ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট : আমার লেখা একটি চিঠি

পিআর প্ল্যাসিড, জাপান
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট : আমার লেখা একটি চিঠি

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট। আমি তখন খুব ছোট ছিলাম যদিও, তখন ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনার কথাই আমার এখনো মনে আছে। সেই সময় বাড়িতে আমাদের একটি রেডিও ছিল। প্রতিদিন রেডিওতে বাবা এবং আশপাশের অনেকে সংবাদ শুনতেন। বড় বোনেরা শুনতো গানের অনুষ্ঠান দুর্বার। মাঝেমধ্যে বাংলা নাটক শোনার কথাও মনে আছে। যেদিনের কথা বলছি, সেদিন সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে চোখ কচলাতে কচলাতে রেডিওতে বড়বোনদের কেউ একজন রেডিওতে টিউনিং করছিল গান শোনার জন্য। সময় সঠিক মনে নেই। তবে সকাল বেলা রেডিও অন করতেই শুনতে পাই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার সংবাদ। সঙ্গে সঙ্গে বোনেরা চেঁচিয়ে বলল, এই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। সেদিনের সেই চিৎকার দিয়ে বলা বোনদের দুঃসংবাদটির কথা এখনো আমার কানে বাজে। কোনোভাবেই আমি সেদিনের অপ্রিয় সেই সত্য কথাটি ভুলতে পারছি না। যুদ্ধ চলাকালীন সময় আমরা প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা রেডিওতে দেশের অভ্যন্তরে কোথায় কি ঘটছে তা শুনেছি। সেই থেকে দেশ স্বাধীন হবার পরেও নিয়মিত সংবাদ শুনেছি। বাড়িতে বাবা ছিলেন সংবাদ শোনার পাগল। বোনেরা ছিল দুর্বার অনুষ্ঠান শোনার পাগল। সন্ধ্যার পর দুর্বার শুনে রেডিও বিছানায় নিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত নানা অনুষ্ঠান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ত। সকাল হলে বাবা এসে বোনদের বিছানা থেকে রেডিও চেয়ে নিতেন কিংবা আগে কেউ উঠলে বাবাকে আবার সকালের সংবাদ শোনার জন্য রেডিও নিয়ে দিত। যে কারণে সেদিন বোনেরা সংবাদ পাঠ করার সময়ের আগে রেডিও অন করে অন্য কোনো অনুষ্ঠান শুনতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সংবাদটি শুনেছিল। ঘটনার আগের দিন অর্থাৎ ১৪ই আগস্ট, বাবা বাজার থেকে অনেকগুলো এরোগ্রাম কিনে এনেছিলেন। বড় ভাই তখন থাকেন লন্ডন। ছুটিতে দেশে এসে বিয়ে করে বাড়িতে নতুন বউ রেখে আবার লন্ডন ফিরে যাবার কিছু দিন পরের সেই ঘটনা। বড় ভাইকে প্রায়ই বৌদি, বাবা-মা সবাই নীল খামে (এয়ারমেইল) বা এরোগ্রামে (চিঠি লেখার নীল কাগজ) চিঠি লিখতেন। আগের দিন রাতে একটি এরোগ্রামে বৌদি, বাবা-মা অল্প কথায় চিঠি লিখে আমার জন্য কয়েক লাইন লেখার স্পেস রেখেছিলেন। আমি যেহেতু ছোট ছিলাম হয়তো আদর করার কারণেই সেই এরোগ্রামে চিঠি লেখার সুযোগ দেওয়া। সবাই বলাবলি করছিলেন, আমি লিখলেই এরোগ্রাম বন্ধ করে তা পোস্ট করবেন। সকাল বেলা সেই সংবাদ শোনার পর বাড়িতে শুরু হয় এক ধরনের অস্থিরতা।

চারিদিকে চলতে থাকবে কানাঘুষা। অদৃশ্য কোনো কারণে সবার মনে তখন ভয় আর আতংক। ভয়ে কেউ মুখ খুলছিল না। সকালে আমি স্কুলে যাবার আগে বৌদি আমাকে বলছিলেন দাদাকে চিঠি লিখতে। সেদিনই বাবা বাজারে নিয়ে এই এরোগ্রামে লেখা চিঠি পোস্ট করার কথা। আমি বৌদির আদেশ মান্য করতে লিখে ফেললাম কয়েক লাইনের চিঠি। সেই চিঠি পড়ে বাড়িতে শুরু হয়ে গেল অন্যরকম কানাঘুষা। কোথায় আমাকে বাধ্য ছেলের মতো সবাই আদর করবে, তা না করে উল্টো রাগারাগি করতে শুরু করলেন আমার সঙ্গে বাবা এবং অন্যরা। যতদূর মনে পড়ে, সেদিন সেই চিঠি আর লন্ডনে বসবাসরত বড় ভাইয়ের উদ্দেশ্যে পোস্ট করলেন না বাবা। তাদের সবার ভেতর নাকি প্রচণ্ড এক ভয় কাজ করেছে। সবাই বলছিলেন সেই চিঠি পোস্ট করলে বাড়িতে পুলিশ এসে সবাইকে নাকি ধরে নিয়ে যাবে। বারবার বাবা বলছিলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার কারণে ঢাকায় জিপিওতে চিঠি খুলে পড়া হবে। এই চিঠি পড়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কথা দেখতে পেলে সবারই বিপদ হতে পারে এমন অজানা ভয়ে ভীত ছিলেন পরিবারের বড়রা।

চিঠিতে আমি লিখেছিলাম, দাদা তোমার প্রাণপ্রিয় নেতা শেখ মজিবুর রহমানকে হত্যা করেছে। এটাই নাকি ছিল তখন আমার অপরাধ। এই লাইনটি লেখার কারণে সেদিন এরোগ্রামে লেখা সেই চিঠি আর পোস্ট করা হয়নি। বলা হয়েছিল আমার জন্য এতটাকার একটা এরোগ্রাম নষ্ট করা হয়েছে। শাস্তিস্বরূপ আমাকে আর কখনো এরোগ্রামে চিঠি লিখতে দেওয়া হবে না। আমার সেইদিনের এই কষ্টের কথা পরবর্তীতে কাউকেই আর বলা সম্ভব হয়নি। আস্তে আস্তে যতই বড় হলাম কষ্ট যেন মনে জমাট বাঁধতে থাকল। স্কুল জীবন শেষ এসএসসি দিয়ে গ্রাম থেকে ঢাকা এসে কলেজে ভর্তী হলাম। বড় ভাই এর মধ্যে দেশে ফিরলেন। দেশে এসে ব্যবসা করার পাশাপাশি সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়ালেন। যে কারণে দেশের নানা শ্রেণির লোকদের সঙ্গে তার যোগাযোগ, সম্পর্ক। বলা যায়, বড় ভাইয়ের বদৌলতে দেশের অনেক প্রতিষ্ঠিত লেখক, সাংবাদিক, রাজনীতিবীদ এবং এমপি-মন্ত্রীদের খুব কাছ থেকে দেখার এবং কথা বলার সুযোগ হয়েছে। তাদের প্রায় সবারই আনাগোনা ছিল বড় ভাইয়ের বাসায়।

আমার যতটা মনে পড়ে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড নিয়ে আমি প্রথম তর্ক করি দেশের প্রখ্যাত সাংবাদিক ভয়েস অব আমেরিকার বাংলাদেশ প্রতিনিধি প্রয়াত গিয়াস কামাল চৌধূরীর সঙ্গে। এরপর ওনার পরামর্শে বিষয়টি সম্পর্কে আরো বেশি জানার জন্য বঙ্গবন্ধুর স্বঘোষিত খুনিদের সঙ্গে নানাভাবে নানা সময় দেখা করে কথা বলেছি। কথা বলেছি তার বিরোধী আদর্শের রাজনীতিবীদদের সঙ্গেও।

আমি আওয়ামী রাজনীতি করি না। তার মানে এই নয় যে, বিএনপি কিংবা অন্য কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। কলেজজীবন থেকে লেখক- সাংবাদিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে ছিলাম বদ্ধপরিকর। যে কারণে নানা সময় চলে যেতাম দেশের বিভিন্ন রাজনীতিবীদদের কাছে।

সেই সময় অর্থাৎ দেশে থাকাকালীন সময় আমার থেকে বয়সে বড়দের সঙ্গে বিশেষ করে যারা স্বাধীনতার নেতৃত্ব দিয়েছেন কিংবা দেশের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত তাদের কারো সঙ্গে দেখা হলেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার প্রকৃত কারণ জানার চেষ্টা করে নানা প্রশ্নবানে ভাসিয়ে দিতাম তাদের। বেশিরভাগ সময় আমাকে থামিয়ে দেওয়া হতো। তারা বলতেন, বেশি করে পড়াশোনা করতে। নিজেই একসময় সত্য ঘটনা উদ্ঘাটন করতে পারবো। এমনকি বিচারপতি আবদুস সাত্তার রাষ্ট্রপতি পদে থাকাকালীন সময় একবার বঙ্গভবনে যাবার সুযোগ হয়েছিল। তখন রাষ্টপ্রতির হাত ধরে তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, হল ঘরে বিভিন্ন জনের ছবি থাকলেও বঙ্গবন্ধুর ছবি নেই কেন। তার উত্তর ছিল একই। তুমি অনেক ছোট, বড় হও, পড়াশোনা করো একদিন তুমি নিজেই জানতে পারবে সব ঘটনা। সেদিন আমাকে এমন প্রশ্ন করতে শুনে ওনার সঙ্গে থাকা কয়েকজন লোক (সিকিউরিটি) আমার দিকে তাকিয়ে চোখ বড় করে শাসাচ্ছিলেন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত