স্বায়ত্তশাসন ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের মর্যাদা

ড. সৈয়দ নাজমুল হুদাং

প্রকাশ : ২৬ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বর্তমান সময়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় কিংবা চাকরির ক্ষেত্রে বিসিএসকে হাইলাইটস করা হচ্ছে। প্রত্যেক পেশারই রয়েছে মর্যাদা ও গুরুত্ব। আমরা যদি শুধু একটি পেশাকেই বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করি তাহলে অন্য পেশাগুলোকে খাটো করে দেখা হয়। একজন শিক্ষক তিনি নির্দিষ্ট পেশায় থাকলেও তার ছাত্রছাত্রীরা যে পেশায় নিজেকে অধিষ্ঠিত করেন বাবা-মার পরে শিক্ষক সেটাতে গর্ববোধ করেন। অথচ বর্তমান সময়ে দেখা যায় নিজে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে শিক্ষক সম্পর্কে নানাবিধ কথা বলা হয়। কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের যোগ্য ও দিকনির্দেশনার ক্ষেত্রে শিক্ষকরাই ভূমিকা রেখে থাকেন। স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা টিউশনি করে থাকেন বেতনের বাইরে অতিরিক্ত কিছু পারিশ্রমিক পান। অথচ একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শুধু মর্যাদা, সম্মান ও গবেষণার জন্য তিনি কখনোই এ কাজে যুক্ত হন না। মর্যাদা ও সম্মান শব্দটি আপেক্ষিক কিন্তু পারিশ্রমিক সবার জন্য যথাপোযুক্ত হতে হবে। আমাদের দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষকরা যে পরিমাণ সুযোগ-সুবিধা বা পারিশ্রমিক পেয়ে থাকেন তা খুবই অপ্রতুল।

ভারত ভাগের একদম শুরুর দিকে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১৩ ডিসেম্বর দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকায় ‘দৌলতপুর কলেজে ছাত্রসভা’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায় ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১ ডিসেম্বর অধ্যক্ষের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই ছাত্রসভায় শিক্ষা সম্বন্ধে তরুণ মুজিব বলেছিলেন ‘শিক্ষা দীক্ষাই হলো মানব সভ্যতার মাপকাঠি, অথচ আমাদের দেশের অগণিত জনসাধারণকে অশিক্ষার অন্ধকারে ডুবিয়ে রেখে কোন মুখে আমরা বিশ্ব দরবারে নিজদিগকে সভ্য জাতি বলিয়া গৌরব করিব?’ আজ দেখতে পাচ্ছেন আমাদের সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই ধ্বংস হতে বসেছে। শিক্ষকদের বেতন না বাড়লে শিক্ষা সমস্যার সমাধান অসম্ভব। শিক্ষা পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন করা দরকার।

পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশি শিক্ষকরা তুলনামূলক কম সুযোগ-সুবিধা ও সম্মান পেয়ে থাকেন। (তবে ক্ষেত্র বিশেষে ভিন্ন)। দক্ষিণ এশীয় বিবেচনা করলে আমাদের দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের শিক্ষকদের মর্যাদা, সম্মান ও সুযোগ-সুবিধা অপ্রতুল। একজন শিক্ষক কক্ষের বাইরেও পরিশ্রম করে থাকেন। শিক্ষার্থীদের পাঠদান, পরীক্ষা, পরীক্ষাসংশ্লিষ্ট বিষয়ক বিভিন্ন কাজ, প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন অতিরিক্ত দায়-দায়িত্ব এবং গবেষণার মতো সবচেয়ে বড় কাজটি করে থাকেন।

একজন শিক্ষক শুধু শ্রেণিকক্ষের শিক্ষকই নন, তিনি জাতির শিক্ষক ও দিকনির্দেশক হিসেবে কাজ করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় শিক্ষকদের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের চূড়ান্ত স্বাধীনতা পূর্বে পাকিস্তানি ঘাতকদের বুলেটের সামনে দেশের জন্য যারা বুক পেতে দিয়েছিলেন তাদের একটি বড় অংশ ছিল শিক্ষক। দেশের যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জনগণের সচেতনতা সৃষ্টি কিংবা নির্বাচনে সরাসরি ভূমিকা রাখেন শিক্ষকরা। বাংলাদেশ আজ উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছে। আধুনিক শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা, মাদ্রাসা শিক্ষা, নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষা, সব শিক্ষা গ্রহণে শিক্ষকের মূল্যায়ন বা মর্যাদা বৃদ্ধি পায়নি। শিক্ষকের সামাজিক নিরাপত্তা ও মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য কাজ করতে হবে। শিক্ষা ও শিক্ষক শব্দ দুটি এক ও অভিন্ন। অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহা তার বুকের রক্ত দিয়ে শিক্ষার্থীদের আগলে রেখেছিলেন।

শিক্ষকের নিরাপত্তা, মর্যাদা, সম্মানী কিংবা শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টি না করতে পারলে জাতির কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করা অসম্ভব।

জাতির পিতা বলেছিলেন ‘আমার সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই। শিক্ষকরা হলেন সোনার মানুষ গড়ার কারিগর। শিক্ষকদের পেটে ক্ষুধা রেখে মানুষ তৈরি করা সম্ভব নয়। যেখান থেকে পারো, টাকার ব্যবস্থা করো। শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ করতে হবে। মানুষ যখন অশিক্ষিত হয়ে থাকে, তখন সে জাতির জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। আর মানুষ যখন শিক্ষা ও দক্ষতা অর্জন করে তখন সে মানবসম্পদে পরিণত হয়।’ ইদানীং শোনা যায় দলীয় বিবেচনায় অধিকাংশ শিক্ষক নাকি নিয়োগ হয়ে থাকে। কথাটির সঙ্গে আমি পুরোপুরি দ্বিমত পোষণ করছি। তবে এরূপ যদি হয়েও থাকে সেক্ষেত্রে দলীয় বিবেচনায় না রেখে একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবন, রেজাল্ট, সমাজ ও দেশের প্রতি দায়িত্ব কর্তব্য কিংবা জাতিকে গবেষণার মাধ্যমে কি দিতে চাই সে বিষয়ে একটি কমিটমেন্ট থাকতে হবে। তাহলেই প্রকৃত শিক্ষক পাওয়া সম্ভব হবে।

সেই জাতি তত বেশি কর্মঠ ও পরিশ্রমই হয় যার শিক্ষক ও শিক্ষাব্যবস্থার শিক্ষার্থীর মনে প্রভাব ফেলতে পারে। শিক্ষা, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নিবিড় সম্পর্ক অনুধাবন করেছিলেন জাতির পিতা।

বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচায় শিক্ষকদের প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও চিন্তার কথা বহিঃপ্রকাশ করেছেন অসংখ্যবার।

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষা মন্ত্রী ও শিক্ষা সচিব বানিয়ে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শিক্ষকদের মধ্য থেকেই। দেশের বরণ্য শিক্ষকদের রেজাল্ট, অতীত অভিজ্ঞতা ও বিভিন্ন যোগ্যতা বিচার-বিশ্লেষণ করে একজন উপাচার্য নিয়োগ প্রদান করা হয়। মাননীয় উপাচার্য মহোদয় মহামান্য রাষ্ট্রপতির নিয়োগপ্রাপ্ত এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহী হিসেবে কাজ করেন। তিনি যদি তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পালন করেন তাহলে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। উপাচার্য মহোদয়গণ দেশ ও রাষ্ট্রের কাছে অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি। বিভিন্ন সময় তাদের নিয়ে যে সমস্ত লেখালেখি হয় সেটা অনেক সময় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হিসেবে আমরা ব্যথিত হই। স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা, জবাবদিহিতা সর্বোপরি বিবেকের দ্বারা পরিচালিত হয়ে উপাচার্য মহোদয়গণ কাজ করেন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায় শিক্ষকদের মর্যাদা বৃদ্ধিতে, প্রশ্নবিদ্ধ ইস্যুগুলোতে আমি মনে করি মাননীয় উপাচার্য মহোদয়গণ যত্নশীল হলে সব বিতর্কের অবসান ঘটানো সম্ভব।

বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ‘ছাত্র সমাজের লেখাপড়া করতে হবে। লেখাপড়া করে মানুষ হতে হবে। জনগণ টাকা দেয় ছাত্রগণকে মানুষ হবার জন্য। মানুষ হতে হবে। আমরা যেন পশু না হই। লেখাপড়া শিখে আমরা যেন মানুষ হই।’

১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়নের পূর্বে শাসনতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কিত এক আলোচনায় বঙ্গবন্ধু সুস্পষ্টভাবে বলেন ‘আমাদের দেশের শিক্ষিত সমাজের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিরা জাতির শিক্ষকতা পেশার প্রতি আকৃষ্ট হন সেই পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সবরকম চেষ্টা করতে হবে। এজন্য কেবল তাদের বেতন স্কেল ও বৈষয়িক সুযোগ-সুবিধা দিলেই চলবে না, সঙ্গে সঙ্গে কাজ করার উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি এবং শিক্ষকদের ন্যায্য মর্যাদা ও সম্মান দিতে হবে।’

বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করেছিলেন এবং গঠন করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন যা উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বাস্তবায়নে মাইলফলক হয়ে আছে।

১৯৭৫-পরবর্তী কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্তশাসন পরিপূর্ণভাবে দেওয়া হয়নি। শিক্ষক কিংবা দেশবরেণ্য শিক্ষকদের পরিবর্তে অনেক ক্ষেত্রেই আমলানির্ভর সিন্ডিকেট গঠন করা হয়েছে।

অনেক সময় দেখা যায় বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় শিক্ষক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করতে মেধাবিদের উপেক্ষা করা হয়। যোগদান পরবর্তী প্রমোশন কিংবা আপগ্রেডেশনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অনেক ক্ষেত্রে যোগ্যদের উপেক্ষা কিংবা নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেন না এটা নিয়মিত শোনা যায়। এতেকরে শিক্ষার পরিবেশ যেমন বিনষ্ট হয় তেমনি শিক্ষক সামাজিক এবং মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। শিক্ষক হন মর্যাদাহীন। সঠিক সময়ে যথা উপযুক্ত ব্যক্তিকে তার প্রাপ্যতা দিয়ে দলমত নির্বিশেষে শিক্ষক হিসেবে বিবেচনা করে নিজ কর্মস্থলে কাজ করার করার সুযোগ ও যথাপযুক্ত গবেষণার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা এবং আর্থিক বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনা করতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে প্রতীক্ষিত শিক্ষকদের জন্য আলাদা পে-স্কেল বাস্তবায়ন করতে হবে।

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে যেমন সোনার শিক্ষক চাই। তেমনি শিক্ষিত জাতি গঠনে শিক্ষকদের অবমূল্যায়িত করে বঙ্গবন্ধুর সঠিক শিক্ষা দর্শন বাস্তবায়ন অসম্ভব।

ইতিহাসের চরম জঘন্যতম দিন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। ১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে শিক্ষার নামে চলতে থাকে ইতিহাস বিকৃতির মতো নির্লজ্জ মিথ্যাচার। ২১ বছর বাংলাদেশ অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত হয়ে গুমরে কাঁদতে থাকে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শুধু স্বাধীন বাংলাদেশের ভিত্তি রচনা করেননি। তিনি এ দেশের প্রতিটি নাগরিকের মর্যাদা ও সুখী সমৃদ্ধি বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছিলেন। অবশেষে তার যোগ্য উত্তরসূরী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে আজ সোনার বাংলাদেশ অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায়।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।