ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

দেশকে দূষণমুক্ত রাখতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া দরকার

মাহমুদ সালেহীন খান
দেশকে দূষণমুক্ত রাখতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া দরকার

সারা বিশ্বজুড়ে প্রবল খরা, তাপমাত্রা বাড়ছে, শৈত্যপ্রবাহ, বন্যা, ঝড় হচ্ছে যার অন্যতম কারণ জলবায়ুর পরিবর্তন। বিশ্বজুড়ে বদলে যাওয়া জলবায়ু ইস্যুতে দুনিয়া জুড়ে পরিবেশবিদ, পরিবেশবাদী ও সচেতন মহল আন্দোলন করছে। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, জলবায়ু সংকটের প্রভাব, পানি সংকট ও টেকসই চাষাবাদের অভাব কৃষিকে হুমকির মুখে ফেলেছে। জলবায়ুর পরিবর্তনে আমরা বিভিন্ন দূষনের শিকার হচ্ছি। ইতিমধ্যে ঢাকা বেশ কয়েক বায়ু দূষনের দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের শীর্ষে ছিলো বেশ কয়েকবার। ঢাকায় বসবাস অযোগ্য হচ্ছে দিন দিন। বিভিন্ন দূষনে ঢাকাসহ দেশের প্রায় বেশিরভাগ শহরের বাসিন্দারা ভোগান্তির শিকার হচ্ছে নানা ধরনের রোগব্যাধি। বাংলাদেশে ভয়াবহ দূষণের অন্যতম হচ্ছে: বায়ু দূষণ, নদী দূষণ, শব্দ দূষণ, পরিবেশ দূষণ ইত্যাদি। এসবের জন্য প্রধানত দায়ী কল-কারখানা, ইটভাটা ও যানবাহনের নির্গত কালো ধোঁয়া, নির্মাণ সামগ্রীর ক্ষুদ্র কণা, পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে আগত বায়ু দূষণ ও বর্জ্য, উচ্চ শব্দ, পলিথিন ও প্লাস্টিক পণ্যের ব্যাপক ব্যবহার, শিল্প ও ই-বর্জ্য ইত্যাদি। বিশ্বের অনেক প্রতিষ্ঠান পরিবেশবান্ধব শিল্প ও স্থাপনার সনদ দেয়।তন্মধ্যে ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল (ইউএসজিবিসি) অন্যতম। এই সংস্থা ‘লিড’ (লিডারশিপ ইন এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন) নামে পরিবেশবান্ধব শিল্প ও স্থাপনার সনদ দেয়, যা পেতে সংস্থাটির তত্ত্বাবধানে নির্মাণ থেকে উৎপাদন পর্যন্ত ৯টি শর্ত পালন করতে হয় এবং যার মোট পয়েন্ট ১১০। তন্মধ্যে পয়েন্ট ৮০-এর ওপরে হলে ‘লিড প্লাটিনাম’, ৬০-৭৯ হলে ‘লিড গোল্ড’, ৫০-৫৯ হলে ‘লিড সিলভার’ ও ৪০-৪৯ হলে ‘লিড সার্টিফায়েড’ সনদ পাওয়া যায়। ইউএসজিবিসি থেকে গত ৭ আগস্ট নতুন করে দুটি কারখানা সনদ পেয়েছে। ফলে উক্ত সংস্থা থেকে বাংলাদেশের সনদ পাওয়া মোট শিল্পের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০০টি। তন্মধ্যে ৭৩টি লিড প্লাটিনাম, ১১৩ গোল্ড, ১০ সিলভার ও ৪টি সার্টিফায়েড। এদের অধিকাংশই পোশাক ও বস্ত্র কারখানার। অথচ, বাংলাদেশে অসংখ্য শিল্প ও স্থাপনা রয়েছে। এসবের মধ্যে যারা ইউএসজিবিসির সনদ পায়নি তারা পরিবেশ বিধ্বংসী! রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার দেশের ৫৬টি প্রধান নদীর ওপর গবেষণা করে সম্প্রতি বলেছে, ৫৬টি নদীতেই সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি দূষণের অস্তিত্ব মিলেছে, তবে তুলনামূলক বেশি দূষিত নদী লবণদহ, হাঁড়িধোয়া ও সুতাং। ২০২১ সালে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন মতে, প্রতিদিন ঢাকা সিটি করপোরেশন ৬,৪৬৪ টন বর্জ্য সংগ্রহ করে। এর ১০% প্লাস্টিক, যার ১২% খাল ও নদীতে এবং ৩% ড্রেনে ফেলা হয়। ফলে এসব মজে যাচ্ছে। বর্তমানে বর্জ্যের পরিমাণ আরো বেড়েছে। গত ১১ জুলাই, ২৩ প্রকাশিত সিপিডির গবেষণা প্রতিবেদন মতে, বাংলাদেশে বায়ু ও প্লাস্টিক দূষণ তীব্রতর হচ্ছে। বিশেষ করে, বড় শহরগুলোতে ওই দূষণ মারাত্মক রূপ নিচ্ছে। ঢাকাসহ বড় শহরে হু’র মানমাত্রার তুলনায় ১৬ গুণ বেশি বায়ুদূষণ হচ্ছে। অন্যদিকে, ২০০৫ সালে ঢাকায় মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার ছিল ৯ কেজি ২০০ গ্রাম, ২০২২ সালে তা বেড়ে হয়েছে ২২ কেজি ২৫০ গ্রাম। ব্যবহার হওয়া এসব প্লাস্টিকের বড় অংশই প্রকৃতিতে জমা হয়ে দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতি হচ্ছে। আবার দেশের উপকূলীয় নদীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য জমা হচ্ছে কর্ণফুলী নদীতে, ৩৯% ও রূপসা নদীতে প্রায় ৩২%।বিশ্বের যে ২০টি দেশে ব্যবহার করা প্লাস্টিক সামগ্রী সবচেয়ে বেশি অব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ফেলে দেওয়া হয়, তার মধ্যে বাংলাদেশ দশম। উপরন্তু পার্শ্ববর্তী দেশ থেকেও প্রতিনিয়তই বর্জ্য ও দূষণ আসছে। গত আগস্ট,২২ প্রকাশিত এসডোর তথ্য মতে, বাংলাদেশের আন্ত সীমান্ত নদীগুলো প্রতিদিন প্রায় ১৫,৩৪৫ টন একবার ব্যবহৃত প্লাস্টিক বর্জ্য বহন করে। তন্মধ্যে ২,৫১৯ টন ভারত ও ২৮৪ টন মিয়ানমারের। প্রতিবছর বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ছে প্রায় ২৬,৩৭,১৭৯ টন প্লাস্টিক বর্জ্য। দেশ-বিদেশের এসব প্লাস্টিক দেশের মাটি, পানি, মাছ ও উদ্ভিদের ক্ষতি এবং জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্যও নষ্ট হয়ে নিত্য নতুন ব্যাধি সৃষ্টি হচ্ছে। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা গত ২২ মে বলেছে, গত ৫০ বছরে চরম আবহাওয়া, জলবায়ু ও নিরাপদ পানি সংক্রান্ত ঘটনার কারণে বাংলাদেশে ১০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

এছাড়া, আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। তাই ওয়ান টাইম ব্যবহৃত ও ননরিসাইক্লিং প্লাস্টিক পণ্যের উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছে। এসব অনেক দেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু পরিবেশবাদী সংগঠন-গ্রিনপিস সম্প্রতি বলেছে, পুনর্ব্যবহৃত প্লাস্টিক তার ভার্জিন উপাদানের চেয়েও বেশি বিষাক্ত। স্মরণীয় যে, প্লাস্টিক শুধুমাত্র প্রকৃতিরই ক্ষতি করছে না, সেই সঙ্গে মানুষ ও প্রাণীকূলেরও ক্ষতি করছে। এর ক্ষুদ্র কণা খাদ্যচক্রের সাথে মিশে মানুষের শরীরে ঢুকে নানা জটিল ব্যাধি সৃষ্টি করছে। বিজ্ঞানীরা মাছ ও মায়ের দুধেও প্লাস্টিকের কণা পেয়েছেন। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতিবছর দেশে সৃষ্টি হচ্ছে ৩০ লাখ মেট্রিক টন ই-বর্জ্য। সেই হিসাবে ২০২৫ সাল নাগাদ কোটি টনের ই-বর্জ্যের ভাগাড়ে পরিণত হবে বাংলাদেশ। দেশে মিথেন গ্যাসেরও প্রকোপ ব্যাপক। গত ১৪ মার্চ প্রকাশিত আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ লেটারের তথ্য মতে, বিশ্বের ৬১টি শহরের মিথেন গ্যাস নির্গত হওয়া তালিকায় ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়,করাচী প্রথম। মিথেন গ্যাস সৃষ্টির পেছনে গ্যাস-সংযোগের ছিদ্র, বর্জ্য ও বর্জ্য মিশ্রিত পানির ভূমিকা রয়েছে। মিথেন গ্যাসের কারণে শহরের বাতাস বিপজ্জনক হওয়া ছাড়াও তাপমাত্রাও বাড়াচ্ছে। ফলে অক্সিজেনের পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছ এবং শহরের অধিবাসীদের শ্বাসকষ্টসহ নানা ধরনের সমস্যা বাড়ছে। গৃহস্থালি, দোকান ও বাজারের বর্জ্যের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে যত্রতত্র পড়ে থাকে, যার বিরাট অংশ পানি, ড্রেন ও জমিতে পতিত হয়ে সংকট সৃষ্টি করছে। যেটুকু বর্জ্য অপসারণ করা হচ্ছে, তা ফেলে দেওয়া হচ্ছে শহরের উপকণ্ঠে। সেখান থেকেও পানি ও জমিতে পতিত হচ্ছে। বাকীগুলো সেখান থেকে পচে-গলে ব্যাপক দুর্গন্ধ সৃষ্টি করছে। বর্জ্য থেকে সার ও বিদ্যুৎ তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার অগ্রগতি নগণ্য! শিল্প বর্জ্য ও পয়োঃবর্জ্যও পানিতে পতিত হয়ে ব্যাপক দূষণ সৃষ্টি করছে। ২০০২ সালে দেশে পলিথিনের শপিং ব্যাগ নিষিদ্ধ করে কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা হয়েছিল। ফলে উক্ত পণ্যের উৎপাদন ও ব্যবহার বন্ধ হয়েছিল, যার সুফল সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের পর শিথিলতার কারণে পুনরায় পলিথিনের শপিং ব্যাগের যাত্রা শুরু হয় এবং মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহৃত হতে থাকে, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। পলিথিনের ব্যাগ অপচনশীল। তাই খাল-বিল, নদী, হাওর-বাওর, পুকুর, ড্রেন ইত্যাদিতে পতিত হচ্ছে। ফলে সেসব মজে যাচ্ছে। উপরন্তু পলিথিনের স্তূপের কারণে সংস্কারেও ব্যাঘাত ঘটছে! সর্বোপরি পলিথিন মাটিতে পতিত হয়ে মাটির উর্বরা শক্তি কমিয়ে দিচ্ছে। গত ২৮ মার্চ প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন মতে, বিশ্বের ১০টি সর্বাধিক বায়ু দূষণ শহরের মধ্যে নয়টিই দক্ষিণ এশিয়াতে এবং ঢাকা এদের মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশে মোট অকাল মৃত্যুর ২০ শতাংশর জন্যই দায়ী বায়ু দূষণ। অন্যদিকে, বৈশ্বিক নীতি অনুযায়ী প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য প্রতিটি দেশের ২৫% বনাঞ্চল থাকা দরকার। কিন্তু দেশে প্রয়োজনের এক তৃতীয়াংশও বনাঞ্চল নেই। যেটুকু আছে, তাও উজাড় হয়ে যাচ্ছে। নতুন বৃক্ষ রোপণও কম। গত এপ্রিলে প্রণীত ইউরোপীয় পার্লামেন্টে অনুমোদিত এক আইনে বলা হয়েছে, কোনো পণ্যের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যে কোম্পানি বন উজাড়ের সঙ্গে যুক্ত থাকবে তার পণ্য আমদানি ও বিক্রির অনুমতি দেবে না ইইউ। উচ্চ শব্দের কারণে মানুষের শ্রবণ শক্তি হ্রাসসহ নানা ব্যাধি সৃষ্টি হচ্ছে।

শিল্প, যানবাহন ও ইটভাটার কালো ধোঁয়া, নির্মাণ সামগ্রীর ক্ষুদ্র কণা, জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যাপক ব্যবহার ইত্যাদি কারণে বায়ু দূষণ বাড়ছে। এসব দূষণ রোধ করার তেমন উদ্যোগ নেই। ২০ বছরের পুরনো বাস ও ২৫ বছরের পুরনো ট্রাক নিষিদ্ধ করার পর তা পুনরায় স্থগিত করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট মালিক ও শ্রমিকের চাপের কারণে! এতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটি। সার্বিকভাবে দেশের পরিবেশের মারাত্মক অবনতি হয়েছে। তবুও প্রতিকারের কোন লক্ষণ নেই। এনভায়রনমেন্টাল পারফরমেন্স ইনডেক্স-২০২০ অনুযায়ী, পরিবেশ দূষণ রোধে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১৬২তম।বর্তমান অবস্থাও তথৈবচ! ফলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।২০২২ সালে প্রকাশিত ল্যানসেটের প্রতিবেদন মতে, বাংলাদেশে ২০০০-০৪ সালের তুলনায় ২০১৭-২০২২ সময়কালে অতি তাপমাত্রার কারণে মৃত্যু বেড়েছে ১৪৮%। দূষণের কারণে জানমালের অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। তাই সব ধরণের দূষণ বন্ধ করা জরুরি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত