ঝরেপড়া নয়, প্রতিটি নাগরিকের শিক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি

অলোক আচার্য

প্রকাশ : ২৪ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সবার জন্য শিক্ষা- এটাই শিক্ষার মূলমন্ত্র। দেশের প্রতিটি নাগরিক সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উন্নত বাংলাদেশ গঠনে অংশ নিবে। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে প্রয়োজন একটি স্মার্ট শিক্ষাব্যবস্থা। স্মার্ট শিক্ষার অন্যতম শর্ত হলো গুণগত শিক্ষা। স্মার্ট শিক্ষাই পারে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে। এর মধ্যে রয়েছে ডিজিটালাইজেশন অর্থাৎ চতুর্থ প্রজন্মের শিক্ষা। এছাড়া স্মার্ট শিক্ষার ভেতর রয়েছে শতভাগ উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া আর গুণগত শিক্ষার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন ঝরেপড়া রোধ করা। কিন্তু বিভিন্ন প্রতিকূলতা এবং সচেতনতার অভাবে শিক্ষাস্তরের বিভিন্ন পর্যায়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। ঝরে পড়ার কয়েকটি স্তর রয়েছে। প্রাথমিক শেষে, এসএসসি শেষে এবং এইচএসসি শেষে বহু শিক্ষার্থী ঝরে যায়। মেয়েদের ক্ষেত্রে তারা বাল্যবিয়ের শিকার হয় এবং ছেলেদের ক্ষেত্রে কোনো শ্রমমূলক কাজে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। শিক্ষায় টেকসই অর্জনের লক্ষ্যে এটি একটি প্রথম শ্রেণির বাধা। শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে পরিবর্তন ও পরিমার্জন করার উদ্দেশ্য হলো কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে শিক্ষাকে আরো যুগোপযুগী করে তোলা। শিক্ষার এই লক্ষ্য অর্জনে সরকার বহুবিধ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। এসব বহুবিধ উদ্দেশ্যের মধ্য অন্যতম হলো শিক্ষায় টেকসই উন্নয়ন সাধন বা মানসম্মত শিক্ষা প্রণয়ন করা। যেখানে শিক্ষার্র্থীর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে ঝরেপড়া হ্রাস করা একটি গুরুত্বপূর্ণ দীর্ঘদিনের পদক্ষেপ। ঝরেপড়া আমাদের দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের একটি দীর্ঘদিনের সমস্যা। এই সমস্যা ক্রমহ্রাস করার চেষ্টাও দীর্ঘদিনের। কেন শিক্ষার্থী ঝরেপড়ে বা কেন হঠাৎ বিদ্যালয়ে আসা ছেড়ে দেয় তার বেশকিছু কারণ রয়েছে। যার মধ্যে প্রথমেই রয়েছে দরিদ্রতা। অবশ্যই এটি কেবল আমাদের দেশের সমস্যা নয় বরং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অনেকে দেশেই এই সমস্যা রয়েছে। দরিদ্রতা উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে এই সমস্যা দূর হওয়ার কথা। মেয়ে শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে দরিদ্রতার সঙ্গে আরো একটি সমস্যা হলো বাল্যবিবাহ। পাবলিক পরীক্ষায় যেসব মেয়ে শিক্ষার্থী অনুপস্থিত থাকে তাদের একটি বড় অংশের অনুপস্থিতির কারণ অনুসন্ধান করলে বাল্যবিয়ে কারণ হিসেবে দেখা যাবে। এই সমস্যার সঙ্গে বহু আগে থেকেই সচেতনতা তৈরি করা হচ্ছে। তবুও এটি ঘটেই চলেছে। একই সময় ছেলে শিক্ষার্থীর অনুপস্থিতির কারণ হিসেবে অনেককেই বিভিন্ন শ্রমমূলক কাজে দেখা যাবে। বিভিন্ন গবেষণায় ঝরেপড়ার পেছনে যে কারণটি সবচেয়ে জোরালোভাবে উঠে এসেছে তা হলো পরিবারের আর্থিক অনটন। ছেলেদের ক্ষেত্রে কোনো কাজ শেখা বা কাজ করা এবং মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার ব্যস্ততা দরিদ্র পরিবারগুলোতেই বেশি দেখা যায়। আবার ভ্রান্ত ধারণাও এখানেই বীজ বপন করে। সর্বোপরি শিক্ষার প্রয়োজন আছে কি নেই সেই চিন্তা গভীরভাবে নেওয়ার আগেই বা সন্তানের মতামত জানার আগেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক তথ্যে জানা যায়, ২০২১ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল ২২ লাখ ৪০ হাজার ৩৯৫ জন। পাস করেছে ২০ লাখ ৯৬ হাজার ৫৪৬ জন। তাদের মধ্যে একাদশ শ্রেণিতে নিবন্ধন করেছে ১৭ লাখ ৬০ হাজার ৭৯৩ জন। একাদশ ও দ্বাদশ এই দুই শ্রেণিতে অধ্যয়ন শেষে এইচএসসি পরীক্ষার জন্য ফর্ম পূরণ করেছে ১২ লাখ ৩৪ হাজার ৯৩৯ জন।

সুতরাং কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে নিবন্ধন করেছে কিন্তু এইচএসসি পরীক্ষায় ফর্ম পূরণ করেনি তাদের সংখ্যা ৫ লাখ ২৫ হাজার ৮৫৪ জন। প্রাথমিকভাবে এসব শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। যা মোট শিক্ষার্থীর ৩০ শতাংশেরও বেশি। গত কয়েক বছর এই হার ১৮ থেকে ২২ শতাংশ থাকলেও চলতি বছর তা ৩০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। এরা হয়তো সকলে ঝরে পড়বে না। অনেকেই লেখাপড়ায় ফিরবে। আবার কেউ কেউ হারিয়ে যাবে। এটাই ঝরেপড়া। শিক্ষায় বাধা হিসেবে কাজ করছে ঝরেপড়া। ঝরে পড়ার কারণ হিসেবে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। এগুলো হলো- পরিবারের অন্যত্র চলে যাওয়া, বইখাতাসহ লেখাপড়ার উপকরণ নষ্ট হয়ে যাওয়া, তাৎক্ষণিকভাবে স্কুলের ব্যয় বহনে অক্ষমতা, বাবা-মাকে ঘরের কাজে সহায়তা করা, উপার্জনে বা ভাগ্যান্বেষণে নেমে পড়া, লেখাপড়ায় আগ্রহ না পাওয়া, স্কুলে যেতে নিরাপদ বোধ না করা, যাতায়াতে যানবাহন সংকট সমস্যা ইত্যাদি। এসব বিষয় বিশ্লেষণ করলে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, পড়ালেখার প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করে এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এদের কেউ কেউ শিক্ষা জীবনে প্রবেশ করলেও বস্তুত বড় অংশই চলে যাবে কর্মজীবনে। কারণ তাদের বয়সটা এরকমই। এসব শিক্ষার্থী কিন্তু অনেক হাসিমুখে একদিন এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল আনতে গিয়েছিল, ভালো ফল করায় গর্বে বুকটা ফুলে উঠেছিল। সেই তারা এখন তার বন্ধুদের পড়তে দেখবে এবং নিজেরা সমাজে শ্রমের স্রোতধারায় চলে যাবে। অথচ উচ্চ শিক্ষার স্বপ্ন তারাও দেখেছিল। কেন তারা লেখাপড়ায় ফিরল না সেই কারণগুলো খুঁজে বের করা জরুরি। অনেক পরিবারই তাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া থেকে দূরে সরিয়ে রাখছে এবং এক্ষেত্রে তাদের সদিচ্ছারও যথেষ্ট অভাব রয়েছে।

শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষার্থী ধরে রাখার জন্য সরকার যেসব প্রচেষ্টা করেছে তার মধ্যে অন্যতম হলো বিনামূল্যে বই বিতরণ। বছরের শুরুতেই নতুন বই লাইব্রেরি থেকে কিনতে হচ্ছে না। যা অভিভাবকের মধ্যে একসময় মানসিক চাপ হিসেবে বিরাজ করত। যেহেতু বছরের শুরুতেই বিনামূল্যে নতুন বই নিয়ে সন্তান বাড়ি ফিরছে। ফলে সেই মানসিক চাপটা এখন আর নেই। তবে সন্তানকে বিদ্যালয়ে পাঠাতে কোনো একক বিষয় প্রভাব বিস্তার করার চেয়ে বহু উদ্যোগ ভালো কাজে দেয়। বিনামূল্যে বইয়ের সঙ্গে শিক্ষার্থীর উপবৃত্তির কথা বলা যায়। প্রাথমিকের প্রতিটি ছাত্রছাত্রী প্রতি মাসে এই উপবৃত্তি পাচ্ছে যা তার লেখাপড়াকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করছে। এটা শিক্ষার্থীর এবং তার অভিভাবকের বিদ্যালয়ের প্রতি আগ্রহও বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। তবুও ঝরে পড়ার হার হ্রাসে অগ্রগতি গত পাঁচ বছরে সামান্যই।

বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০১৯ সালে প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ছিল ১৭ দশকি ৯ শতাংশ, ২০১৮ সালে ১৮ দশমিক ৬ শতাংশ, ২০১৭ সালে ১৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ, ২০১৬ সালে ১৯ দশমিক ২ শতাংশ, ২০১৫ সালে ২০ দশমিক ৪ শতাংশ এবং ২০১৪ সালে ২০ দশমিক ৯ শতাংশ। এই পাঁচ বছরের হিসেবে ঝরে পড়ার হারে খুব বেশি পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় না। অথচ এই সময়ে শিক্ষায় বহু ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ফলে এই হার আরো কমা প্রয়োজন ছিল। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে এই হার কমাতেই হবে। মাধ্যমিকে ২০১৮ সালে ঝরে পড়ার হার ছিল ৩৭ দশমিক ৬২ শতাংশ, ২০১৭ সালে ৩৭ দশমিক ৮১ শতাংশ, ২০১৬ সালে ৩৮ দশমিক ৩০ শতাংশ, ২০১৫ সালে ৪০ দশমিক ৫৯ শতাংশ এবং ২০১৪ সালে ৪১ দশমিক ৫৯ শতাংশ। উচ্চমাধ্যমিকে ২০১৮ সালে ঝরে পড়ার হার ছিল ১৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ, ২০১৭ সালে ১৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ, ২০১৬ সালে ২০ দশমিক শূণ্য ৮ শতাংশ, ২০১৫ সালে ২০ দশমিক ৭ শতাংশ এবং ২০১৪ সালে ২১ দশমিক ৩৭ শতাংশ।

আমাদের লক্ষ্য এসডিজি অর্জন করা। আর এসডিজি অর্জনের জন্য মানসম্মত শিক্ষা অপরিহার্য। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত না করতে পারলে ঝরে পড়ার হারও কমিয়ে আনা সম্ভবপর হবে না। অন্যসব কারণের সঙ্গে আনন্দহীন শিক্ষা ব্যবস্থাও ঝরে পড়ার ক্ষেত্রে খানিকটা দায়ী। মেয়েদের ক্ষেত্রে প্রয়োজন আনন্দপূর্ণ পাঠদান।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদান আনন্দপূর্ণ করার নানা কৌশল প্রণীত হয়েছে। ঝরেপড়া রোধে শিক্ষার পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রাথমিকে ভর্তির হার প্রায় শতভাগে উন্নীত হয়েছে। এটি একটি বড় সাফল্য। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে জেন্ডার সমতাও নিশ্চিত হয়েছে। কিন্তু এদের ধরে রাখতে হবে এবং উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। এই শিক্ষা হবে মানসম্মত শিক্ষা। মানসম্মত শিক্ষাই পারে টেকসই উন্নয়নের গতি বেগবান করতে। আমরা আশা করতে পারি মিড ডে মিল কার্যক্রম প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার আরোও অনেক কমিয়ে আনবে। সেইসঙ্গে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকেও ঝরেপড়া হ্রাস পাবে এবং সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত হবে। একটি স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে স্মার্ট শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।

লেখক প্রাবন্ধিক ও কলামিষ্ট