ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

শিক্ষার মূল লক্ষ্য হোক জ্ঞানার্জন

ওসমান গনি
শিক্ষার মূল লক্ষ্য হোক জ্ঞানার্জন

শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি আদর্শ জাতি হিসেবে গড়ে উঠতে পারে না। তাই সবার জন্য চাই শিক্ষা। তবে তা হতে হবে সু-শিক্ষা। যে শিক্ষার মাধ্যমে একজন মানুষ সু-নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারে, যে শিক্ষা গ্রহণ করলে একজন মানুষ সত্যিকারের জ্ঞানার্জন করতে পারে; শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য থাকতে হবে তাই। আবারো বলছি শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য জ্ঞানার্জন করা। কিন্তু আমাদের দেশে অনেকেই মনে করে থাকে শিক্ষা গ্রহণ করা অর্থ হলো চাকরির জন্য নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তোলা। যদি শিক্ষার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি সত্যিকারের জ্ঞানার্জন করতে পারে তাহলে চাকরি তার অবধারিত হবেই। তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ যেসব প্রতিষ্ঠান চাকরিতে লোক নিয়োগ করে থাকে তারা চায় জ্ঞানী লোক। আজকের দিনে শিক্ষা কতটুকু জ্ঞান অর্জনের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে, এ নিয়ে আমাদের ভাবার সময় এসেছে। আমাদের সন্তানরা আরাম-আয়েশ, বিনোদন, খেলাধুলাকে অনেকটা বিসর্জন দিয়ে শুধু পড়ছে তো পড়ছেই। এ পড়ালেখা কতটা পরিবেশবান্ধব, কতটা নিজের বা জাতির কল্যাণে আসছে, তা আমাদের গভীরভাবে উপলব্ধি করা প্রয়োজন। ছোট্ট শিশুদের ওপর চলে আসছে বিদেশি ভাষার কঠিন কঠিন শব্দ শেখানোর প্রবণতা। অধিকাংশ অভিভাবক এই ভেবে মহাখুশি যে, তাদের সন্তানরা খুব শিগগির মহাপণ্ডিত বনে যাবে। হাতের জড়তা না কাটতেই আঁকাজোকা শেখানোর আগেই ইংরেজি, আরবি ও বাংলা বর্ণমালা শেখাতে আমরা জোরজবরদস্তি শুরু করি। ভাবখানা এমন, শিশুকে জোর করে না শেখালে বড় হয়ে তাদের শেখার অভ্যাস গড়ে উঠবে না। প্রতিটি কাজের সময় সৃষ্টিকর্তা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। জন্মের পর ছয় মাস মায়ের দুধ ছাড়া অন্য খাবার নিষেধ। পরবর্তী সময়ে মায়ের দুধের পাশাপাশি ধীরে ধীরে শক্ত খাবার খেতে দিতে হবে। এভাবে নামাজ পড়ার বয়স, বিয়ের বয়সও নির্ধারণ করা হয়েছে। শিশুকালে অভ্যাস না করলে যথাযথ বয়সে কাজগুলো করা কষ্ট হবে এ যুক্তি অবাস্তব। বরং সঠিক সময়ে যথাযথ কাজটি সহজে স্বল্প সময়ে করা যায়। পাঁচ বছরের আগে শিশুদের নিজ পরিবেশ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার কথা। এ বয়সে শিশু ছড়া, কবিতা, সহজ সহজ শব্দের মাধ্যমে অক্ষরজ্ঞান ও আঁকাজোকার মাধ্যমে পড়ালেখা শুরু করবে। বেশি বেশি শব্দ শেখার মাধ্যমে শব্দের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হবে। এতে শিশু অধিকতর জ্ঞান লাভ করবে। শিশু মাতৃভাষা সমৃদ্ধ হলে সে বিদেশি ভাষায় দ্রুত জ্ঞান অর্জন করবে। শিশুর বয়স, রুচি ও সামর্থ্য অনুযায়ী শিক্ষাই ফলপ্রসূ হবে। আমাদের অভিভাবকদের মনে বদ্ধমূল ধারণা, বেশি বেশি বই, হোমওয়ার্ক শিশুদের মহাবিদ্যানে পরিণত করবে। অনেক অভিভাবককে বলতে শোনা যায়, যে স্কুল শিশুকে কঠোর শাসন বা বাড়িতে লেখাপড়ার চাপ দেয় সে স্কুল ভালো। শিশুদের ছড়া, কবিতা, গল্পের বই, দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, গান, খেলাধুলা এবং জাতীয় দিবসগুলোতে কী ঘটেছে, কেন ঘটেছে সে সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা ক্রমান্বয়ে দিতে হবে। শিশু তার দেশকে জানবে, ভালোবাসতে শিখবে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সমআচরণ গড়ে তুলতে হবে। ইসলামসহ সব ধর্ম শান্তির ধর্ম। কোনো ধর্মই উগ্রবাদ, জঙ্গিবাদ সমর্থন করে না। শিক্ষার্থীদের এ বিষয়ে জানাতে হবে। সরকারি শিক্ষকরা শিশু শিক্ষায় ট্রেনিংপ্রাপ্ত হলেও শিক্ষকস্বল্পতা, সরকারি নানা কাজে ব্যস্ততা এবং কারো কারো আন্তরিকতার অভাবে শিক্ষার্থীরা যথাযথ জ্ঞান অর্জন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ঢাকা নগরীর সরকারি ও কিন্ডারগার্টেনের অনেক শিক্ষক তাদের সন্তানদের নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ান না। প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তাদের মাঝেও এ প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। তাদের মনমানসিকতা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, সাধারণ মানুষের সন্তানদের সঙ্গে পড়া মর্যাদাহানিকর বলে তারা মনে করে। এ ভাবনার কারণে শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টি করে তারা সমাজে ভেদাভেদ তৈরি করে। ভুলে যায় হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, ধনী, দরিদ্র, কৃষক, শ্রমিকসহ বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত সবাই বাঙালি। আমি অনেক কিন্ডারগার্টেন ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষককে নিজ সন্তানদের পড়াশোনার জন্য বিদ্যালয়ের কাজে ফাঁকি দিতে দেখেছি। শিক্ষা আমাদের নৈতিক অবক্ষয় দূর করবে, সমাজে বৈষম্য কমাবে, এ ভাবনা আমাদের মাঝে থাকতে হবে। শিক্ষক, শিক্ষার সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা ও ম্যানেজিং কমিটির সদস্যরা পারে নিজেরা বৈষম্য সৃষ্টি না করে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে। কিন্ডারগার্টেন শিক্ষকদের অভিভাবকদের কাছে জবাবদিহি করতে হয় বলে তারা শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত তদারকি বা যত্ন নিয়ে থাকেন। সরকারি শিক্ষকদের জবাবদিহি নেই বললেই চলে। তাদের জবাবদিহি অনেকটা কর্মকর্তাদের কাছে। ক্লাস না নিয়ে সমাপনীসহ অফিসের নানা কাজ করলে শিক্ষকতার সুনাম অর্জন হয়ে থাকে। একইভাবে ম্যানেজিং কমিটিকে ম্যানেজ করলে ভালো শিক্ষকের খেতাব পাওয়া যায়। কোনো অভিভাবক যদি কখনো ক্লাস না হওয়ার কারণ জানতে চান, তাহলে অফিসিয়াল কাজকর্মের দোহাই দিয়ে অনায়াসে পার পাওয়া যায়। শিক্ষকদের জন্য শিক্ষার্থীদের পাঠদানের কাজ যে মুখ্য, তা সরকারি শিক্ষকরা বেমালুম ভুলে গেছেন। সমাপনী পরীক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষকদের বিশেষ নজর থাকে, যা গোড়ায় যত্ন না নিয়ে আগায় যত্ন নেয়ার মতো। অফিসিয়াল কাজ, শিক্ষক সংকটসহ নানা কারণে প্রাক-প্রাথমিক থেকে চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের যথাযথ পাঠদান করা হয় না। নিচের ক্লাসের দুর্বল শিক্ষার্থীরা পঞ্চম শ্রেণিতে ওঠার পর তাদের কাঁচা কাঁঠাল কিলিয়ে-পিটিয়ে নরম করে পাকানোর মতো করা হয়। সমাপনীর পাসটাও অনেকটা তদ্রুপ। পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এবং জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমির মাঝে সমন্বয়ের অভাব। পাঠ্যপুস্তকগুলো শিক্ষার্থীর জ্ঞান অর্জনের তেমন সহায়ক নয়। পাঠ্যপুস্তকে অনুশীলনে অধ্যায়ভিত্তিক কিছু ব্যাকরণ বা গ্রামার সংজ্ঞা আকারে নয়, উদাহরণ হিসেবে গল্প বা অধ্যায় থেকে আলোচনা করে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে চাপ কিছুটা কমানো যেতে পারে। পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকগুলো, বিশেষ করে ‘বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়’ বইয়ের অনুশীলনীতে এমন প্রশ্ন আছে যা শিক্ষার্থীর পক্ষে নোট, গাইড বইয়ের সহায়তা ছাড়া শেখা সম্ভব নয়। অথবা শিক্ষককে ইন্টারনেটের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে শিক্ষার্থীদের শেখাতে হবে। পাঠ্যপুস্তক বিভিন্নভাবে সমৃদ্ধ করে প্রাথমিকে শিক্ষার্থীদের ফলপ্রসূ শিক্ষা প্রদান করা সম্ভব। একটু গভীরভাবে উপলব্ধি করলে আমরা দেখতে পাব জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমির সঙ্গে নোট, গাইড বইয়ের প্রকাশকদের গভীর মিতালি। ২০১৫-১৬ সালের বাংলা প্রশ্নপত্রের রচনাগুলো পাঠ্যবইয়ের গদ্যের বাইরে থেকে আসছে। আগে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা থেকে সমাপনী ২০১৪ পর্যন্ত চারটি রচনা পাঠ্যবইয়ের গদ্যাংশ থেকে আসত এবং একটি রচনা পাঠ্যবই বহির্ভূত থাকত। এছাড়া পাঠ্যবই বহির্ভূত প্রশ্নের বাংলা, ইংরেজি বইয়ের নমুনা প্রশ্নপত্র সংগ্রহে অভিভাবকরা নোট-গাইডের সম্মুখীন হয়। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১৬-এর আলোকে সারা দেশে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বিগত চার বছরে কিছু প্রাথমিক বিদ্যালয় চালু হলেও শিক্ষকদের সৃজনশীল পদ্ধতির প্রশিক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে নোট-গাইড। সমাপনী পাসের পর ষষ্ঠ শ্রেণিতে শিক্ষার্থীর ওপর নেমে আসে চরম বইয়ের বোঝা। পঞ্চম শ্রেণিতে পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের নির্ধারিত বই ছয়টি। অপরদিকে সমাপনীর ক্লান্তিহীন ধকল পার হতে না হতে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে ১৪টি বোর্ড বই, তারপর নোট-গাইডের মতো সংক্রামক ব্যাধি তো আছেই। পরীক্ষায় ১০০ শতাংশ সৃজনশীল। অষ্টম শ্রেণির জেএসসি পরীক্ষার কারণে জুলাইয়ের মধ্যে শিক্ষার্থীদের বই পাঠ শেষ করতে হয়। এরপর বিদ্যালয়গুলোতে শুধু মডেল টেস্টকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। স্বল্পসময়ে যথাযথভাবে পড়িয়ে শেষ করতে না পারায় শিক্ষার্থীকে কোচিং সেন্টার, গৃহশিক্ষক বা নোট-গাইডের প্রতি ব্যাপকভাবে নির্ভর করতে হয়। কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয়গুলো সরকারের শিশু শিক্ষার ঘাটতি ব্যাপকভাবে পূরণ করে আসছে। বিদ্যালয়গুলো শিশু শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও সরকার তথা সংশ্লিষ্টদের কাছে তারা অনেকটা গুরুত্বহীন। প্রশিক্ষণবিহীন অবস্থায় কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয়গুলো অনেকটা প্রধান শিক্ষকের বা পরিচালকের নির্দেশনা মোতাবেক পাঠদান করে আসছে। যেহেতু শিশু শিক্ষায় তারা সরকারের বিরাট দায়িত্ব পালন করে দেশ ও জাতির বিশাল জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত করার দায়িত্ব পালন করছেন, সেহেতু শিশু শিক্ষার স্বার্থে স্বল্পমেয়াদি হলেও তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া জরুরি। কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয়গুলোকে সহজ প্রক্রিয়ায় রেজিস্ট্রেশনের আওতায় এনে সরকারি নিয়ন্ত্রণে নিলে দেশ ও জাতি জ্ঞাননির্ভর শিক্ষার আলোয় প্রজ্বলিত হবে। সবশেষে একটা কথা না বলে পারছি না। সব পেশায় নিজস্ব ক্যাডার আছে, নেই কেবল প্রাথমিক শিক্ষায়। আমাদের ছোটখাটো অনেক সমস্যা আছে। ধীরে ধীরে হলেও সেগুলো আলোচনায় আসছে। আমরা আশাবাদী, অচিরেই হয়তো এর সমাধান হবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত