ডেঙ্গুর মহামারি

আরিফ আনজুম, কলাম লেখক

প্রকাশ : ১৭ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আজ কালের বিবর্তনে সবকিছুই তাদের গতিপথ, রূপ বৈচিত্র্য পরিবর্তন করছে। তবে সেখানে ছোট কীট মশা কেন পিছিয়ে থাকবে? মোটেও এই ক্ষুদ্রাকৃতির প্রাণী একটুও পিছুপা হয়নি। এক সময় ধারণা ছিল বৃষ্টিপাত বা বাসাবাড়ির আনাচে-কানাচে জমে থাকা পানি থেকে এডিস মশার বিস্তার হয়। এখন মশাদের শক্তি আরো বেড়েছে। বিশেষ করে এডিস মশার ডিম ৬ মাস পর্যন্ত শুকনো জায়গায়ও বেঁচে থাকতে পারে। মশাবাহিত যেসব রোগ রয়েছে তার মধ্যে এত দিন আমাদের দুশ্চিন্তার বিষয় ছিল ম্যালেরিয়া। সেই যুদ্ধে আমরা অনেক ক্ষেত্রে সফল হয়েছি, প্রকোপ অনেকটাই কমেছে। এখন দেখা দিয়েছে আরেক শঙ্কা, যার নাম ডেঙ্গু। এটিও মশাবাহিত রোগ এবং বর্তমান সময়ে একদম জোর দাবিদার জানানোর মতো একটি জোড়ালো ভাইরাসস্বরূপ। ২০০০ সালের মোটামুটি প্রথম দিক থেকেই এ রোগের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়। গত বছরের আগ পর্যন্ত এটি নিয়ে আমরা তেমন একটা দুশ্চিন্তা করিনি। কারণ এটি অন্য অনেক ভাইরাল জ্বরের মতোই লক্ষণ দেখায়। কিন্তু এখন আর মানুষকে কামড়াতে মশাদের দিন-রাত লাগে না। আগ্রাসী হতে শীত-গ্রীষ্ম বা রোদ-বৃষ্টির অপেক্ষা করে না। মশার মাধ্যমে ছড়ানো ডেঙ্গুর ভ্যারিয়েন্ট দিনকে দিন আরো ভয়ংকর হয়ে ওঠার বার্তা কবে থেকেই দিয়ে আসছেন চিকিৎসকরা। তাদের কথায় সচেতন হতে বিলম্ব হওয়ার সফলতা আজ ভোগ করতে হচ্ছে। বিনা মৌসুমেও ডেঙ্গুর আক্রমণের শিকার হচ্ছে মানুষ। এক সময় ধারণা ছিল বৃষ্টিপাত বা বাসাবাড়ির আনাচে-কানাচে জমে থাকা পানি থেকে এডিস মশার বিস্তার হয়। এখন মশাদের শক্তি আরো বেড়েছে। বিশেষ করে এডিস মশার ডিম ৬ মাস পর্যন্ত শুকনো জায়গায়ও বেঁচে থাকতে পারে। এডিসের বাইরে অন্যান্য মশাও ডেঙ্গু ছড়ানোর শক্তি অর্জন করেছে। তারা কেবল বৃষ্টির জমা পানিতে বা কেবল জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্তই প্রজনন করে, সেই ধারণাও অচল হয়ে যাচ্ছে। এবার শীত যেতে না যেতেই আক্রমণকারী মশারা তাদের শক্তি জানান দিচ্ছে। মানুষের থাপ্পড়ের শক্তি প্রয়োগের মাত্রা বাড়িয়েও কাজ হচ্ছে না। মশারিতেও এ মশাদের রুখতে পারা যাচ্ছে না।

কয়েল হার মেনেছে কবেই। স্প্রে, ইলেকট্রিক ব্যাটসহ আধুনিক নানা কীটনাশকও সব হার মেনেছে বর্তমান প্রজন্মের এই বাটকেল মশার কাছে। এমনকি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত এটি নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল, এতে তাদের প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার যোশ চোপড়া এই রোগে মারাও গিয়েছেন। অনেক চেষ্টা চলছে এটি প্রতিরোধের জন্য, সম্ভব হচ্ছে না। তবে মশা মারতে কামান দাগানোকে এক সময় ঠুনকো কাজের উপমা দিয়ে যেমন উপহাস করা হতো। তা অসার হয়ে গেছে সেই কবেই না। নগর-মহানগরীর মেয়রসহ জনপ্রতিনিধিদের সাফল্যের প্রমাণ অনেকটা নির্ভর করছে তাদের মশা মারার দৃষ্টান্তের ওপর। কামান দাগিয়েও সম্মুখ সমরে মশাকে পরাস্ত করতে ব্যর্থ হয়ে এখন তাদের প্রয়োজনে কঠোরতম ভাবনায় যেতে বাধ্য হতে হচ্ছে জনপ্রতিনিধি। এমনকি তারা ফগিং কমিয়ে বায়োলজিক্যাল কন্ট্রোলের দিকে বেশি জোর দিতে আগ্রহী হচ্ছে। কারণ তারা জানেন, একটি বাড়ি বা ভবনে একজন ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়া মানে বাকিরাও ঝুঁকিতে। বর্তমানে বৃষ্টি না থাকলেও রাজধানীতে মশা উন্নয়ন কর্পোরেশনের মতো অবস্থায় খাল-নালাগুলো। সেগুলোতে আবর্জনার স্তূপের সঙ্গে বেড়েছে পানির ঘনত্বও। ফলে মশাগুলো তাদের বংশবিস্তার করার আরো বড় ধরনের সুযোগ পাচ্ছে সেই সঙ্গে এটি খুব দ্রুত রোগ ছড়াতেও অগ্রগামী হচ্ছে। ওহঃবৎমড়াবৎহসবহঃধষ চধহবষ ড়হ ঈষরসধঃব ঈযধহমব (ওচঈঈ)- এর এক হিসাব অনুযায়ী ২০৮০ সালের মধ্যে এই রোগে আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা পৃথিবীজুড়ে দাঁড়াবে প্রায় ১.৫ থেকে ৩.৫ বিলিয়ন। এর কারণ হলো উষ্ণতা বৃদ্ধি। তাপমাত্রা পৃথিবীজুড়ে বেড়েই চলেছে। ডেঙ্গু রোগে আক্রান্তদের ৭০ শতাংশ গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলে হয়ে থাকে।

দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের দেশও এর মধ্যে পড়েছে। যত খরা, তত ডেঙ্গুর ঝুঁকি। এর কারণ এডিস মশা ডেঙ্গুর বাহক, এই মশার জীবনচক্র থেকে দেখা যায় আবহাওয়া যত উষ্ণ হবে তার প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার দিন তত কম হবে। সময় থাকতে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করাটা বড়ই বুদ্ধিমত্তার কাজ। তাই ডেঙ্গু প্রতিরোধে আমাদের কী করা প্রয়োজন? ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ থেকে শুরু করে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা- সবারই ডেঙ্গু প্রতিরোধে দায়িত্ব পালনের সুযোগ রয়েছে তা সম্মিলিতভাবে ভেবে-চিন্তে সমাধানের এক পর্যায়ে উপনীত করতে হবে।

সর্বত্র ভেবে-চিন্তে আমাদের দেশের বাজেটও ঘোষণা করেছেন অর্থ মন্ত্রণালয়। শুধুমাত্র সিটি কর্পোরেশনের তরল ওষুধ, ওইসব কর্পোরেশনের সব জায়গায় পৌঁছাচ্ছে না।

অথচ এ কাজের বাজেটে কমতি নেই। রাজধানীর মশা উন্নয়ন কর্পোরেশন তছনছ করতে ঢাকার ২ সিটি কর্পোরেশনের বাজেট শত কোটি টাকা প্রায়। তবুও কাজ অবহেলা আর অযত্নে এখনো হেলায় জটলা বেধে রয়েছে। এতে বাংলাদেশের জন্য শুভ কাম্যতা নাকি অশুভ কাম্যতা? আমরা আরো কত কঠোরতম পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে তবেই আমাদের বিবেক জাগ্রত করতে সজাগ হবো। নাকি আদৌ কোনো ভালো কাজে নিজ উদ্যোগে এগিয়ে আসব না?

চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে কেবল কীটনাশকের জন্য দক্ষিণে বরাদ্দ আছে ২৫ কোটি টাকা। আগের বছর তা ছিল ২২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। এর বাইরে দক্ষিণে মশক নিধনে ফগার, হুইল, স্প্রে মেশিনের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। উত্তর সিটিতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে বরাদ্দ ৭৬ কোটি টাকা। সেখানে মশার ওষুধ বাবদ বরাদ্দ ৪০ কোটি টাকা।

কচুরিপানা, আগাছা পরিষ্কার ও পরিচর্যায় ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ফগার, হুইল, স্প্রে মেশিন পরিবহনে ৪ কোটি টাকা, আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে ২৫ কোটি টাকা এবং মশক নিয়ন্ত্রণে চিরুনি অভিযানে ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এত টাকায়ও নগরবাসী কাবু মশা উন্নয়নের কাছে। এক ঢাকার ২ কর্পোরেশন মশা বিনাশ করতে বিভিন্ন সময়ে খাল, ড্রেন ও জলাশয়ে গাপ্পি মাছ, তেলাপিয়া মাছ ও হাঁস ছেড়েছে। ড্রোনের মাধ্যমে মশার উৎপত্তিস্থল খুঁজে ওষুধ ছিটানোও হয়েছে। ডিএনসিসি মেয়রের নেতৃত্বে বিশাল টিম আমেরিকায় গিয়ে প্রশিক্ষণও নিয়ে এসেছে। কাজের কাজ কী হয়েছে? সামনে আর কী বাকি আছে?