ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

অনুদান নিয়েও মানসম্পন্ন সিনেমা হচ্ছে না কেন?

রেজাউল করিম খোকন
অনুদান নিয়েও মানসম্পন্ন সিনেমা হচ্ছে না কেন?

২০২২-২৩ অর্থবছরে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক শাখায় দুইটি, শিশুতোষ শাখায় দুইটি ও সাধারণ শাখায় ১৯টি পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমাকে ১২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা ও ছয়টি স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা ও প্রামাণ্যচিত্রকে এক কোটি দুই লাখ টাকা অনুদান দিয়েছে সরকার। সব মিলিয়ে অনুদানের পরিমাণ ১৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে অনুদানপ্রাপ্ত সিনেমার তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। ৬৫ লাখ টাকা অনুদান পাচ্ছে দুইটি সিনেমা। ৬০ লাখ টাকা অনুদান পাচ্ছে ১১টি সিনেমা। আদেশে অনুদানপ্রাপ্ত সিনেমার ক্ষেত্রে শর্ত বেঁধে দিয়ে বলা হয়েছে, অনুদানপ্রাপ্ত পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ শেষে সেন্সর সনদ প্রাপ্তি সাপেক্ষে দেশের কমপক্ষে ২০টি সিনেমাহলে মুক্তি দিতে হবে। অনুদানে নির্মিত চলচ্চিত্রগুলো বাংলাদেশ টেলিভিশনের চাহিদামতে প্রদর্শনের জন্য প্রযোজক সরবরাহ করবেন। আরেক শর্তে বলা হয়েছে, কোনো প্রযোজক পরপর দুই বছর অনুদান পাওয়ার যোগ্য হবেন না। তবে একই প্রযোজক দ্বিতীয়বার অনুদান পাওয়ার পর চার বছর পার করে পুনরায় অনুদানের জন্য আবেদন করতে পারবেন।

একজন প্রযোজক সর্বোচ্চ তিনবারের বেশি অনুদান পাবেন না। শর্ত হিসেবে আরো বলা আছে, অনুদানপ্রাপ্ত পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ শেষে সিনেমা হলে মুক্তি ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ শেষে সেন্সর সনদ গ্রহণ ছাড়া কোনো প্রযোজক পুনরায় অনুদানের জন্য আবেদন করতে পারবেন না। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশ সরকার মানসম্মত চলচ্চিত্র নির্মাণের লক্ষ্যে ১৯৭৬-৭৭ সাল থেকে চলচ্চিত্রে অনুদানের প্রথা চালু করে। মাঝপথে বন্ধ থাকলেও ২০০৭-০৮ অর্থবছর থেকে নিয়মিতভাবেই অনুদান প্রদান করা হচ্ছে। স্বাধীনতার এত সময় পর্যন্ত অনেক চলচ্চিত্র সরকারি অনুদান পেলেও সব চলচ্চিত্র যেমন এখনো মুক্তির আলো দেখেনি তেমনি খুব কম চলচ্চিত্রই এসেছে দর্শকদের আলোচনায়। তবে গত কয়েক বছর ধরে এই অনুদান দেওয়া নিয়ে নানা প্রশ্ন আর বিতর্ক উঠছে। অভিযোগ আছে, সিনেমা নির্মাণের জন্য এমন মানুষ অনুদান পান যাদের অর্থের অভাব নেই। আবার পরিচালনায় পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই এমন পরিচালকও পাচ্ছেন অনুদান। কাদের, কী কারণে এবং কোন পদ্ধতিতে অনুদানের জন্য মনোনীত করা হয়, সেই প্রশ্নও আছে।

অনুদানের চেক পাওয়ার নয় মাসের মধ্যে একটি সিনেমা তথ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে বলা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে কারো দেরি হলে তারা যুক্তিসঙ্গত কারণে দেখালে মেয়াদ বাড়াতে পারে। কিন্তু কয়েক বছর আগে অনুদান পেয়েছেন কিন্তু এখনো সিনেমার কাজ শেষ করতে পারেননি- এমন উদাহরণও অনেক আছে। আবার যোগাযোগ, তদবির এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় অপেশাদাররাও বছর বছর অনুদান বাগিয়ে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ। ফলে রাষ্ট্রের টাকার কেবল অপচয় হচ্ছে বছরের পর বছর। একটি ভালো সিনেমা নির্মাণ করে দর্শক পর্যন্ত পৌঁছাতে মেধাবী পরিচালকের সঙ্গে পেশাদার একজন প্রযোজকও অপরিহার্য। গত বছর মুক্তি পাওয়া একটি সিনেমার জন্য ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬০ লাখ টাকা সরকারি অনুদান পান প্রযোজক। সিনেমা মুক্তির আগে এ সিনেমার নায়িকা প্রযোজক এবং তার অনুদান পাওয়ার ব্যাপারে বেশকিছু অভিযোগ তোলেন। তিনি অভিযোগ করেন, সিনেমা নির্মাণের জন্য প্রযোজক ৬০ লাখ টাকা অনুদান পেয়েছেন। কিন্তু তিনি ২০ লাখ টাকাও খরচ করেননি। এছাড়া সিনেমা প্রযোজনার পূর্ব অভিজ্ঞতাও নেই সেই প্রযোজকের। তিনি রাজনৈতিকভাবে প্রভাব খাটিয়ে সরকারি অনুদান পেয়েছেন বলে নানা মহলে গুঞ্জন। তাহলে কি যে কেউ সরকারি অনুদান পেতে পারেন? মূলত সিনেমার চিত্রনাট্য বাছাইয়ের ওপর সরকারি অনুদান দেওয়া হয়ে থাকে। যার চিত্রনাট্য বা গল্প ভালো তিনিই অনুদান পান। সেক্ষেত্রে প্রযোজক-পরিচালক কোনো বিষয় নয়।

অন্যদিকে, অনেক নির্মাতাই রয়েছেন যারা সরকারি অনুদান নিয়ে বছরের পর বছর পার করে দিচ্ছেন। কেউ সিনেমা শেষই করতে পারছেন না, কেউ আবার সিনেমা শেষ করলেও সেটির মুক্তি আটকে আছে নানা কারণে। যেখানে সরকারি অনুদানের জন্য অন্যতম প্রধান শর্ত থাকে, অনুদানের প্রথম চেক প্রাপ্তির নয় মাসের মধ্যে ছবির কাজ শেষ করতে হবে। তবে বিশেষ অবস্থায় অনুরোধ সাপেক্ষে পরিচালক ওই সময় বৃদ্ধি করতে পারেন। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অনেকে নির্মাণের জন্য বছরের পর বছর সময় পার করছেন। নির্মাতাদের কোনো ধরনের জবাবদিহি করতে হয় না। দেশীয় চলচ্চিত্রে শিল্পগুণসম্পন্ন নান্দনিক ও নিরীক্ষাধর্মী চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য অনুদান প্রদানের পদ্ধতি শুরু হয়েছিল। শুরুর দিকে সরকারি অনুদানেই নির্মিত হয়েছিল ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ এবং ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’র মতো কালজয়ী চলচ্চিত্র। কিন্তু চলচ্চিত্র অনুদানে এই শিল্পগুণধর্মী চলচ্চিত্রের ধারা বহমান থাকেনি। বিগত বছরগুলোতে অনুদান প্রদানের প্রক্রিয়াটি বিতর্কিত এবং প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেছে। প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে চলচ্চিত্রের মান এবং গুণও। বেশ কয়েকজন চলচ্চিত্র সমালোচক ও লেখক এ বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কার্যত সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। তথ্য মন্ত্রণালয়কে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতেও দেখা যায়নি। আমরা চাই, চলচ্চিত্র অনুদানের এই রাষ্ট্রীয় প্রণোদনাটি স্বচ্ছ ও জবাবদিহি প্রক্রিয়ায় গতিশীল থাকুক। চলচ্চিত্রের উন্নয়নের জন্য সরকার অনুদান দিচ্ছে। এটি দিয়ে অনেকেই ব্যক্তিগত উন্নয়নে ব্যস্ত। কোনো সিনেমাই সময়মতো শেষ হচ্ছে না। সরকার চলচ্চিত্রকারদের সাহায্য করছে, সহযোগিতা করছে। সময়মতো কাজ শেষ করা তাদের দায়িত্ব। অনেকগুলো সিনেমা আছে ছয়-সাত বছর ধরে তৈরি হচ্ছে। এটি সিনেমায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। একটা সময় তো সেই সিনেমার গ্রহণযোগ্যতাই থাকে না। প্রতিবছর অনুদানের সিনেমার ঘোষণা আসে। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় শর্ত সাপেক্ষে ছবির আহ্বান করে। নিয়ম মেনে প্রযোজকরাও চিত্রনাট্য জমা দেন। অনুদানপ্রাপ্তির পরই যেন অনেক প্রযোজক ভুলে যান সব নিয়ম। ব্যতিক্রম থাকলেও বেশিরভাগ প্রযোজকই যেন নিয়মের তোয়াক্কা করছেন না। গত দুই অর্থবছরের অনুদান পাওয়া সিনেমাগুলোর দিকে তাকালে সে চিত্র দেখা যায়। সরকারি অনুদানের ছবির কাজ শুরু হয়, কিন্তু শেষ হয় না। অনুদানপ্রাপ্ত বেশিরভাগ ছবির ক্ষেত্রেই এই অনিয়ম দীর্ঘদিন ধরে নিয়মেই পরিণত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকারি কোনো কঠোর মনিটরিং ব্যবস্থাও নেই। চলচ্চিত্রে সরকারি অনুদান মানে অর্থের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। অনুদান পাওয়ার পর অনেক নির্মাতা ‘একটি ছবি নির্মাণে এই অর্থ যথেষ্ট নয়’ এই অজুহাত দেখিয়ে ও অর্থ হাতিয়ে নিয়ে পার পাওয়ার চেষ্টা করেন। অথচ নির্মাতারা অনুদানের অর্থের পরিমাণ জেনেই আবেদন করেন। তাহলে অর্থ পাওয়ার পর কেন ছবি নির্মাণে খোঁড়া অজুহাত দেখিয়ে অর্থ আত্মসাতের চেষ্টা করা?

সব মিলিয়ে সরকারি অনুদানের টাকা নিয়ে নয়-ছয় কোনোভাবেই থামছে না। আরেকটি অভিযোগ হলো, চিত্রনাট্যের সঙ্গে জমা দেওয়া শিল্পীর তালিকায় খ্যাতনামা শিল্পীদের নাম জমা দিয়ে অনুদান আদায়ের পর উল্লেখিত শিল্পীদের না নিয়ে ছোটখাটো শিল্পীকে নামমাত্র অর্থ বা বিনা অর্থে কাজ করিয়ে নেওয়া হয়। আবার শিল্পী না নিয়ে নির্মাতা নিজের আত্মীয়স্বজন দিয়ে অভিনয় করান। এরপরও কারচুপি আছে।

আর তা হলো স্পন্সর বা একজন প্রযোজককে প্রলুব্ধ করে তার কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে কোনোভাবে ছবির কাজ শেষ করে তা টিভি চ্যানেলের কাছে বিক্রি করে দিয়ে সেই নির্মাতা অসাধু পথে লাভবান হন। একটি ছবি নির্মাণ করতে দেড় বছরের বেশি সময় লাগা উচিত নয়। অনুদান প্রদান কমিটিতে দুর্বলতা থাকতে পারে। চলচ্চিত্রবোদ্ধারা বলছেন, সরকারি অনুদানের ছবি কে দেখে, কোথায় প্রদর্শন হয়, এসবের নির্মাণকাজ কখন শেষ হয়, আদৌ শেষ হয় কি না- এই বিষয়গুলো সরকারসহ কেউই জানে না। একসময় অনুদানের অনেক সিনেমা হলে মুক্তি পেত না, অনেকগুলো আর্টফিল্মের জন্য অনুদান দেওয়া হলেও বানায়নি বা বানালেও সেটি কেউ জানে না যেসব ছবি বানানো হয়নি। মানে সরকারি অর্থ নিয়ে নয়-ছয় করার এক বিরাট খাতের নাম হচ্ছে ‘চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য সরকারি অনুদান প্রথা’। এই অনুদান প্রথা বন্ধ করে ওই অর্থ চলচ্চিত্রের উন্নয়নে অন্য খাতে ব্যয় করা যেতে পারে।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও কলাম লেখক।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত