সর্বজনীন নাগরিক পেনশন চালু যুগান্তকারী পদক্ষেপ

রেজাউল করিম খোকন

প্রকাশ : ২১ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সবার জন্য আরো ভালো ও উন্নত জীবন নিশ্চিত করতে সম্প্রতি সর্বজনীন পেনশন-ব্যবস্থার উদ্বোধন করা হলো। এ ব্যবস্থার লক্ষ্য হলো, দেশের ১৮ বছরের বেশি বয়সি নাগরিকদের এর আওতায় নিয়ে আসা। সর্বজনীন পেনশন-ব্যবস্থার উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা পেনশন স্কিম চালু করেছি যাতে দেশের প্রতিটি মানুষ একটি উন্নত জীবনযাপন করতে পারে। সর্বজনীন পেনশন-ব্যবস্থার উদ্বোধনকালে সরকারপ্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একমাত্র লক্ষ্য ছিল দেশবাসীকে একটি উন্নত জীবন উপহার দেওয়া, যার জন্য তিনি তার সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছেন। তিনি বলেন, আমরা শোকের মাসে সর্বজনীন পেনশন-ব্যবস্থা চালু করেছি। জনগণকে একটি সুন্দর ও উন্নত জীবন দেওয়ার আমাদের প্রচেষ্টা দেখে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বঙ্গমাতার আত্মা শান্তি পাবে। প্রধানমন্ত্রী প্রত্যেক দেশবাসীর জীবনকে অর্থবহ করার লক্ষ্যে তার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত কাজগুলো সম্পন্ন করার জন্য জনগণের কাছে দোয়া চেয়েছেন। তিনি বলেন, দেশের প্রত্যেক মানুষকে আরো ভালো ও উন্নত জীবন দিতে ব্যর্থ হলে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া দেশের স্বাধীনতা বৃথা যাবে। শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা দেশের স্বাধীনতাকে ব্যর্থ হতে দেব না, এটি ব্যর্থ হবে না এবং এটি ব্যর্থ হয়নি। তার (বঙ্গবন্ধুর) আদর্শ অনুসরণ করে আমরা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছি।’ প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়তে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা বজায় রেখে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশের দিকে অগ্রসর হওয়ার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন। প্রাথমিকভাবে ছয়টির মধ্যে চারটি স্কিম-প্রগতি, সুরক্ষা, সমতা ও প্রবাসী উদ্বোধন করা হয়েছে এবং অন্য দুটি পরে চালু করা হবে। সর্বজনীন পেনশন স্কিমের মূল লক্ষ্য দেশের ১৮ বছরের বেশি বয়সি সবাইকে এর আওতায় আনা এবং তারা তাদের ৬০ বছর বয়স হওয়ার পর আজীবন পেনশন সুবিধা ভোগ করবেন। পেনশন-ব্যবস্থার বয়সসীমা প্রাথমিকভাবে ৫০ বছর নির্ধারণ করা হয়েছিল, কিন্তু পরে তা সংশোধন করা হয়। ৫০ বছরের বেশি বয়সিরাও টানা ১০ বছর কিস্তি পরিশোধের পর পেনশন সুবিধা ভোগ করতে পারবেন।

দেশের চার শ্রেণির প্রায় ১০ কোটি মানুষের কথা বিবেচনায় রেখে চালু করা হচ্ছে সর্বজনীন পেনশন-ব্যবস্থা। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের হিসাব অনুযায়ী ২০২০ সালে ৬০ বছরের বেশি বয়সি মানুষের সংখ্যা এক কোটি ২০ লাখ এবং ২০৪১ সালে তাদের সংখ্যা হবে তিন কোটি ১০ লাখ।

এ বিশাল জনগোষ্ঠীকে একটি টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর আওতায় আনতে এবং নিম্ন আয় ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত সমাজের ৮৫ শতাংশ মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার সুযোগ তৈরি করতে দেশে প্রথমবারের মতো সর্বজনীন পেনশন-ব্যবস্থা (স্কিম) চালু করছে সরকার। সর্বজনীন পেনশন স্কিমের আওতায় কত মানুষ পেনশন সুবিধা পাবেন? পেনশন স্কিমের মাধ্যমে ১৮ বছরের বেশি দেশে-বিদেশে থাকা ১০ কোটি মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার চিন্তা রয়েছে সরকারের। পেনশন কর্তৃপক্ষ বলছে, মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে। ধীরে ধীরে বাড়ছে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা এবং তাদের নিরাপত্তাহীনতা। আর এ কারণেই চালু করা হচ্ছে সর্বজনীন পেনশন-ব্যবস্থা।

চারটি আলাদা স্কিম নিয়ে সর্বজনীন পেনশন-ব্যবস্থার যাত্রা শুরু হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা ও সমতা। প্রবাস স্কিমটি শুধু প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য। প্রগতি স্কিম বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবীদের জন্য। সুরক্ষা স্কিম রিকশাচালক, কৃষক, শ্রমিক, কামার, কুমার, জেলে, তাঁতি ইত্যাদি স্বকর্মে নিয়োজিত নাগরিকদের জন্য। আর সমতা স্কিম নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য। পেনশন-ব্যবস্থা পরিচালনা ও বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা অর্থ বিভাগের আওতাধীন জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ। দেশের ভেতরে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক সোনালী ব্যাংকের এক হাজার ২২৯টি শাখাই সর্বজনীন পেনশন-ব্যবস্থার সেবা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। পেনশন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এ ব্যাপারে সোনালী ব্যাংকের চুক্তি হয়েছে। সোনালী ব্যাংকে কারো হিসাব থাকুক বা না থাকুক, নির্ধারিত ফরম পূরণ করে এ ব্যাংকের মাধ্যমে ১৮ বছরের বেশি বয়সি যে কেউ পেনশন স্কিমের চাঁদা দিতে পারবেন। পেনশন-ব্যবস্থার আওতায় আসতে গেলে অবশ্যই জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) থাকতে হবে। প্রবাসী বাংলাদেশি যাদের এনআইডি নেই, তারা পাসপোর্টের ভিত্তিতে পারবেন। পেনশন-ব্যবস্থা চালু হলেও ২০১৫ সালে প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এ ব্যাপারে প্রথম উদ্যোগ নেন। ২০১৬ সালে ভারত ঘুরে এসে অর্থ বিভাগের একটি দল একটি ধারণাপত্র তৈরি করে। তবে কাজটি আবদুল মুহিত শেষ করে যেতে পারেননি। নতুন করে এ আলোচনা গতি পায় ২০২২ সালে এবং এ বছর আরেকটি ধারণাপত্র তৈরি করে অর্থ বিভাগ। এরপর এ বছরের ৩১ জানুয়ারি সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন এবং আইনের আওতায় গত ১২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়। চলতি অর্থবছরের বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনি ইশতেহারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে একটি টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর আওতায় বৃদ্ধকালীন সুরক্ষা নিশ্চিত করতে জাতীয়ভাবে একটি সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতি প্রবর্তনের অঙ্গীকার করেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালে সরকার জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্র প্রণয়ন করে। এতে দেশে একটি ব্যাপকভিত্তিক সমন্বিত অংশগ্রহণমূলক পেনশন-ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রস্তাব করা হয়। সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিরা সাধারণত চাকরিতে অবসর গ্রহণের পর এবং তার মৃত্যুর পর তাদের স্ত্রী ও পরিবারবর্গের ভরণপোষণে বড় একটি সহায় হিসেবে বিবেচিত হয় পেনশন। বাংলাদেশে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের জন্য আলাদাভাবে পেনশন প্রদানের ব্যবস্থা নেই।

এর বাইরে চাকরিজীবী নন যারা, ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা স্বাধীন কোনো পেশাজীবী তাদেরও বৃদ্ধ বয়সে পেনশন পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। অথচ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোতে যেখানে কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণা বাস্তবায়িত হয়েছে সেখানে সরকারের পক্ষ থেকে দেশের সব নাগরিকের জন্য পেনশন প্রদানের বিশেষ ব্যবস্থা চালু রয়েছে। যা নাগরিকদের জন্য বৃদ্ধ বয়সে এক ধরনের আর্থিক নিশ্চয়তা হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশ গত কয়েক দশকে সরকারের সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনীর আওতায় অস্বচ্ছল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কল্যাণে বৃদ্ধভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা প্রভৃতি কর্মসূচি চালু করেছে। যার আওতায় দেশের শহর ও গ্রামের বিশাল জনসংখ্যার একটি অংশ সামান্য হলেও মোটামুটি এক ধরনের আর্থিক সুবিধাপ্রাপ্ত হচ্ছেন সরকারের কাছ থেকে। শুধুমাত্র সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরতরা চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর পেনশন সুবিধা লাভ করলেও দেশের অবশিষ্ট চাকরিজীবী, পেশাজীবীরা সর্বজনীন পেনশন সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়ে গেছেন।

এবার প্রথমবারের মতো দেশে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করতে যাচ্ছে সরকার। ২০১৫ সালে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্রের খসড়া তৈরি করে দিয়েছিল। ওই খসড়ায় সর্বজনীন পেনশন স্কিমের সুপারিশ করা হয়েছিল। পরে তা ওই কৌশলে সন্নিবেশিত করা হয়। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করার জন্য বেশ কয়েকবার চেষ্টা করলেও কিন্তু তিনি শেষ পর্যন্ত তা চালু করে যেতে পারেননি। দেরিতে হলেও সরকার কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ২০০৮ সালের নির্বাচনি ইশতেহারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া অঙ্গীকার বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ গ্রহণ নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার।

এর ফলে সরকারি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত পেনশন সুবিধাভোগী মানুষদের বাইরে এই সুবিধাবঞ্চিত বৃহৎ অংশের নাগরিকরা বৃদ্ধবয়সে নতুন এই স্কিমের আওতায় পেনশন লাভের সুযোগ পাবেন। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে সরকার সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে চাইছে। অতীতে এরকম বৃহৎ কল্যাণমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। তবে এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সামর্থ্য বিবেচনায় পেনশন তহবিলের মাসিক কিস্তি নির্ধারণ করতে হবে। সমাজের কারা কারা পেনশন সুবিধাভোগী হবেন, এর বৈশিষ্ট্য ঠিক করার ক্ষেত্রে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কথা ভাবতে হবে। রাজনৈতিক বিবেচনায় কিংবা স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে বাছাই করে নির্দিষ্ট কিছু নাগরিককে অন্তর্ভুক্ত করে যেন এই তালিকা তৈরি করা না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে বেকারদের জন্য পেনশন সুবিধা রয়েছে। সেখানে একজন কর্মী যখন চাকরি করেন, তখন তিনি কিছু অর্থ জমা রাখেন। যদি কোনোভাবে তিনি বেকার হয়ে যান তখন সরকার কিছু অর্থ যোগ করে ওই ব্যক্তিকে পেনশনভাতা প্রদান করে। এটি স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। সেখানে প্রতারণা কিংবা জমানো অর্থ পেনশন হিসেবে পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনোরকম হয়রানির সুযোগ নেই। পেনশন তহবিলে যারা টাকা জমা রাখবেন তারা যেন সঠিক জায়গায় ভবিষ্যৎ নিশ্চয়তার জন্য টাকাটা রাখতে পারেন- তার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। সর্বজনীন পেনশন তহবিলে জমানো টাকা যেন বেহাত, আত্মসাৎ বা লুটপাট হয়ে না যায় সে ব্যাপারে কঠোর নজরদারি, নিরীক্ষণের ব্যবস্থা রাখতে হবে। এ জনকল্যাণমুখী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সরকারকে যেন বিশাল ক্ষতি ও ঘাটতির মুখে পড়তে না হয়- তার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। এক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত করা জরুরি।

সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা প্রবর্তন জাতির জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি অনন্য উপহার সন্দেহ নেই। জনকল্যাণমুখী সামাজিক সুরক্ষা কর্সসূচি হিসেবে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা সর্বাত্মকভাবে সফল হোক- আমরা প্রত্যাশা করি।

লেখক: রেজাউল করিম খোকন, অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও কলাম লেখক