগুলোকে পেছনে ফেলা। গত এক দশকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বড় অর্থনীতির দুই দেশ ভারত ও পাকিস্থানের রপ্তানি কমলেও একই সময়ে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের রপ্তানি বেড়েছে শতকরা ৮০ শতাংশ। দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা ও পরিশ্রমের ফলে এ বাজারের সুনাম অর্জিত হয়েছে। আর এ কারণে বেড়েছে বিশ্বস্ততা। পোশাকশিল্পে প্রচলিত এবং অপ্রচলিত দুই ধরনের বাজার রয়েছে। অপ্রচলিত বাজারে পোশাক রপ্তানিতে গুরুত্ব প্রদান করায় সেখানে সাফল্যও আসছে। তৈরি পোশাক খাতে অপ্রচলিত বাজার যেমন ভারত, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া এবং জাপানের মতো দেশগুলোতে সাফল্য আসছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ইউরোপের ২৭টি দেশে সাড়ে ২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। এদিকে গত অর্থবছরে ভারত, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া ও জাপানে ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি পণ্য রপ্তানি করেছে দেশের গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরা। এর বাইরে চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতেও রপ্তানি বেড়েছে। ভালো খবর হলো, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানির পরিমাণে চীনকে প্রথমবারের মতো টপকে শীর্ষে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। ইইউর বাজারে গত বছর অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশ সর্বোচ্চ ১৩৩ কোটি কেজির সমপরিমাণ তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে। অন্যদিকে চীন রপ্তানি করছে ১৩১ কোটি কেজির সমপরিমাণ তৈরি পোশাক। গত বছর ইইউতে পোশাক রপ্তানি ২১ দশমিক ২০ শতাংশ বেড়েছে। ইউরোস্ট্যাটের তথ্য দিয়ে তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ গত সোমবার এ তথ্য জানিয়েছে। বিজিএমইএয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে অপ্রচলিত বাজার হিসেবে জাপানে রেকর্ড দেড় বিলিয়নের বেশি, জাপান ও ভারতে এক বিলিয়নের বেশি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। পাশাপাশি রাশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ায় ৫০ কোটি ডলারের বেশি রপ্তানি হয়েছে। তথ্যে আরো জানা যায়, ৪৬ দশমিক ৮০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৪৬ দশমিক ৯৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় হয়েছে, যা গত অর্থবছরের চেয়ে সাড়ে চার বিলিয়ন মার্কিন ডলার বেশি। আর প্রচলিত বাজারের চেয়ে নতুন বাজারের অগ্রগতি হয়েছে ৩১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। সুতরাং এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- পোশাকশিল্পের অপ্রচলিত বাজার। যা এর মধ্যেই আশার আলো দেখাচ্ছে। বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে নতুন বাজারের মধ্যে সর্বোচ্চ পোশাক রপ্তানি হয়েছে জাপানে, ১৬০ কোটি ডলারের। এই রপ্তানি তার আগের বছরের তুলনায় ৪৫ দশমিক ৬২ শতাংশ বেশি। বাজারটিতে ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছরে যথাক্রমে ৯৪ ও ১১০ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছিল। পোশাক রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে অপ্রচলিত বাজারের ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। বর্তমানে মোট শিল্প খাতে নিয়োজিত শ্রমশক্তির ৩৩ শতাংশ এই খাতে নিয়োজিত। শুধু আমাদের দেশ না, বিশ্বের বড় বড় দেশের শিল্পও ধাক্কা খেয়েছে পরপর দু’টি ধাক্কায়। প্রথমে করোনা মহামারির ধাক্কা এবং তার পরেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এত সব সমস্যা সামাল দিয়েই তৈরি পোশাকশিল্প এগিয়ে চলেছে। প্রচলিত বাজারে লক্ষ্যমাত্রা মাঝেমধ্যে ধাক্কা খেলেও অপ্রচলিত বাজার সেই জায়গা দখল করছে। এটা একটা ভালো দিক এবং এভাবে বিকল্প বাজার খুঁজে বের করতে হবে। কারণ ভবিষ্যৎ পৃথিবী আরো বেশি চ্যালেঞ্জিং হবে। উত্তেজনাকর বিশ্বে যুদ্ধ পরিস্থিতি যে একেবারে শান্ত হবে- হলেও সেটা কতদিনে তা বলা সম্ভব না কারো পক্ষেই। বিশ্ব রাজনীতিতে যে কোনো সময় যে কোনো অঞ্চল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। ফলে একক কোনো বাজার বা দীর্ঘদিনের নির্ভরশীল বাজারের দেশগুলোর অর্থনীতি আমাদের অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলবে। ফলে অপ্রচলিত বাজারে প্রবেশ জোরদার করতে পারলে পোশাকশিল্পে নতুন সম্ভাবনা দেখাবে। দেশের পোশাক রপ্তানির প্রধান বাজার ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। এর বাইরের বাজারগুলো অপ্রচলিত বাজার হিসাবে পরিচিত। এ বাজারের মধ্যে রয়েছে জাপান, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া, ভারত, কোরিয়া রিপাবলিক, চীন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মেক্সিকো, সৌদি আরব, তুর্কি, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড, চিলি, ব্রাজিল ও অন্যান্য দেশ। এই দেশগুলোর বাইরেও অপ্রচলিত বাজার হিসেবে নতুন এবং ঝুঁকিমুক্ত বিনিয়োগের দেশ খুঁজে বের করতে হবে। এটি আমাদের অর্থনীতির প্রাণস্বরূপ। করোনায় শিল্প খাত টিকে রাখার স্বার্থে সরকার যে বড় অঙ্কের প্রণোদনা ঘোষণা করে তার শুরু হয়েছিল পোশাকশিল্প দিয়ে। সৃষ্ট সমস্যা মোকাবিলা করে পোশাক কারখানাগুলো ফের ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। সেই সঙ্গে আমাদের অর্থনীতিও শক্তিশালী হচ্ছে। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির দেশ থেকে শিল্পভিত্তিক অর্থনীতি বিশেষত পোশাকশিল্প উত্তরণের এই চিত্র দেশের অর্থনীতিকেই পাল্টে দিয়েছে। পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানার সংখ্যার দিক থেকেও বিশ্বে শীর্ষে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ পোশাক শিল্পের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় ক্রমেই শক্তিশালী অবস্থানে যাচ্ছে। মুখোমুখি হতে হবে শক্তিশালী দেশগুলোর সঙ্গে। সেসব দিক বিবেচনায় পোশাকশিল্পের বিদ্যমান প্রতিকূলতা অবকাঠামোগত সুবিধা বৃদ্ধি, উৎপাদন খরচ হ্রাস, পণ্য সরবরাহের সক্ষমতা বৃদ্ধি প্রভৃতি ক্ষেত্রে উন্নয়ন ঘটাতে হবে। বাংলাদেশের মতো দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলা দেশের জন্য এ রকম একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প পূর্ণ গতিতে চলা আবশ্যক। পোশাকশিল্পের মতো রপ্তানিমুখী একটি শিল্প যা আমাদের দেশের অর্থনীতিকে চাঙা করেছে, চাকরির বাজারে মহাগুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, দেশে এবং দেশের বাইরে বাংলাদেশের পোশাকের একটি অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। এ ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। আরো মজবুত করতে হবে। নতুন বাজার খুঁজে বের করতে হবে। যেগুলো আছে, সেখানে আরো জোর দিতে হবে। মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি ও জীবনমান উন্নয়নে অবদান রেখে চলেছে। প্রায় ৪০ লাখের বেশি নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছে পোশাকশিল্প। এর মধ্যে শতকরা ৭০ ভাগই নারী। প্রত্যন্ত অঞ্চলের অবহেলিত নারীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে টিকে থাকতে একটি শিল্পকে এগিয়ে নিতে সঠিক পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। বিশ্ব অর্থনীতির ধারায় এ খাতেও মাঝেমধ্যেই রপ্তানি শঙ্কা তৈরি হয়। তবে বাজারের বৈচিত্র্যতার দিকে নজর দিলে এ শঙ্কা অনেকটাই কমে আসবে। পোশাকশিল্পও গতি পাবে। এছাড়াও পোশাকশিল্পের অত্যাবশ্যকীয় উপাদান বিশেষত সুতার মূল্য কম রাখা এবং পোশাক শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে জোর দিতে হবে। তাদের নিরাপত্তা এবং সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। পোশাকশিল্পকে এগিয়ে নিতে প্রয়োজনীয় সব ধরনের উদ্যোগের বাস্তবায়ন করা জরুরি।