বৃদ্ধ বয়সে অসহায়ত্ব

রাষ্ট্রীয়ভাবে ভরণ-পোষণ সময়ের দাবি

প্রকাশ : ২৫ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

কন্যাসন্তানের পিতামাতা খানিকটা অনিশ্চয়তা নিয়েই জীবনযাপন করেন। বাবা-মায়ের কামনা থাকে বৃদ্ধ বয়সে তারা যেন তাদের মৌলিক চাহিদাগুলো সন্তানের মাধ্যমে পূরণ করতে পারেন। আর এজন্য প্রয়োজন কর্মক্ষম সন্তান। এই সন্তানটি ছেলে হলে কোনো কোনো পিতামাতা স্বস্তি বোধ করেন। কেন না, ছেলেসন্তানকে লালন পালন করে শিক্ষাদীক্ষা দিয়ে বড় করলে সে পরবর্তী সময়ে জীবনে সংসারের হাল ধরবে। পিতামাতা বৃদ্ধ বয়সটি আরাম আয়েসের মধ্যে কাটিয়ে দেবেন। কন্যাসন্তানকে বিয়ে দেয়ার পর সে স্বামীর সংসারে চলে যায়। সেখানে তার আয়-রুজির সুযোগ থাকলেও সেই আয়ের একটা অংশ তার পিতামাতা সাধারণত দাবি করেন না।

কন্যা তার স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখে থাকলেই পিতামাতার আনন্দ। অথচ ছেলেসন্তানের প্রতি পিতামাতার দাবি অনেক বেশি। দাম্পত্য জীবনের শুরুতেই অনেকে ছেলেসন্তান কামনা করে। আবার অনেকে মনে করেন ছেলেমেয়ে সমান। সন্তান তো সন্তানই। ছেলে হলেই যে পিতামাতার ভরণ-পোষণ দেবে, সেই ধারণা কখনো কখনো ভুল প্রমাণিত হচ্ছে। তার প্রমাণ আবার মিলেছে লালমনিরহাট জেলার আদিতমারীতে। ছেলে জমি লিখে নিয়ে মা তছিরনকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার পর একটি পোর্টালে ওই মায়ের দুদর্শাময় জীবন কাহিনি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ভাগ্য ভালো যে, ওই প্রতিবেদনটি লালমনিরহাট জেলা প্রশাসকের নজরে আসে। তিনি আদিতমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে বিষয়টি সুরাহা করার উদ্যোগ নেন। হতভাগ্য বৃদ্ধা তছিরন আদিতমারী উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের উত্তর গোবদা গ্রামের মৃত আনছার আলীর স্ত্রী। অভিযুক্ত আনোয়ার হোসেন তারই নাড়িছেঁড়া ধন একমাত্র ছেলে। অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে মাত্র ৬ মাস বয়সি মেয়ে আনিছা ও ৩ বছর বয়সি ছেলে আনোয়ার হোসেনকে বড় করেন।

১০ মাস আগে ছেলে আনোয়ার হোসেন চাষাবাদের ২৮ শতাংশ জমি মায়ের কাছ থেকে দলিল করে নেন। এরপর মায়ের ওপর অত্যাচার বাড়িয়ে দেন। খোঁজখবর নেওয়া বন্ধ করে দেন। উল্টো বিগত দিনে চিকিৎসা বাবদ মায়ের জন্য খরচ হওয়া ২০ হাজার টাকা দাবি করেন। দরিদ্র বৃদ্ধা তছিরন সেই টাকা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় ৪ মাস আগে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেন ছেলে আনোয়ার ও ছেলের বউ আম্বিয়া। নিরুপায় হয়ে একমাত্র মেয়ে আনিছা বেগমের বাড়িতে যান বৃদ্ধা তছিরন। সেই থেকে মেয়ে জামাই তার দেখভাল করছেন। বৃদ্ধা মাকে স্থান দেওয়ায় বোনের ওপর ক্ষিপ্ত হন, ভাই আনোয়ার ও তার স্ত্রী। এ ঘটনায় তছিরন ভরণ-পোষণ ও তার জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে ছেলে, ছেলের বউ এবং দুই নাতির নামে আদিতমারী থানায় লিখিত অভিযোগ করেন। এ অভিযোগ নিয়ে ওই পোর্টালে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনটি জেলা প্রশাসকের নজরে আসার পর জেলা প্রশাসকের নির্দেশে ওই বৃদ্ধার কাছে যান আদিতমারী ইউএনও। বৃদ্ধার সঙ্গে কথা বলে মা-ছেলের মধ্যে সমঝোতা করে দেন তিনি। মায়ের ভরণ পোষণের জন্য প্রতি মাসে নগদ টাকা ও ধান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন বৃদ্ধার ছেলে আনোয়ার হোসেন।

বৃদ্ধার কথা মতো তাকে মেয়ের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করা হয়। কথা হচ্ছে, আজ যদি জেলা প্রশাসক বিষয়টি নজর না দিতেন, তাহলে হয়তে ওই বৃদ্ধার বাকি জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠত। আসাতের সমাজে এমন অনেক পিতামাতা রয়েছেন, তার নিজের সন্তানের মাধ্যমে নির্যাতিত ও নিগৃহীত হয়ে পথে পথে ঘুরছেন। আবার অনেকে সন্তানের মানসম্মানের দিকে তাকিয়ে ‘বুকে পাথর’ বেঁধে জীবনযাপন করছেন। কিন্তু এভাবে আর কত দিন। মানুষ তার কর্মজীবনে সংসারের পাশাপাশি রাষ্ট্রের জন্যও অনেক ত্যাগ স্বীকার করেন। তার মেধা ও শ্রম দেন। তাই রাষ্ট্রেরও হয়তো একটা দায়িত্ব রয়েছে বৃদ্ধ বয়সে তাদের পাশে দাঁড়ানোর। যেসব সন্তান তার পিতামাতার দায়িত্ব নিতে অপারগতা প্রকাশ করে, সেই সব পিতামাতার দায়িত্ব রাষ্ট্রীয়ভাবে গ্রহণ করা হলে মানুষ অন্তত একটু স্বস্তি নিয়ে জীবনযাপন করতে পারত। কেননা, বৃদ্ধ বয়সে কি হবে, সেই চিন্তা যদি যৌবনে করতে হয়, তাহলে মানুষের কর্মসক্ষমতা অনেক কমে যাবে। তাই রাষ্ট্রীয়ভাবে ভরণ-পোষণের দায়িত্ব সরকারের নেয়ার বিষয়টি এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।