ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সর্বজনীন পেনশনের যুগে দেশ উন্নয়নের নতুন অধ্যায়

অলোক আচার্য, শিক্ষক ও মুক্তগদ্য লেখক, [email protected]
সর্বজনীন পেনশনের যুগে দেশ উন্নয়নের নতুন অধ্যায়

দেশ এখন সর্বজনীন পেনশনের যুগে। এটি ইতিহাসের একটি নতুন অধ্যায়, ধারাবাহিক উন্নয়ন চ্যালেঞ্জের বিজয়। এতদিন কেবল সরকারি চাকরিজীবিরা অবসর পরবর্তী সময়ে পেনশনের মতো নিশ্চিত একটি নিরাপত্তার আওতায় থাকতেন। এখন থেকে আপামর জনসাধারণ যারা সর্বজনীন পেনশনের উপযুক্ত তারাও পেনশন পাবেন। বৃদ্ধ বয়সে একটি নিশ্চিত জীবন পাবেন। এখন যেমন অনেক বয়স্ক মা-বাবাকে বৃদ্ধ বয়সেও নিজের খাবারের যোগানের চিন্তা করতে হয়, এখন অনেকের আর সেই চিন্তা থাকবে না। নির্দিষ্ট বছর পেনশন বাবদ মাসিক চাঁদা দিলেই একটি নিশ্চিত জীবনের নিশ্চয়তা পাওয়া যাবে। বাংলাদেশে যে উন্নয়ন হচ্ছে সেটি দৃশ্যমান। অবকাঠামোগত উন্নয়ন তো হচ্ছেই। এই সামাজিক নিরাপত্তা একটি বিশাল পদক্ষেপ। বর্তমান সরকারের একটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য এটি। দেশের বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিতের লক্ষ্যে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনি ইশতেহারে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতি প্রবর্তনের অঙ্গিকার করেছিলেন। অবশেষে সেটি এখন কার্যকর হচ্ছে।

এটি দীর্ঘদিনের জনসাধারণের প্রত্যাশা। ফলে অভূতপূর্ব সাড়া ফেলবে এমনটিই আশা করা যায়। কোনো দেশের উন্নয়ন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। দেশের সার্বিক জীবনমান, অবকাঠামো এবং আর্থসামাজিক অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন করা একটি সময়সাপেক্ষ বিষয়। এখানে দেশের অর্থনীতির গতি এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রভাব বিস্তার করে। কিন্তু ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে সক্ষম হলে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন করা সম্ভব। এক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতা উন্নয়নের বিপরীতে কাজ করে সেসব প্রতিবন্ধকতাসমূহ দূর করা, নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি, প্রযুক্তির ব্যবহার প্রভৃতিকে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যেতে হয়। বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্ভাবনাময়। বিগত এক দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্রমাগতভাবে শক্তিশালী হয়েছে। স্বাধীনতার ৫২ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি শক্তিশালী অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে। বদলে গেছে বাংলাদেশ। আজকের বাংলাদেশ সারা বিশ্বের কাছে একটি বিস্ময়। ৫২ বছরে দেশে জনসংখ্যা বেড়েছে। প্রয়োজন হয়েছে বিপুল খাদ্যের যোগান। কিন্তু খাদ্যাভাব ঘটেনি। বরং বিশ্বে খাদ্য উৎপাদনে সাফল্য দেখিয়েছে। মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। স্বাধীনতা উত্তর ১৯৭১ সালে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৮৮ ডলার। বেড়েছে জীবনযাত্রার মান। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে করোনা বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোই সেই ধারায় কিছুটা পরিবর্তন এনেছে। কিন্তু মহামারির সময়েও দেশের অর্থনীতি এগিয়ে চলেছে। পদ্মা সেতু চালু হয়েছে, রাজধানী জুড়ে মেট্রোরেল চলছে। আরো বহু উন্নয়ন অবকাঠামো চলমান রয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে এশিয়ার পরাশক্তি প্রতিবেশি ভারত, চীন, জাপান দ্রুত এগিয়ে চলেছে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের উন্নতিও ঘটছে দ্রুতগতিতে। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে উন্নয়ন কার্যক্রম তরান্বিত হয়। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ প্রায় শূন্য অবস্থা থেকে শুরু করে তার অগ্রযাত্রা। তলাবিহিন ঝুড়ি বলে কটাক্ষ করতেও ছাড়েনি বিদেশিরা। আজ সেই তলা পূর্ণ হয়েছে। নানা প্রতিবন্ধকতা পাড়ি দিয়ে আজ দেশ বর্তমান অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এখন পাকিস্তানের মাথাপিছু আয়ের চেয়েও অনেক বেশি।

উন্নত দেশের কাতারে যাওয়ার অংশ হিসেবে দেশে মেগা প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। অচিরেই সেসব পুরোপুরি বাস্তবায়ন হবে। সাফল্যের তালিকা আজ দীর্ঘ। অবকাঠামো উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা, চিকিৎসা, খাদ্য নিরাপত্তা, বাসস্থান প্রভৃতি খাতেও প্রায় সমানভাবে উন্নয়ন হয়েছে। পদ্মা সেতু নির্মাণ করা, বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছে দেওয়া, উপবৃত্তি প্রদান, প্রতিটি ইউনিয়নে ডিজিটাল তথ্য সেবাকেন্দ্র, কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে প্রত্যন্ত দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা, সমুদ্র সীমানা বিজয়, বয়স্ক ও বিধবা, প্রতিবন্ধী ও মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রদান, রাস্তাঘাট তথা যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া, মেট্রোরেলের স্বপ্ন পূরণ, মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ, গৃহহীনদের ঘর বরাদ্দ দেওয়া, মডেল মসজিদ নির্মাণ, নারীর ক্ষমতায়ন ইত্যাদি আরো বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি আজ দৃশ্যমান। শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে এবং অপুষ্টি, মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যে অগ্রগতি হয়েছে। কৃষিভিত্তিক দেশ এখন কৃষি ও শিল্পে একসঙ্গে এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশের পোশাক শিল্প লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান, বৈদেশিক বাণিজ্য তথা অর্থনীতির ভীত শক্তিশালী করছে। যে দেশ একসময় বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্বকে খাটো করে দেখেছে তারাও আজ স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছে যে, বাংলাদেশ দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে। ২০১৯ সালের ২৬ ডিসেম্বর প্রকাশিত যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইকনোমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিচার্স (সিইবিআর) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০৩৩ সালে অর্থনীতিতে মালয়েশিয়া, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশকেও ছাড়াব আমরা।

এখন বর্তমান সরকারের লক্ষ্য হলো দেশকে আগামী ২০৪১ সালের মধ্য উন্নত দেশে পৌঁছে দেওয়া। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ধারায় তাল মেলাতে বাংলাদেশও প্রস্তুত। খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশে প্রভূত অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। এক তথ্যে দেখা যায়, বাংলাদেশে এখন প্রতি বছর চার কোটি মেট্রিক টন দানাদার খাদ্য উৎপাদন হচ্ছে। এর মধ্যে প্রধানত চাল, গম ও ভুট্টা। এর বাইরেও দানাদার খাদ্য উৎপাদিত হচ্ছে। ১৯৭২ সালের শুরুতে উৎপাদনের এ পরিমাণ ছিল এক কোটি ১৮ লাখ মেট্রিক টন। ৫২ বছরে বাংলাদেশ ধানের উৎপাদন বেড়েছে তিন গুণেরও বেশি। গমের উৎপাদন দ্বিগুণ হয়েছে। সবজি উৎপাদন বেড়েছে পাঁচগুণ। তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে মাঝারি আয়ের দেশে উন্নতি হওয়া আমাদের দেশ নতুন এক সাফল্য স্পর্শ করেছে। পাকিস্তানিদের শোষণ ও নিপীড়ন থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে বিভিন্নভাবে রাজনৈতিক পালাবদল ঘটেছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র বিদায় নেয়। দেশে গণতান্ত্রিক ধারা ফিরতে বহু বছর সময় নেয়। আন্দোলন হয়, রক্ত ঝরে। সে আরেক ইতিহাস। এরপর থেকে দেশ ক্রমোন্নতির দিকে ধাবিত হয়েছে।

এদেশের অর্থনীতি হবে একসময় এশিয়ান টাইগার। এরকমটাই ছিল ভবিষ্যদ্বাণী। সেক্ষেত্রে দরকার ছিল যোগ্য নেতৃত্বের। দরিদ্র দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটেছে। ক্রমোন্নতির এই ধারায় বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে। একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় বাংলাদেশ অবশ্যই উন্নত দেশে পরিণত হবে। একসময় তলাবিহীন এই ঝুড়ির তলা আজ মজবুত। আমরাও করতে পারি তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো পদ্মা সেতু। বাইরের দেশ যখন মুখ ফিরিয়ে নিল তখনো বাংলাদেশ হাল ছাড়েনি। হাতে হাত রেখে পদ্মা সেতু তৈরিতে লেগে গেল। যারা এতদিন হবে না, সম্ভব না বলে মুখ ফিরিয়ে হাসছিল তারা অবাক হয়ে লক্ষ্য করল যে কাজ শেষ। আজ সে স্বপ্ন বাস্তাবায়ন শেষ। যোগাযোগ ব্যবস্থায় অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন হবে এই পদ্মা সেতুর সুবিধা গ্রহণের মাধ্যমে। দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলের সড়কেও লেগেছে উন্নয়নের ছোঁয়া। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না বাঙালি সেই জাতি যারা পাকিস্তানিদের বন্দুকের নলের সামনে দাঁড়িয়ে দেশের স্বাধীনতা বীর দর্পে ঘোষণা করেছে। সেই জাতি এত সহজে হার মানবে না। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের এই দেশ স্বাধীনতা লাভ করে। ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া এই দেশের ঘামে ভেজা মানুষের হাত ধরে দেশ আমাদের অগ্রযাত্রা। আমরা আরো এগিয়ে যাব একথাও নিশ্চিত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন তা অবশ্যই একদিন পূরণ হবে। বাংলাদেশের প্রধান সম্পদের মধ্যে রয়েছে জনশক্তি। এক্ষেত্রে চীন বড় একটি উদাহরণ। বিশাল জনশক্তি নিয়েও চীন আজ অর্থনীতি, সামরিকসহ সব দিক থেকে উন্নত দেশ। ভারত তার জনশক্তিকে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে চলেছে। জনশক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার করার জন্য জনগণকে দক্ষ করে গড়ে তোলা আবশ্যক। জনগণকে সম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রযুক্তি এবং কারিগরি শিক্ষায় দক্ষ করে তোলার চেষ্টা করতে হবে। বাংলাদেশ একসময় বিশ্বের শক্তিশালী অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম হবে। এ দেশ অর্থনীতি এবং অবকাঠামোতে বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। সর্বজনীন পেনশন উন্নয়নের এক নয়া দিগন্ত। বয়স্ক জীবনের সবচেয়ে বড় নির্ভরতা অর্থ। সেই নিশ্চয়তা নিশ্চিত হলে বাকি দিনগুলো নির্ভার থাকা যায়। সর্বজনীন পেনশন এক নতুন অধ্যায়।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত