অভিমত

অসুস্থতা যখন অপরাধ এবং এর শাস্তি

রাশেদ হোসেন

প্রকাশ : ১২ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

অসুস্থতা নিয়ে যখন আমরা চিকিৎসকের কাছে যাই, স্বাভাবিকভাবেই আমাদের প্রত্যাশা থাকে চিকিৎসক যত্ন নিয়ে দেখবেন। মন দিয়ে সমস্যাগুলো শুনবেন। পর্যবেক্ষণ ও কথোপকথনের মধ্যদিয়ে রোগ শনাক্তের চেষ্টা করবেন। রোগীর প্রতি মানবিক হবেন। প্রয়োজনে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসা দেবেন। কিন্তু এই প্রত্যাশার কতটুকু পূরণ হয়? আমরা কি সত্যিকার অর্থে অসুস্থতার প্রতিকার পাই নাকি অসুস্থ হওয়ার অপরাধের শাস্তি পাই? চলুন, কিছু ঘটনার মধ্যদিয়ে আলোচনা করা যাক। সম্প্রতি ঢাকার সেন্ট্রাল হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় মা ও নবজাতকের মৃত্যু হয়। পত্রপত্রিকায় প্রতিদিন এ রকম কিছু সংবাদ ভেসে আসে যাতে মনে হয় ‘অসুস্থতা’ একটি অপরাধ এবং এই অপরাধের শাস্তি ভোগ করে রোগীরা। অবশ্য প্রতিদিন ঘটে যাওয়া এমন অনেক ‘শাস্তির’ তথ্য থেকে যায় লোকচক্ষুর অন্তরালে। গত ১৭ জুলাই চিকিৎসকদের সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে ধর্মঘটের যে ডাক দেওয়া হয়, তাতে সারা দেশের রোগীরা চরম দুর্ভোগে পড়েন। এমনিতেই সরকারি হাসপাতালে অধিকাংশ চিকিৎসকের দায়িত্বের প্রতি অবহেলা এবং বেসরকারি হাসপাতালে দালালচক্র ও মুনাফালোভীদের দাপট দেখা যায়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চিকিৎসকদের ধর্মঘট। গাইনি ও পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ট্রেইনি চিকিৎসক ছাড়াও সম্প্রতি বগুড়া, রাজশাহী ও খুলনাসহ বিভিন্ন স্থানে চিকিৎসক ধর্মঘট হয়েছে। সবক্ষেত্রেই অসুস্থ ব্যক্তিদের চরম দুর্ভোগ পড়তে হয়েছে। যেন অসুস্থ হওয়ার শাস্তি, রোগী হওয়ার অপরাধের শাস্তি। চিকিৎসা ব্যবস্থায় এখন হাসপাতাল-চিকিৎসক-রোগীর ত্রিমুখী সম্পর্কের বেহাল দশা। নব্য উদারবাদী নীতির কারণে স্বাস্থ্যক্ষেত্র যখন অতিরিক্ত ব্যক্তিমালিকানা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, তখন সাধারণ জনগণের প্রাথমিক চিকিৎসাও যেন ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায়।

সমাজবিজ্ঞান কিংবা অপরাধবিজ্ঞানের একটা গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় হলো বিচ্যুত আচরণ। বিচ্যুত আচরণ বলতে বোঝায় সমাজের প্রচলিত, প্রত্যাশিত রীতিনীতি ও আচার-আচরণের বিপরীত আচরণ প্রদর্শন করা। এ সম্পর্কে প্রথিতযশা সমাজবিজ্ঞানী জে ডি রশের বক্তব্যের সারমর্ম হলো- ‘বিচ্যুত আচরণ হচ্ছে এমন ধরনের আচরণ যেগুলো সামাজিক প্রত্যাশাকে নিশ্চিত করতে পারে না।’ উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, অগ্রজদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন না করা হলো বিচ্যুত আচরণ। সমাজ আশা করে সবাই অগ্রজদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে। কিন্তু না করলেও সমাজ তাকে কোনো শাস্তি দেয় না। বিচ্যুত আচরণ এবং অপরাধের মধ্যে পার্থক্য হলো বিচ্যুত আচরণের জন্য ব্যক্তিকে শাস্তি দেওয়া হয় না; কিন্তু অপরাধের জন্য শাস্তি দেওয়া হয়। প্রতিথযশা সমাজবিজ্ঞানী ট্যালকট পারসন্স তার এক তত্ত্বে আরেক ধাপ এগিয়ে অসুস্থতাকেও এক ধরনের বিচ্যুত আচরণ বলে উল্লেখ করেন। পারসন্সের মতে, অসুস্থ হলে মানুষ তার জন্য নির্ধারিত দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেয়। অর্থাৎ সমাজের প্রত্যাশিত আচরণ ব্যক্তি করতে পারে না। তাই অসুস্থতাও এক ধরনের বিচ্যুত আচরণ। এই সমাজবিজ্ঞানীর বক্তব্য হলো— পুলিশ যেমন সমাজ থেকে বিচ্যুত আচরণ কিংবা অপরাধ দমনের জন্য নিয়োজিত, তেমনি অসুস্থতা নামক বিচ্যুতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য চিকিৎসকদের নিয়োগ দেওয়া হয়। সহজ কথায়, চিকিৎসকদের দায়িত্ব হলো সমাজের অসুস্থতা নামক বিচ্যুতি নিয়ন্ত্রণ করা।

আপনি যখন অসুস্থ হয়ে চিকিৎসকের কাছে পরামর্শ নেওয়ার জন্য যাবেন, সচেতনভাবে চিন্তা করলে পারসন্সের এই তত্ত্বের প্রাসঙ্গিকতা পাবেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই অসুস্থতা বিচ্যুতি না হয়ে অপরাধের পর্যায়ে উপনীত হয়, যার শাস্তি আমরা বিভিন্ন উপায়ে পাই। তাহলে অসুস্থতা কি সত্যি অপরাধ? উপরের বর্ণনা ও ঘটনাবলি তাই বলে। চিকিৎসা করাতে গিয়ে মনে হয় বড় ধরনের অপরাধী আমরা। হাসপাতালের পদ্ধতি এবং ক্ষেত্রবিশেষে চিকিৎসকদের আচরণ- প্রতিটি পদেই শাস্তি পাই আমরা। এমন বিশৃঙ্খল অবস্থা অবশ্যই কাম্য নয়। ডাক্তারদের এই অমানবিক ধর্মঘট কখনোই কাম্য নয়। ভবিষ্যতেও যেন এই অমানবিক ধর্মঘট দেখতে না হয়। পাশাপাশি সরকারি কিংবা বেসরকারি হাসপাতাল- সর্বত্রই চিকিৎসক ও রোগীর সুসম্পর্ক বাস্তবায়ন হোক সেই প্রত্যাশা আমাদের সবার। সৎ ও দায়িত্ববান চিকিৎসকদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা আজীবন। আসছে ফাল্গুনে এই ভক্তি দ্বিগুণ হোক সেই কামনা রইল।

শিক্ষার্থী

সমাজবিজ্ঞান বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।