বঙ্গবন্ধু ও তার আদর্শ : বর্তমান প্রেক্ষাপট

জাকারিয়া জাহাঙ্গীর, কবি ও কলাম লেখক

প্রকাশ : ১৫ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বিদেশি গণমাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাজনীতির কবি উপাধি দিয়েছে। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুকে শুধুমাত্র রাজনৈতিক নেতা বললে কম হবে, তিনি হলেন ‘রাজনীতির কবি’। বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবন, রাজনৈতিক দর্শন ও সুদূরপ্রসারী চিন্তাই তাকে রাজনীতির মহাকবিতে পরিণত করেছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়ে যেমন বাঙালির হৃদয়ের মনিকোঠায় জায়গা করে নিয়েছিলেন, তেমনি বিশ্ববাসীর কাছে হয়েছিলেন বিশ্বনেতা। আর এসব সম্ভব হয়েছিল তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বগুণ ও আদর্শিক চিন্তাচেতনার জন্য। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার যে স্বপ্নের কথা আমরা শুনি, তা বাস্তবায়নের আগেই তাকে হত্যা করে তারই আদর্শচ্যুত ‘সোনার ছেলেরা’। আগস্ট মাস। শোকের মাস। সেইসঙ্গে লজ্জা ও ঘৃণারও। যে মাসে সপরিবারে হত্যা করা হয় স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর পুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। কারা হত্যা করল তাকে? যারা বঙ্গবন্ধুকে উপাধি দিয়েছিল জাতির পিতা হিসেবে- সেই আদর্শেই গড়ে ওঠা একদল বিপথগামী চক্র। যারা ছিল বঙ্গবন্ধু ও তার দল এবং পরিবারের ঘনিষ্ঠজন। কথিত আছে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার অন্যতম ক্রীড়ক খন্দকার মোশতাক বঙ্গবন্ধুর মায়ের মৃত্যুতে কান্নায় মাটিতে গড়াগড়ি খেয়েছেন, বঙ্গবন্ধুর বাবার লাশ নিয়ে কবরে নেমেছিলেন, শেখ কামালের বিয়েতে উকিল দিয়েছিলেন, হত্যাকাণ্ডের আগের দিন নিজবাড়ি থেকে রান্না করা খাবার এনে বঙ্গবন্ধুকে খাইয়েছেন। এতটা ঘনিষ্ঠ হয়েও বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারকে হত্যা করতে পারে- তা পূর্ব থেকে কল্পনা করাও অস্বাভাবিক ছিল। স্বার্থান্ধ ও ক্ষমতালোভী মুষ্টিমেয় একটা গোষ্ঠীর এই জঘন্য ও নৃশংস কর্মকাণ্ড বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে শুধু খাটোই করেনি; পুরো জাতিকে আজীবনের জন্য বেঈমানের তকমা দিয়ে গেছে। একজন ব্যক্তিকে হত্যার মধ্যদিয়ে তার আদর্শের মৃত্যু ঘটানো সম্ভব নয়- এটা সত্য। কিন্তু দুঃখজনক হলেও এটাও সত্য যে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরই তার আদর্শও ভূলুণ্ঠিত হতে থাকে। আর এ প্রক্রিয়ার অগ্রধাপেও আছে খন্দকার মোশতাকের অনুসারীরাই। যদিও তারা নিজেদের বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক হিসেবেই দাবি করেন। আমার দৃষ্টিতে, বঙ্গবন্ধুকে যেমন হত্যাও করেছে তারই ঘনিষ্ঠজনরা, তেমনি তার আদর্শের সবচেয়ে বেশি অবমাননা হচ্ছে তার গড়া দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের স্বার্থান্বেষী নেতাকর্মীদের দ্বারাই। স্বাধীনতার এতবছর পরও আমরা আমাদের বিবেকবোধ ও নৈতিকতা অর্জন করতে পারিনি। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারকাজ অব্যাহত থাকলেও তার আদর্শের অবমাননাকারীদের শাস্তি নেই, দলীয় শৃঙ্খলা ভঙের অভিযোগে মাঝেমধ্যে নেতাকর্মীদের সাময়িক বহিষ্কার বা সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হলেও থেমে নেই তাদের দৌরাত্ম্য। টানা তিনবার রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকার সুবাদে উচ্চপর্যায় থেকে মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরাও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী। তৃণমূলের অধিকাংশ নেতাকর্মীরাই একেকজন ফুলে-ফেঁপে উঠেছেন। যদিও দলের ত্যাগী, প্রবীণ ও দুঃসময়ের নেতাকর্মীদের কতটা ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছে, তার আদৌ কোনো হিসাব নেই। স্থানীয়পর্যায়ের দলীয় নেতাকর্মী এবং প্রশাসন যোগসাজশে সরকারি বরাদ্দ তথা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের দেখভাল করছেন। এই সুযোগে অতিউৎসাহী আমলারাও নিজেদের দলীয় নেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। বর্তমানে প্রশাসন ও আমলানির্ভরতা দিন দিন রাজনীতিকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করেছে যে, অনেক ক্ষেত্রে আমলাদের কাছে দলীয় নেতারা যেন কিছুই না। সরকারি চাকরিজীবীদের উদ্দেশ্য করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- এটা স্বাধীন দেশ। ব্রিটিশ কলোনি নয়, পাকিস্তান কলোনি নয়। সাধারণ মানুষের মুখের দিকে একটু ভালোভাবে চেয়ে দেখো; তার চেহারাটা তোমার বাবার মতো কিংবা তোমার ভাইয়ের মতো। তারাই এদেশে বেশি সম্মান পাবে। কারণ এরা নিজের টাকায় খায়, নিজের টাকায় চলে। আর তোমরা ওদের টাকায় বেতন নাও। কিন্তু এই কথার প্রতিফলন বাস্তবিকভাবে আমরা কতটা দেখতে পাই! একেকটা দপ্তরের একেকজন অফিসার যেন ‘লাট সাহেব’। অনেক সরকারি চাকরিজীবীদের দৈনন্দিন ডিউটি এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাদের আচার-আচরণ যেন ব্রিটিশদের জমিদারি স্টাইলকেও হার মানায়। আমরা প্রায়ই গণমাধ্যমে দেখি- পিয়ন থেকে কোটিপতি, জিরো থেকে হিরো, শূন্য থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক ইত্যাদি শিরোনামে নানা সংবাদ। যে স্বপ্ন নিয়ে এই মাতৃভূমি স্বাধীন হয়েছে, সেই স্বপ্নকে গলাটিপে হত্যা করছে কতিপয় দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষ। যেখানে ঘুষ ব্যতীত চাকরি পাওয়াটা অনিশ্চিত, নগদ বখশিস ছাড়া অফিসের ফাইল নড়ে না- সেখানে অনিয়মকেই এখন নিয়ম হিসেবে মানতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠছে সাধারণ মানুষ। সব সম্ভবের দেশ বাংলাদেশে টাকার বিনিময়ে অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়- এ ধারণাই সবার মধ্যে। তাই তো এখন মানুষের একটাই কথা- ‘টাকায় বাঘের চোখ মেলে’। নানা অনিয়মণ্ডদুর্নীতিতে নিমজ্জিত অফিসাররা পারলে দেশটাই বিক্রি করে খায়! দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করে বিদেশে ব্যাংক ব্যালেন্স, বাড়ি-গাড়ির মালিক হচ্ছেন। টাকার মালিক হচ্ছেন টাকাওয়ালারা, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন দেশের সাধারণ মানুষ। একটা সময় ছিল- দুর্নীতি করতে পারত শুধু চাকরিজীবীরা, রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দুর্নীতি করার সুযোগ ছিল না। আগে মনে করা হতো- রাজনীতি মানে নীতির রাজা। আর এখন রাজনীতি মানে রাজার নীতি; অর্থাৎ ক্ষমতা, নেতৃত্ব বা আধিপত্য যার হাতে নিয়ন্ত্রিত, তার নীতি মানাই রাজনীতি। যখন রাজনীতি থেকে সাহিত্য, সংস্কৃতি, মেধার বিকাশ ও সুস্থ প্রতিযোগিতা বিলুপ্ত হয়, তখন রাজনীতি পরিণত হয় দুর্বৃত্তায়নে। যার প্রমাণ ও বাস্তবতা আমরা দেখতে পাচ্ছি। আগে মানুষ রাজনীতিতে আসতেন দেশ ও সমাজকে কিছু দিতে, বিবেকের দায়বদ্ধতা থেকে এবং ত্যাগের মানসিকতা নিয়ে। আর এখন রাজনীতির মূল উদ্দেশ্যই থাকে নিজের ভাগ্য পরিবর্তন। বঙ্গবন্ধু বলতেন- ‘বিশ্ব দুই শিবিরে বিভক্ত। শোষক আর শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।’ প্রশ্ন হচ্ছে- ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক’ দাবিদাররা এখন কার পক্ষে! বঙ্গবন্ধু শিক্ষিত সমাজ তথা সমাজের দায়িত্ব পালনকারী ব্যক্তিদের নির্দেশ দিয়েছেন খেটে খাওয়া মানুষদের সম্মান দিতে। এ ব্যাপারে তিনি বলেছেন- আপনাদের ডাক্তারি পাস করাল কে? আইএ-বিএ পাস করাল কে? ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করাল কে? আর্টস-সাইন্স পাস করাল কে? আজ অফিসার তৈরি করল কে? কার টাকায় তৈরি হচ্ছেন? সাধারণ মানুষের টাকায়। শুধু আপনার সংসার দেখাশোনার জন্য নয়, আপনার ছেলে-মেয়ে দেখাশোনার জন্য নয়, সাধারণ জনগণের সেবা করার জন্য। কিন্তু বাস্তবতা এখন ভিন্ন। একেকজন জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে ‘প্রভূর মূর্তি’ ধারণ করেন। তারা নিজেকে জনগণের চাকর দাবি করলেও কাজেকর্মে শোষকের ভূমিকা পালন করেন। কেউ কেউ তো গুরুত্বপূর্ণ পদপদবী পেয়ে দলের এবং এলাকার ইজারাদার ভাবেন। তাদের কাছে ‘মুখে জয়বাংলা’ ধ্বনি আর ‘গায়ে মুজিবকোট’ থাকলেই যেন ‘মুজিবআদর্শ’ বাস্তবায়ন। অথচ একটি কথা ধ্রুব সত্য যে, নিজেদের স্বার্থের জন্য অনেকেই ভিন্ন দল থেকে আওয়ামী লীগে এসে ঘুমের ঘোরেও জয়বাংলা রপ্ত করেন। ভাবটা এমন যে, তারাই ‘মুজিবআদর্শ’ বাঁচিয়ে রেখেছেন।

অথচ তাদের জন্যই তৃণমূলের নেতাকর্মীরা শোষিত, বঞ্চিত ও লাঞ্ছিত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা- অস্বীকার করার সুযোগ নেই। দেশে রাজনৈতিক দ্বিধাবিভক্তি থাকলেও বঙ্গবন্ধুর অবদানকে অস্বীকার করে না কোনো দলই। বরং যারা বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করবে, এদেশের স্বাধীনতায় তাদের বিশ্বাস নিয়ে সন্দেহ আছে। একটি কথা উল্লেখযোগ্য যে, ১৭ বছর ধরে রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে বিএনপি-জামায়াত ও সমমনা দলগুলো। টানা প্রায় ১৫ বছর সরকারে আছে আওয়ামী লীগ। নিজেদের বিবেকের কাছে প্রশ্ন করা উচিত- আজ যিনি যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন, যে দায়িত্বে আসীন হয়েছেন, যে চেয়ার ও মর্যাদা পেয়েছেন, তার কতটুকু সদ্ব্যবহার করছেন! রাষ্ট্রের প্রতি যে দায়বদ্ধতা- তার কতটা পালন করছেন! দীর্ঘদিন রাষ্ট্রীয় সুযোগসুবিধা থাকার পরও যেসব নেতাকর্মী আত্মশুদ্ধি অর্জন করতে পারেননি, তাদের মুখে বিএনপি-জামায়াতের সমালোচনা বড্ড বেমানান, তাদের মুখে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কথা বলা শুধু হাস্যকরই নয়, রীতিমতো অন্যায়।