বন্যা থেকে মুক্তি পেতে করণীয়

আরিফ আনজুম

প্রকাশ : ১৪ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

পানির উচ্চ প্রবাহের কারণে যখন নদী, খাল, বিল, হাওর ও নিচু এলাকা ছাড়িয়ে সব জনপদ পানিতে ভেসে যায় এবং ফসল, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, সম্পত্তির ক্ষতি করে, তখন তাকে বন্যা বলে আখ্যায়িত করা হয়। বাংলাদেশের বন্যা সংঘটনের জন্য দায়ী উল্লেখযোগ্য কারণগুলো হলো : সাধারণভাবে নিম্ন উচ্চতাবিশিষ্ট ভূসংস্থান, যার ওপর দিয়ে প্রধান প্রধান নদী প্রবাহিত হয়েছে। নদীগুলো তাদের শাখা-প্রশাখা এবং উপনদীর সমন্বয়ে ঘন বিন্যস্ত নিষ্কাশন জালিকা গড়ে তুলেছে; দেশের বাইরে নদনদীর উজান এলাকায় এবং দেশের অভ্যন্তরে ভারি বৃষ্টিপাত; হিমালয় পর্বতে তুষার গলন এবং প্রাকৃতিকভাবে হিমবাহের স্থানান্তর সংঘটন; পলি সঞ্চয়নের ফলে নদনদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়া; নদীর পার্শ্বদেশ দখল হয়ে যাওয়া; ভূমিধস সংঘটন; প্রধান প্রধান নদীগুলোতে একসঙ্গে পানি বৃদ্ধি এবং এক নদীর ওপর অন্য নদীর প্রভাব বিস্তার; প্রকৃতির ওপর মানবীয় হস্তক্ষেপ; জোয়ারভাটা এবং বায়ুপ্রবাহের বিপরীতমুখী ক্রিয়ার ফলে নদনদীর সমুদ্রমুখী প্রবাহ ধীরগতি প্রাপ্ত হওয়া (নধপশ ধিঃবৎ বভভবপঃ); সমুদ্রপৃষ্ঠের পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া; ভূগাঠনিক বিশৃঙ্খলা (ভূমিকম্প, নদীর প্রবাহ ও ভূরূপতত্ত্বে পরিবর্তন); গ্রিন হাউজ প্রতিক্রিয়া প্রভৃতি। এ যাবতকালে বাংলাদেশে প্রায় ৩০টি বন্যা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা জেলার দ্বিতীয় প্রলয়ঙ্করী বন্যাটি হয় ৮ জুন ১৯৬৬। ওই বন্যায় সিলেট জেলাতেও বড় ধরনের বন্যা দেখা দেয়। বন্যা ছাড়াও ১৯৬৬ সালের ১২ জুন সকালে এক প্রচণ্ড ঝড়ে জেলার পরিস্থিতি আরো মারাত্মক হয়ে ওঠে। এতে প্রায় ২৫ শতাংশ ঘরবাড়ি এবং প্রায় ১২ লাখ লোক দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একই বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর ৫২ ঘণ্টা একনাগাড়ে বৃষ্টির ফলে ঢাকা শহর প্রায় ১২ ঘণ্টা ধরে ১.৮৩ মিটার পানির তলে নিমজ্জিত ছিল। ১৯৮৭ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে বন্যায় বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটে প্রায় ৫৭ হাজার ৩০০ বর্গকিমি. এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত (সমগ্র দেশের ৪০ শতাংশেরও অধিক এলাকা) হয়। ১৯৮৮ আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে বন্যায় ভয়ঙ্কর বিপর্যয় ঘটে, প্রায় ৮২ হাজার বর্গকিমি. এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ধরনের বন্যা ৫০ থেকে ১০০ বছরে একবার ঘটে। বৃষ্টিপাত এবং একই সময়ে (তিন দিনের মধ্যে) দেশের তিনটি প্রধান নদীর প্রবাহ একই সময় ঘটার (ংুহপযৎড়হরুব) ফলে বন্যায় আরো ব্যাপ্তি ঘটে। এ বন্যায় ঢাকাসহ সমগ্র দেশের ৬০ শতাংশেরও অধিক এলাকা ১৫ থেকে ২০ দিন নিমজ্জিত ছিল। এছাড়াও ১৯৯৮ সালের বন্যায় দেশের দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা নিমজ্জিত ছিল। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল গবাদিপশু, ঘর-বাড়ি, আবাদি জমি। প্রবল বর্ষণ আর উজান থেকে পাহাড়ি ঢলের কারণে তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার ২৫ সেন্টিমিটার ওপর প্রবাহিত হচ্ছে। ধরলা নদীর পানিও বিপৎসীমা ছুঁই ছুঁই হয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। প্রধান এই দুই নদীসহ জেলার সবকটি নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এর ফলে অবনতি হয়েছে লালমনিরহাটের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির। প্লাবিত হয়েছে নতুন নতুন এলাকা। পানিবন্দি জীবনযাপন করছেন জেলার ১৯টি ইউনিয়নের ৬০টি গ্রামের অর্ধলক্ষাধিক মানুষ। কুষ্টিয়ায় নদনদীর পানির উচ্চতা প্রতিদিন গড়ে ৬ ইঞ্চি করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত এক সপ্তাহে পদ্মা ও গড়াইয়ে পানি বৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি। প্রতিবেদনটি লেখার সময়, কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে।

এতে জেলার প্রায় আড়াই লাখ মানুষ বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। কুড়িগ্রাম-ভুরুঙ্গামারী ও কুড়িগ্রাম-যাত্রাপুরে অনেক স্থানে সড়কের ওপর দিয়ে পানি বয়ে যাওয়ায় যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। এই সড়কের শুকনো স্থানে বন্যাকবলিত পরিবারগুলো আশ্রয় নিয়েছে। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও অতি বর্ষণে বগুড়ায় যমুনা নদীর পানি বেড়ে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যমুনার পানি বিপৎসীমার ৩৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এমন সব খবরে আমরা সবাই শঙ্কিত। আমরা পেরেছি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে? দেশের সম্ভাব্য বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আমাদের সর্বত্র প্রস্তুতি রয়েছে, আমরা যে কোনো ধরনের সংকটের মুখোমুখি হতে পারি, কিন্তু আমাদের অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে, যাতে বন্যার কারণে মানুষের ক্ষতি না হয়। বন্যায় যোগাযোগব্যবস্থা, ঘরবাড়ি, শস্যক্ষেত্র, গবাদিপশু ইত্যাদির ক্ষতির সঙ্গে সঙ্গে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির আশঙ্কা দেখা যায়। বন্যার সময় বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে থাকে। কখনো কখনো রোগগুলো মহামারি আকারও ধারণ করতে পারে। এ সময় স্বাস্থ্য সচেতন না হলে দেখা দিতে পারে ডায়রিয়া, আমাশয়, টাইফয়েড, পেটের পীড়া, ভাইরাল হেপাটাইটিস, চর্মরোগসহ নানা রোগ। বন্যার সময় পানির উৎস দূষিত হয়ে যায়। তাই পানি ভালোমতো ফুটিয়ে ঠান্ডা করে পান করাসহ গৃহস্থালির অন্যান্য কাজেও ব্যবহার করতে হবে। বন্যার পানিতে টিউবওয়েল তলিয়ে গেলে এক কলস পানিতে তিন-চার চা চামচ ব্লিচিং পাউডার মিশিয়ে টিউবওয়েলের ভেতর সেই পানি ঢেলে আধাঘণ্টা রেখে এরপর একটানা আধাঘণ্টা চেপে পানি বের করে ফেলে দিলে সেই পানি খাওয়ার উপযোগী হতে পারে। ব্লিচিং পাউডার না থাকলে ১ ঘণ্টা টিউবওয়েলের পানি চেপে বের করে ফেলতে হবে। তবে নিরাপত্তার জন্য টিউবওয়েলের পানিও ভালোমতো ফুটিয়ে নেয়া উচিত। পানি ছেঁকে জ্বলন্ত চুলায় একটানা ৩০ মিনিট টগবগিয়ে ফুটিয়ে তারপর ঠাণ্ডা করতে হবে। পানি ফোটানোর ব্যবস্থা না থাকলে প্রতি দেড় লিটার খাওয়ার পানিতে ৭.৫ মিলিগ্রাম হ্যালোজেন ট্যাবলেট, তিন লিটার পানিতে ১৫ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট এবং ১০ লিটার পানিতে ৫০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট আধাঘণ্টা থেকে ১ ঘণ্টা রেখে দিলে বিশুদ্ধ হয়। পানির ট্যাংকের প্রতি ১ হাজার লিটার পানিতে ২৫০ গ্রাম ব্লিচিং পাউডার ১ ঘণ্টা রাখলে বিশুদ্ধ হবে। অবশ্য এ পদ্ধতিতে ভাইরাস জীবাণু ধ্বংস হয় না। বন্যায় পচা-বাসি খাবার খেতে বাধ্য হয় অসংখ্য মানুষ। ফলে ছড়িয়ে পড়ে ডায়রিয়াসহ অন্যান্য আন্ত্রিক রোগ। খিচুড়ি খাওয়া এ সময় স্বাস্থ্যোপযোগী। খাবার প্লেট সাবান ও নিরাপদ পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। পানি বেশি খরচ হয় বলে অনেকে প্রথমে একবার স্বাভাবিক পানিতে থালাবাসন ধুয়ে তারপর ফোটানো পানিতে ধুয়ে নেন। কিন্তু এটা ঠিক নয়। এতে থালাবাসনে অনেক ধরনের জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে, যা পরে পরিষ্কার পানিতে ধুলেও দূর হতে চায় না। তাই খাবার গ্রহণের আগে থালাবাসন পরিষ্কার বিশুদ্ধ পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। বন্যার সময় মলত্যাগে সতর্কতা অবলম্বন খুব জরুরি। যেখানে-সেখানে মলত্যাগ করা উচিত নয়। এতে পেটের পীড়া ও কৃমির সংক্রমণ বেড়ে যায়। সম্ভব হলে একটি নির্দিষ্ট স্থানে মলত্যাগ করতে হবে এবং মলত্যাগের পরে সাবান বা ছাই দিয়ে ভালো করে হাত ধুয়ে ফেলতে হবে। মলত্যাগের সময় কখনো খালি পায়ে থাকা চলবে না। কেননা, বক্রকৃমির জীবাণু খালি পায়ের পাতার ভেতর দিয়ে শরীরে সংক্রমিত হয়। এ সময় বাসার সবাইকে কৃমির ওষুধ খাওয়ানো উচিত। তবে ২ বছর বয়সের নিচের শিশুদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। বন্যায় প্রধান স্বাস্থ্য সমস্যা ডায়রিয়া। এ জন্য খাওয়ার আগে সাবান দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুতে হবে। পায়খানা করার পর হাত একইভাবে পরিষ্কার করতে হবে। ডায়রিয়া বা পাতলা পায়খানা শুরু হলে পরিমাণ মতো খাওয়ার স্যালাইন খেতে হবে। মনে রাখতে হবে, বন্যা কোনো পাপের ফল নয়। প্রকৃত অর্থে বন্যা এক প্রাকৃতিক বিপর্যয়। ইতিহাসের সব বিপর্যয়েরই জের টানতে হয়েছে গোটা জাতিকে। একটি বন্যা কাউকে এককভাবে নয়, বরং পুরো দেশকে পঙ্গু করে যায় বেশ কয়েক বছরের জন্য। তাই এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে মোকাবিলা করতে হলে সম্মিলিত প্রয়াস চালাতে হবে।

লেখক : সহকারী শিক্ষক, আমতলী মডেল উচ্চ বিদ্যালয়, শিবগঞ্জ, বগুড়া।