নদী দূষণ : কারণ, প্রভাব ও প্রতিকার

মো. মিজানুর রহমান

প্রকাশ : ২৬ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

কোনো উচ্চভূমি থেকে উৎপত্তি হয়ে ছোট ছোট স্রোতধারার মিলিত প্রবাহ নির্দিষ্ট প্রাকৃতিক খাত দিয়ে প্রবাহিত হয়ে অপর কোনো জলাশয়, হ্রদ বা সাগরে মিলিত হলে বা কোনো নদী থেকে শাখা বের হয়ে প্রবাহিত স্রোতধারা কোনো জলাশয়, হ্রদ, আবার কোনো নদীতে বা সাগরে মিলিত হলে তাকে নদী বলে। বাংলাদেশে ৫৭টি আন্তর্জাতিক নদী আছে। কোনো কোনো পরিসংখ্যানে শাখা-প্রশাখাসহ বাংলাদেশে নদ-নদীর সংখ্যা প্রায় ৮০০টি। সরকারি সংস্থাগুলো বলছে ২৩০টি নদী আছে। উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, দেশে ৪০৫টি নদী আছে। আবার শিশু একাডেমির শিশু বিশ্বকোষে বলা হয়েছে ৭০০টি নদী আছে। নদীকে কেন্দ্র করেই সভ্যতা ও সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। ভৌগোলিক গঠন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, ভাষা-সংস্কৃতি, ভূতত্ত্ব-নৃতত্ত্ব, সাহিত্য, পৌরাণিক উপাখ্যান, তীর্থস্থান, কাহিনী, কবিতা, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সমাজ ব্যবস্থা, শিল্প, কৃষি, মৎস্য পালন, ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ-যাতায়াত, জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ ও জীবন-জীবিকার অনুসঙ্গ গড়ে উঠেছে নদীকে কেন্দ্র করেই। ‘বাংলাদেশ নদী বাঁচাও আন্দোলন’ এক প্রতিবেদনে বলছে, পৃথিবীর শীর্ষ দূষিত নদীগুলোর অবস্থান এখন নদীমার্তৃক বাংলাদেশে। তাই নদী দূষণের কারণ, প্রভাব এবং প্রতিকারসমূহ কি কি তা তুলে ধরার প্রায়াস।

অতিমাত্রায় নগরায়ন নদী দূষণে ভূমিকা রাখছে। চিকিৎসাবিহীন শহুরে বা শিল্প জল নদী দূষণের অন্যতম কারণ। জৈব পদার্থ বা মল পদার্থ নদীকে দূষিত করে। এছাড়াও শহর বা নগরগুলোতে উৎপন্ন কঠিন বর্জ্য (যেমস-প্লাস্টিক) নদীতে ফেলা বা ধুয়ে নেওয়াও নদী দূষণের কারণ।

কৃষিতে ব্যবহার্য প্রচুর পরিমাণ রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে সেগুলো থেকে প্রবাহিত জল নদীকে দূষণ করে। হাঁস-মুরগির খামার থেকে চিকিৎসাবিহীন- যা মল বহন করে তা থেকে নদী দূষিত হয়। বিভিন্ন খনি থেকে নিষ্কাশন সেøজ বা বর্জ্য হতে নদী দূষিত হয়। শিল্প-কলকারখানা থেকে নির্গত নাইট্রাস অক্সাইড, নাইট্্েরাজেন ডাইঅক্সাইড, সালফার অক্সাইড, সালফার ডাইঅক্সাইড, কার্বন ডাইঅক্সাইড ইত্যাদি গ্যাসগুলোর মাধ্যমে এসিড বৃষ্টি হয় যা নদীতে অ্যাসিডিফাই করে, ফলে নদী দূষিত হয়। এছাড়াও শিল্প-কলকারখানা থেকে নির্গত বিভিন্ন ভারী ধাতু যেমন- পারদ, সিসা, নিকেল, ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম, আর্সেনিক বিভিন্নভাবে নদীকে দূষিত করে।

শিল্প-কলকারখানা থেকে তরল বর্জ্য নদীতে পতিত করার মধ্য দিয়ে মারাত্মকভাবে নদীর পানি দূষিত করা হয়। গার্হস্থ্য ব্যবহার্য বিভিন্ন ডিটারজেন্ট, তেল ও চর্বি পদার্থ বিপদজনক দূষণকারী হওয়ায় পানিতে মিশে নদীতে প্রবাহিত হওয়ার ফলে নদী দূষিত হয়। ডায়িং কারখানাগুলোতে এক টন কাপড় উৎপাদন করতে নদীতে বর্জ্য যাচ্ছে ২০০ টন। ট্যানারি থেকে প্রতিদিন প্রায় ২১ হাজার কিউবিক মিটার বর্জ্য নদীতে যাচ্ছে। পরিবেশ বিভাগের এক গবেষণার দেখা যায় বুড়িগঙ্গার পানি দূষণের ৩৫ শতাংশ আসে ট্যানারি থেকে। ওয়াসার তথ্যানুযায়ী প্রতিদিন নদীতে সরাসরি বর্জ্য যাচ্ছে ১২ লাখ ৫০ হাজার ঘনমিটার। পরিবেশ দূষণ ও সুরক্ষাবিষয়ক জাতীয় তারুণ্য জরিপ ২০২২-এ ১৫-৩৫ বছরের প্রতি তরুণ গড়ে একটি প্লাস্টিক ব্যাগ তথা বছরে প্রায় ১৯ বিলিয়ন প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যাবহারের কথা জানিয়েছেন। পরিবেশ অধিদপ্তরের সমীক্ষায় উঠে এসেছে যে, প্রতিদিন রাজধানীর চারপাশের নদীগুলোতে প্রায় সাড়ে চার হাজার টন বর্জ্য ও ৫৭ লাখ গ্যালন দূষিত পানি নদীতে গিয়ে পড়ে। এসব কারণেই প্রতিনিয়তই নদী দূষিত হয় এবং আশপাশে নদীর দূষিত পানি ছড়িয়ে পড়ে। যা মানব জীবন ও পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ।

নদী দূষণের প্রভাব ভয়াবহ। নদী দূষণ জলবায়ু পরিবর্তনে সরাসরি ভূমিকা রাখছে এবং নতুন নতুন রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটায়। নদী দূষণের ফলে মানুষের চর্মরোগ, শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা, ক্যান্সার, ফুসফুস ড্যামেজসহ নানারকম রোগ হয়। দূষণ নদীর জীববৈচিত্র্যকে প্রভাবিত করে। যথাযথভাবে সঠিক পদক্ষেপের মাধ্যমে নদী দূষণ রোধ করে আমরা নদীর পানি ব্যবহার করতে পারি। উদাহরণস্বরপ বলা যায়, ১৮৫০ সালের দিকে লন্ডনের টেমস নদীর পানি দূষণের কারণে ব্যবহারের অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছিল। ফলে তখন মহামারি আকারে কলেরাও হয়েছিল। তারপর উদ্যোগ নিয়ে বহুমুখী কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে নদীটির পানি দূষণমুক্ত করে সংরক্ষণ করা হয়। সেই পানির গুণগত মান এতই ভালো যে, যে কোনো কাজে ব্যবহার করা যায়। নদীর পানির গুণগত মান নিশ্চিত করা গেলে নদীর তীরবর্তী বাস্তুসংস্থানের উন্নতি ঘটবে। নদী দূষণ রোধে উৎসমুখে বাঁধ দেওয়াসহ সর্তক থাকতে হবে। নদী দূষণ রোধে নদীর পানিতে ময়লা ফেলা বা নৌযান নির্গত বর্জ্য, তেল ফেলা নিষিদ্ধ করতে হবে। নৌযানে রূপান্তরিত গ্যাস ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে। শিল্প, কল-কারখানা ও গার্হস্থ্য ব্যবহার্য কঠিন বর্জ্য পদার্থ পানিতে মিশতে দেওয়ার পথ বন্ধ করতে হবে। সব শিল্প, কল-কারখানায় বর্জ্য পরিশোধন প্লান্ট সংযোজন ও যথাযথ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে। ‘ক্লিনার প্রোডাকশন’ পদ্ধতি চালু করতে হবে। বিষাক্ত কেমিক্যালগুলোকে নিরাপদ কেমিক্যাল দ্বারা প্রতিস্থাপিত করতে হবে। কঠিন বর্জ্য পরিবেশবান্ধব পুনঃব্যবহারের কাজে লাগাতে হবে। মানব বর্জ্য ব্যবহারের জন্য আলাদাভাবে ট্রিটমেন্ট প্লান করতে হবে। ট্যানারি থেকে নির্গত বর্জ্য নদীতে না ফেলে প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে ব্যবহার উপযোগী করতে হবে। হাসাপাতাল থেকে উৎস বর্জ্য নদীতে ফেলা নিষিদ্ধ করতে হবে। কৃষিকাজে রাসায়নিক ও কীটনাশক ব্যবহার হ্রাস করতে হবে এবং জৈব সার ও কীট নিয়ন্ত্রণ কৌশল চালু করতে হবে- এতে নদী দূষণ রোধ হবে। নতুন শিল্প, কল-কারখানা স্থাপনের ক্ষেত্রে পরিবেশগত ছাড়পত্র ও তরল বর্জ্য শোধানাগার বা ইটিটি প্লান্ট অবশ্যই অপরিহার্য। জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, সেচ, বাঁধ, ব্যারেজ, খাল প্রভৃতি নির্মাণ যত্রতত্র হতে পারে না। দেশের সব নদীর সীমানা নির্ধারণ করতে হবে। নদীর উপর কাঁচা বা পাকা বসতি, টয়লেট নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। নদীকে সম্পূর্ণ দখলমুক্ত রাখতে হবে। মৃত ও ভরাটকৃত নদী ড্রেজিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। ভূমি মন্ত্রণালয় কর্তৃক নদীর পাড় ইজারা দেয়া বন্ধ করতে হবে। নদী রক্ষার আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে হবে। প্রয়োজনে আইন সংশোধন করে কমিশনকে শক্তিশালী ও আইন আদালত গঠন করা যায়। এছাড়াও পানি উন্নয়ন বোর্ড, সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভাসমূহ, নগর উন্নয়ন সংস্থাসমূহ, ওয়াসা, বিআইডব্লিউটিএ, নদী সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সমূহ, প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তাব্যক্তি, জনপ্রতিনিধিদেরও নদীবান্ধব নীতি অনুসরণে ভূমিকা রাখতে হবে। পরিবেশ ও মৎস্য অধিদপ্তরের যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে। নদী দূষণ রোধে ‘নদী দূষণ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা’ স্থাপন করতে হবে। বাংলাদেশের উচ্চ আদালত ২০১৯ সালে দেশের সব নদীকে ‘লিভিং এনটিটি বা জীবন্ত সত্তা’ হিসেবে ঘোষণা করেন। এর ফলে দেশের নদীগুলো মানুষ বা অন্যান্য প্রাণীর মতোই আইনি অধিকার পাবে। আদালতের রায় অনুযায়ী নদীগুলো ‘জুরিসটিক পারসন বা লিগ্যাল পারসন’। তাই, নদী দূষণে দোষীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। নদী দূষণকারীদের সব ধরণের সরকারী সুবিধা প্রাপ্তির অযোগ্য বলে ঘোষণা করতে হবে। পরিবেশ সুরক্ষা আইন এবং জলাধার সুরক্ষা আইনে কিছু নির্দেশনা ও শাস্তির কথা উল্লেখ রয়েছে। যেমন- প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইনে বলা হয়েছে, নদীসহ যে কোনো প্রাকৃতিক জলাধার দখল বা অবৈধ ব্যবহার করা হলে দায়ী ব্যক্তি অনধিক ৫ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এই আইনে আরো বলা হয়েছে, কোনো জলাধারের জায়গায় অননুমোদিত নির্মাণকার্য হলে সেটি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ভেঙে ফেলার নির্দেশ দিতে পারবে বা অন্য কোনো আইনে যা ই থাকুক না কেন, এই ভেঙ্গে ফেলার জন্য কোনো ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না। নদী দূষণ রোধে রাজনৈতিক সদিচ্ছাও থাকতে হবে। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নদী দূষণ রোধ করা সম্ভব। কোনো শহর বা নগরের ভেতর বা পাশ দিয়ে প্রবাহিত নদী শহর বা নগরের সৌন্দর্য ও গুণগত মান বাড়িয়ে দেয়। শহর বা নগরে আভিজাত্য এনে দেয়। আবহমানকাল ধরেই এ উপমহাদেশের নদীর সঙ্গে জীবন জড়িত। তাই জীবন বাঁচাতে নদী দূষণ যে কোনো মূল্যে অবশ্যই রোধ করতে হবে। নদীর পানির সংযত, সমন্বিত, সুপরিকল্পিত ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। নদীর প্রতি প্রাকৃতিক দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ এবং সে অনুযায়ী কার্যক্রম করতে হবে।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট।