ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সৈনিক আইনজীবীরা কতটা নিরাপদ!

অ্যাডভোকেট মো. রায়হান আলী
ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সৈনিক আইনজীবীরা কতটা নিরাপদ!

সম্প্রতি খুলনা জেলা আইনজীবী সমিতির দুইজন সিনিয়র সদস্যের দুষ্কৃতিকারীদের হাতে নিহতের ঘটনা খুলনার আদালত পাড়ায় ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। ঘটনা দুটিতে খুলনার আইনজীবী মহল খুব বিস্মিত হয়েছে। খুলনা জেলা আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে নিহত আইনজীবীদ্বয়ের হত্যাকারীদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে শাস্তি দাবি করেছেন। এ নিয়ে সমিতির সামনে মানববন্ধও হয়েছেন। জেলা আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে দোষীদের দ্রুত গ্রেপ্তার পূর্বক আইনের আওতায় এনে বিচারে সোপর্দ করনের জন্য জেলা প্রসাশকের মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপিও প্রদান করা হয়।

আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বিচার বিভাগের কার্যক্রম এগিয়ে চলছে নিরলসভাবে। সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ আইন ও বিচার বিভাগ। একটি পাখির দুটি ডানা তা হলো- বিচারক ও আইনজীবী। উভয়ের যৌথ সমন্বয়ে পরিচালিত হয় বিচার বিভাগ। বিচার বিভাগে বিচারকদের সুরক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও অপর ডানা তথা আইনজীবীদের তেমন সুরক্ষার ব্যবস্থা নেই। প্রতিনিয়তই মিডিয়াতে খবর সরব যে ওমুক আইনজীবী লাঞ্ছিত সন্ত্রাসী কিংবা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে। এ খবর যে আইনজীবী সমাজকে কত দিন শুনতে হবে তার ইয়ত্তা নেই।

রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ হলো রাষ্ট্রপতি।

সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ ও বর্তমান মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন সাহেবসহ অনেক বিচারপতি, মন্ত্রী কিংবা সংসদ সদস্য বা জনপ্রতিনিধি আইনজীবী থেকে হয়েছেন। সুতরাং দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা নিয়ন্ত্রণ করে আইন ও বিচার বিভাগ। আর এই বিভাগের একটি ডানা হলো আইনজীবীরা। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় যাদের অনবদ্য অবদান। আদালতে বিচারকার্য চলাকালীন উপস্থিত আইনজীবী ও কোর্ট অফিসার। একমাত্র বিচারক-আইনজীবীদের নামের শুরুতে বিজ্ঞ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। কতই না সম্মানিত এই আইনজীবীরা। আজ এত বড় সম্মানের জায়গাটাকে বিজ্ঞ আইনজীবীদের পদে পদে লাঞ্ছিত করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে কারণে-অকারণে আইনজীবীদের হতে হচ্ছে মামলা-হামলার শিকার। অনেক ক্ষেত্রে সামান্যতেই আইনজীবীদের হেয়প্রতিপন্ন করা হচ্ছে, লাঞ্ছিত করা হচ্ছে, সন্ত্রাসিদের হাতে আহত-নিহত হতে হচ্ছে। এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতেও হেয়প্রতিপন্ন হতে হচ্ছে। আইনজীবীদের সঠিক মূল্যায়নের অভাবে সমাজে দিন দিন তাদের এলিট পার্সন থেকে সম্মানের জায়গাটা অনেকাংশে সংকুচিত হচ্ছে। এমন ঘটনাগুলো সত্যিই এটা দেশের জন্য খুব লজ্জার।

কিছুদিন আগেও আইনজীবী হেনস্থার একটি ঘটনা পুরো আইনজীবী সমাজকে বিমোহিত করেছে। গণমাধ্যমের কল্যাণে আমরা জানতে পারি যে, ’পুলিশের ময়মনসিংহ রেঞ্জের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) এনামুল কবীরের বিরুদ্ধে এক আইনজীবীকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে। ১৫ জুন বৃহস্পতিবার দুপুরে ময়মনসিংহ জেলা আইনজীবী সমিতির কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে এ অভিযোগ করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন। লিখিত বক্তব্যে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক এনামুল কবীরকে বরখাস্তের দাবি জানান তিনি। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ময়মনসিংহ জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য আশিকুর রহমান গতকাল বুধবার দুপুরে একটি পারিবারিক অভিযোগের শুনানির জন্য অতিরিক্ত ডিআইজি এনামুল কবীরের কক্ষে যান। শুনানির একপর্যায়ে অতিরিক্ত ডিআইজি এনামুল কবীর আশিকুর রহমানকে থাপ্পড় মারেন এবং পরে রড দিয়ে বেধড়ক পেটান। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জেলা আইনজীবী সমিতিতে জরুরি সাধারণ সভা হয়। সভায় ঘটনার নিন্দা জানিয়ে অতিরিক্ত ডিআইজির বরখাস্তের দাবি জানানো হয়। (সূত্র: প্রথম আলো, ১৫ জুন, ২০২৩)।

এরইমধ্যে এ বিষয়ে সুপ্রিমকোর্ট বার সমিতি প্রতিবাদস্বরূপ ১৭ জুন এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, ‘ময়মনসিংহ জেলা আইনজীবী সমিতির বিজ্ঞ সদস্য জনাব অ্যাডভোকেট আশিকুর রহমানকে পুলিশ কর্তৃক অমানবিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতি তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছে। দোষী ব্যক্তিকে শাস্তির আওতায় আনার জন্য জোর দাবি জানাচ্ছে’। এই ঘটনাটিই যে একমাত্র আইনজীবী লাঞ্ছিতের তা কিন্তু নয়, ইতিপূর্বেও আইনজীবীরা অনেক লাঞ্ছিতের শিকার হয়েছে। সে ঘটনাগুলোও আইনজীবী সমাজকে বিস্মিত করেছে। এমন আরো অনেক ঘটনা আছে তার মধ্যে আরেকটি ঘটনা ঘটেছিল ২০২১ সালে। পটুয়াখালী জেলা আইনজীবী সমিতির সম্পাদককে লাঞ্ছিত করেছিল তৎকালীন পুলিশ প্রশাসন কর্তৃক। এ বিষয়ে পটুয়াখালী জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে তারা এ ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেছিলেন।

বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, গত ১৬ আগস্ট সোমবার পটুয়াখালী সবুজবাগ সরকারি কলেজের পেছনের দিকের সড়কে রাস্তায় পটুয়াখালী জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য ও বর্তমান কার্যনির্বাহী কমিটির ২০২১-২২ এর নির্বাচিত লাইব্রেরি সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল নোমান রাত আনুমানিক ১২টা ৩০ মিনিটের দিকে তার অসুস্থ বাবার ওষুধ ক্রয় করে ফেরার পথে পটুয়াখালী পুলিশ লাইন্সের টহল পুলিশ একটি জনমানবশূন্য স্থানে তার গতিরোধ করে তল্লাশির নামে আব্দুল্লাহ আল মামুনের মানিব্যাগ, মোবাইল কেড়ে নিয়ে দেহ তল্লাশি করার নামে শরীরের স্পর্শকাতর জায়গায় হাত দিয়ে শারীরিক মানসিক ও সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করে। (সূত্র: বিডি ক্রাইম২৪, ২০ আগস্ট, ২০২১)।

আইনজীবী সুরক্ষা আইন প্রণয়নের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ তারিখে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ফরহাদ উদ্দিন আহমেদ ভূঁইয়া। আইনজীবী সুরক্ষা আইন না থাকায় আইনজীবীদের সাংবিধানিক ও মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে উল্লেখ করে রিট আবেদনকারী আইনজীবী ফরহাদ উদ্দিন আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, দেশে গত কয়েক বছরে ৬৭ জনের বেশি আইনজীবী হত্যা, নির্যাতন, হামলা ও অপহরণের শিকার হয়েছেন। এ সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে। আইনজীবীদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর ও স্পর্শকাতর মামলা পরিচালনা ও শুনানি করতে হয়।

ফলে কোর্ট থেকে বের হয়েই তারা নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েন। বিভিন্ন সময়ে তারা প্রতিপক্ষের বা তাদের লেলিয়ে দেওয়া সন্ত্রাসীর দ্বারা নির্যাতনের শিকার হন। রিট আবেদনে যে কোনো আইনজীবীর ওপর হামলা, মামলা বা আক্রমণ হলে তাৎক্ষণিকভাবে আইনগত ব্যবস্থাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। এছাড়াও জুডিশিয়াল অফিসার, সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও বার কাউন্সিলের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে স্বাধীন তদন্ত কমিটি বা কমিশন প্রতিষ্ঠার নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। আইনজীবীরা হয়রানির শিকার হলে তদন্তের ক্ষমতা ওই কমিটি বা কমিশনকে দেওয়ার নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে রিটে। (সূত্র: ঢাকা পোস্ট, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১)।

আইনজীবীরা দেশের আইন জগতে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। মানুষের আইনি সেবা বা সহায়তা প্রদানে ভূমিকা রাখে।

আইনের সঠিক ব্যাখ্যায় কোর্টকে বিচারিক কাজে সহায়তা করে। নিরপরাধ ব্যক্তিরা অযথা হয়রানির শিকার হলে আইনি প্রক্রিয়ার তাদের আইনি সহায়তা প্রদান করে থাকেন। আর সমাজ তথা রাষ্ট্রের এমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা আজ সুরক্ষাহীনতায় ভুগছে।

উপযুক্ত সুরক্ষার অভাবে নানা প্রকার হয়রানির শিকার হচ্ছেন এই আইনজীবীরা। যেহেতু রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন অনেক আইনজীবীরা। তাই আইনজীবীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করাও তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এ বিষয়ে আইনজীবীদের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বার কাউন্সিলকে সর্ব প্রথম এগিয়ে আসতে হবে, পাশাপাশি সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা পেলে আইনজীবী সুরক্ষা আইন পাস করা সম্ভব। আইনজীবী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন সময়ের গুরুত্বপূর্ণ দাবিতে পরিণত হয়েছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত