পানিতে ডুবে অকালমৃত্যু রোধে সচেতনতা

নাসরিন সুলতানা

প্রকাশ : ২৫ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

পানিতে ডুবে অকালমৃত্যু কারোই কাম্য নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, প্রতি বছর ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৪০০ জন ব্যক্তি পানিতে ডুবে মারা যায়। যাদের ২০ শতাংশের বয়স ৫ বছরের কম। এজন্যই বিশ্বজুড়ে পানিতে ডুবে মৃত্যুকে ‘নীরব মহামারি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। বাংলাদেশে এক থেকে ৪ বছর বয়সি শিশুদের মোট মৃত্যুর ৬৭ শতাংশের জন্য দায়ী পানিতে ডুবে মারা যাওয়া। পানিতে ডুবে মৃত্যুর ১০ ভাগের একভাগ ঘটেছে নৌ-দুর্ঘটনায়। এছাড়া ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ১৭ হাজার শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। এ মৃত্যু সংখ্যা বিশ্বে সর্বোচ্চ।

বর্ষা এলেই এই দুর্ঘটনার হার যেন বেড়ে যায়। এর কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এই অঞ্চলে প্রলম্বিত বন্যা ও জলাবদ্ধতার কারণেই এত পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। আমাদের চারদিকে রয়েছে প্রচুর জলাশয়-পুকুর, নদী, খালবিল। গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, শহরের চেয়ে গ্রামে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার বেশি, অধিকাংশ শিশুই বাড়ি থেকে ২০ মিটার এবং কম বয়সিরা ১০ মিটার দূরত্বের কোনো পুকুর বা জলাশয়ের মধ্যে পড়ে মারা যায়। পরিবারের ক্ষুদে সদস্যের ওপর সঠিক নজরদারির অভাবে এমন করুণ পরিণতি দেখা যায়। সংখ্যায় বলতে গেলে, পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর ঘটনার ৬০ শতাংশ ঘটনা সকাল ৯টা থেকে বেলা ১টার মধ্যে হয়ে থাকে। কারণ এ সময় মায়েরা ব্যস্ত থাকেন গৃহস্থালি কাজে, বাবারা কাজের তাগিদে বাইরে থাকেন এবং ভাইবোন থাকলে তারা হয়তো স্কুলে বা অন্য কাজে থাকেন।

এ সমস্যা রোধে ইউনিসেফ ও কয়েকটি সংস্থার যৌথ উদ্যোগে ‘সুইমসেফ’ নামে শিশুদের সাঁতার শেখানো একটা প্রকল্প চলছে। এছাড়া এখন পর্যন্ত সারা দেশে ১০ উপজেলায় ৩ হাজার ২০০টি কেন্দ্রে প্রায় ৮০ হাজার শিশুকে দিবাযত্ন কেন্দ্রে রাখা হয়। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন নারী শিশুদের দেখভাল করেন। এছাড়াও সরকার সম্প্রতি পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু রোধে নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে- সমাজভিত্তিক সমন্বিত শিশুযত্ন কেন্দ্রের মাধ্যমে শিশুদের প্রারম্ভিক বিকাশ ও সুরক্ষা এবং শিশুর সাঁতার সুবিধা প্রদান প্রকল্প। বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ী, এ বছরের ২৫ জুলাই পালন করা হয় ‘পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ’ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক দিবস। বাংলাদেশ সরকারও পালন করে থাকে দিবসটি।

বৈশ্বিকভাবে এসডিজির অন্তর্ভুক্ত করা হলেও পানিতে ডুবে মৃত্যুর হার আশানুরূপ হারে কমছে না। অসুস্থতাজনিত কারণে শিশুমৃত্যুর হার কমানো গেলেও সার্বিকভাবে শিশুমৃত্যুর উচ্চহার রয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, পানিতে ডুবে মৃত্যুর ৪৭ শতাংশ তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। অথচ এসব মৃত্যু রোধে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়ানোর জন্য কিছু প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা দরকার।

যেমন : পুকুরপাড়ে বেড়া দেওয়া, শিশুদের জন্য দিবাযত্ন কেন্দ্রের পর্যবেক্ষণে রাখা, সাঁতার শেখানো, পানি থেকে উদ্ধারের পরপরই শিশুদের স্বাভাবিক করতে সাহায্য করা। বাংলাদেশ সরকারের তত্ত্বাবধানে ৪৯৩টি উপজেলার প্রতিটিতে শিশুদের জন্য দিবাযত্ন কেন্দ্র চালু করা প্রয়োজন। এর পাশাপাশি শিশুদের সাঁতার শেখার গুরুত্বের ওপর স্কুলের শিক্ষকরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। শিশুদের পাঠ্যপুস্তকেও ‘সাঁতার শেখার গুরুত্ব’ বিষয়ে অধ্যায় সংযুক্ত করা যেতে পারে। এছাড়া পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু রোধে পারিবারিক পর্যায়ে সচেতনতা তৈরি ও জাতীয়ভাবে কর্মসূচি গ্রহণ করার ওপর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো গুরুত্বারোপ করেছে।

মনে রাখতে হবে, বর্তমান সরকার পানিতে ডুবে মৃত্যুরোধে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে ঠিকই, তবে শুধু সরকারি উদ্যোগে পানিতে ডুবে মৃত্যুরোধ সম্ভব নয়; তাছাড়া পারিবারিক, সামাজিক ও ব্যক্তিপর্যায়ে সচেতনতা ছাড়াও ব্যক্তিপর্যায়ে সচেতনতাহীন হলে এ মৃত্যু রোধ করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে সবাই মিলে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে, যাতে শিশুরা নিরাপদে বেড়ে উঠতে পারে। আমরা যেন দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলতে পারি- ‘আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ’।

লেখক : শিক্ষার্থী

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়