ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

এবার র‌্যাগিং-বুলিং মুক্ত হোক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

আলোক আচার্য্য
এবার র‌্যাগিং-বুলিং মুক্ত হোক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

অবশেষে র‌্যাগিং ও বুলিং সংক্রান্ত নীতিমালা চূড়ান্ত করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার মুখোমুখি হওয়া এবং এর প্রতিক্রিয়ায় অপ্রীতিকর ঘটনাগুলো এখন কমে আসবে। নীতিমালায় বলা হয়েছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে র‌্যাগিং ও বুলিংয়ের সঙ্গে কোনো শিক্ষক অথবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে প্রচলিত আইন-বিধি অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। র‌্যাগিং, বুলিং শব্দগুলো বর্তমানে নেতিবাচকভাবে এবং যথেষ্ট ভীতিকর হলেও দুঃখজনকভাবে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এগুলো ঘটে। বিশেষত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অহরহই এ ধরনের ঘটনার ঘটনা ঘটছে। আমরা মাঝেমধ্যেই পত্রিকায় র‌্যাগিংয়ের খবর পড়ি। র‌্যাগিং আসলে কি? এটা কি কোনো সংস্কৃতির অংশ? প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো যে র‌্যাগিং কোনোভাবেই কোনো সংস্কৃতির অংশ হতে পারে না। কারণ সংস্কৃতি কোনো অন্যায় বা নিচু মানসিকতার কাজকে প্রশ্রয় দেয় না। তবে এটি অপসংস্কৃতি হতে পারে। কারণ সংস্কৃতির রুপ নিয়ে প্রবেশ করে ধীরে ধীরে তা বুমেরাং হতে থাকে। এখানেও তাই হয়েছে। একটি দেশের সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটে খুব ধীরে। কিছু অপ্রীতিকর, বিরক্তিকর বিষয়ও একসময় অপসংস্কৃতি হয়ে সমাজে ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পরে। এক্ষেত্রেও সেটাই ঘটেছে। র‌্যাগিং কোনো সংস্কৃতির অংশ হতে পারে না। র‌্যাগিং শব্দটির একটি অর্থ পরিচয় পর্ব কোথাও কোথাও উল্লেখ করা হয়েছে।

নতুনদের সঙ্গে পুরাতন ছাত্রছাত্রীর একটি পরিচয়পর্ব। তবে আজ আর শব্দটি এখানে সীমাবদ্ধ নেই। বরং একটি ভয়ংকর চিত্রই সামনে আসে। এইচএসসি পরীক্ষার পর দেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থী বিভিন্ন উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়। শুরু হয় তাদের নতুন জীবন। সেই জীবনে যেমন আশা থাকে, তেমনি থাকে আশঙ্কা। নতুন প্রতিষ্ঠানে নতুন মুখগুলো কেমন হবে, কীভাবে তাদের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবে ইত্যাদি আরো নানা দুশ্চিন্তা থাকে। তার মধ্যেই যেদি ইদানীং বেশি থাকে, তা হলো সেখানকার নামধারী বড়ভাইদের আচরণ। কারণ সবাই ইদানীং র‌্যাগিং বিষয়ে জানে এবং কিছুটা আতঙ্কেও থাকে যে তার প্রতিষ্ঠানে তাকে কোনোভাবে হেনস্তা হতে হবে না তো। র‌্যাগিং যেমন মানসিকভাবে প্রভাব ফেলে, তেমনি তা দীর্ঘমেয়াদে মনের ওপর চাপ ফেলতে পারে। দেশের নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ে নামধারী ছাত্র বা ছাত্রী তথা বড়ভাইয়েরা তাদের প্রতিষ্ঠানের জুনিয়রদের মানসিকভাবে এবং শারীরিকভাবে নির্যাতন করে। অবস্থা এমন যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র হলেই র‌্যাগিং করতে হবে! নিজের সিনিয়রিটি ফলানোর জন্য, ক্যাম্পাসে হিরো সাজার জন্য অথবা ক্ষমতা জাহিরের জন্য এসব নোংরা কাজ করতে হবে। যদিও এই সংখ্যা অনেক কম এবং এটাই এখন পর্যন্ত শান্তির জায়গা। এটাকে ছড়ানোর আগেই রোধ করা দরকার।

এ কারণে যুগোপযুগী আইনের দরকার ছিল। দীর্ঘদিন বিষয়টি নিয়ে আলোচনাও হয়েছে। অবশেষে বিষয়টি কার্যকর হয়েছে। এ ধরনের নোংরামিতে হাতেগোনা দু’চারজন। বাস্তবতা হলো এ ধরনের পরিস্থিতিতে অনেক ছাত্রছাত্রীকে পরতে হয়েছে। আজও সেটাই হচ্ছে। তারা কোন সাহসে এসব করে তা জানা নেই, তবে তাদের মানসিকতা যে অনেক নিচু প্রকৃতির সেটা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি। ফুলপরী খাতুন নামে আলোচিত এক নবীন শিক্ষার্থীর ঘটনায় দেশজুড়ে নিন্দার ঝড় ওঠে। এরপরেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। এই মানসিকতার পরিবর্তন না ঘটলে এটা আসলে পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব কি না তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। কারণ কিছু ঘটনা প্রকাশ্যে আসছে, তবে সবাই যে অভিযোগ করা পর্যন্ত যাচ্ছে সেই গ্যারান্টি কে দেবে? সবার তা করার সাহসও হয় না। কারণ সেখানে তাকে থাকতে হবে এবং কয়েক বছর লেখাপড়া করতেই হবে। আবার অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, নির্যাতনকারী ছাত্রছাত্রী একটু ক্ষমতাসম্পন্ন। সুতরাং নির্যাতনের শিকার ছাত্রছাত্রীকে চুপ করে থাকতে হয়। কিছু ঘটনা সামনে আসে কারণ সেই ঘটনাগুলো মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। অত্যাচারের মাত্রা সহ্যের বাইরে গেলে ঘটনাও চাপা থাকে না। র‌্যাগিং ও বুলিং বন্ধে আইন যথেষ্ট নয়। আইন আরো বহু ক্ষেত্রেই রয়েছে; কিন্তু তার প্রয়োগের ওপর নির্ভর করে সফলতা। নীতিমালায় পাঁচ ধরনের র‌্যাগিং ও বুলিংকে সংজ্ঞায়িত করে তা হাইকোর্টে দাখিল করা হয়েছে।

পাঁচ ধরনের র‌্যাগিং ও বুলিং হলো- মৌখিক বুলিং ও র‌্যাগিং (উপহাস করা, খারাপ নামে ডাকা, গালি দেওয়া, হুমকি দেওয়া, শারীরিক অসমর্থতাকে উপহাস করা বা এতদসংক্রান্ত কার্যাবলী), শারীরিক বুলিং ও র‌্যাগিং (কাউকে কোনো কিছু দিয়ে আঘাত করা, চড়-থাপ্পড় মারা, শরীরে পানি বা রং ঢেলে দেওয়া, লাথি মারা, ধাক্কা দেওয়া, খোঁচা দেওয়া, বেঁধে রাখা, কোনো বিশেষ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে বা বসে বিশেষ অবস্থায় থাকতে নির্দেশ দেওয়া, কারো জিনিস জোর করে নিয়ে যাওয়া, মুখ বা হাত দিয়ে অসৌজন্যমূলক অঙ্গভঙ্গি করা ইত্যাদি), সামাজিক বুলিং ও র‌্যাগিং (কারও সম্পর্কে গুজব ছড়ানো, কাউকে প্রকাশ্যে অপমান করা, ধর্ম বর্ণ, জাতি, গোত্র, গায়ের রং, অঞ্চল বা জাত তুলে কোনো কথা বলা বা এরকম কাজ করা), সাইবার বুলিং-র‌্যাগিং (কারো সম্পর্কে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কটু কিছু লেখা, ছবি বা অশালীন ব্যাঙ্গাত্মক কিছু পোষ্ট করে তাকে অপদস্থ করা) এবং সেক্সুয়াল বুলিং ও র‌্যাগিং (ইচ্ছাকৃতভাবে শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে আপত্তিজনক স্পর্শ করা বা করার চেষ্টা করা, আঁচড় দেওয়া, জামা-কাপড় খুলে নেওয়া বা খুলতে বাধ্য করা বা এ ধরনের কার্যাবলি। আরো কিছুভাবেই বুলিং করা যায়। এটা আসলে অনেকেই নিছক নিজের ক্ষমতা দেখানোর জন্য, মজা করার জন্য এবং অন্যকে মানসিক চাপে রাখার জন্য করে। একটি ছোটো মানসিকতার পরিচয় দেয় যারা এই কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকে। একটি শিক্ষিত রুচিসম্পন্ন ছাত্র এসব কাজের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে, তা ভাবতেই কষ্ট হয়। কিন্তু এসব এতদিন হয়েছে। এখনও যে রাতারাতি বন্ধ হবে সেটাও জোর দিয়ে বলা যায় না। এর জন্যও পারিবারিক সুশিক্ষা দরকার। ছোটো বেলা থেকে সন্তানকে শেখাতে হয়, কাউকে কোনোভাবে কষ্ট দেওয়া পাপ বা অন্যায়। এ তো গেল আইনগত প্রতিরোধের দিক। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো পবিত্র একটি স্থানে র‌্যাগিং বা বুলিং-এর মতো অমানবিক ঘটনাগুলো কেন ঘটবে? নতুন শিক্ষার্থীদের ভাতৃত্বসুলভ আচরণ দিয়ে বরণ করার পরিবর্তে সুযোগ পেলেই তার ওপর বড়ভাইয়ের প্রভাব খাটানোটাই এখন রীতিতে দাঁড়িয়েছে। বড় ভাইকে সালাম না দেওয়ার মতো তুচ্ছ ঘটনাকেও অপরাধ বলে গণ্য করা হয়! এর জন্য একজন নবীন শিক্ষার্থীকে বিচিত্র কষ্টদায়ক শাস্তি পেতে হয়! তাকে বাধ্য করা হয়।

যদিও তাকে বোঝানোর আরো ভালো উপায় ছিল, তার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার পরিবর্তে ভয়ের সম্পর্ক করা হয়। নবীন শিক্ষার্থীরা তাদের ভয় পায়। আর এতেই কথিত বড় ভাইদের আনন্দ! ভাবা যায়! সভ্য সমাজে শিক্ষিত জাতি আমরা কাদের নিয়ে গড়ছি? এইসব ভয় দেখানো, শারীরিক নির্যাতন করা বড় ভাইদের দিয়ে! আমরা চাই, একজন ছাত্র যার মধ্যে ছাত্রত্বের গুণ সবগুলো থাকে, অছাত্রের নয়।

লেখক : কলামিষ্ট।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত