ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হলে বিশ্ব মানবতার জয় হবে

অলোক আচার্য
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হলে বিশ্ব মানবতার জয় হবে

পৃথিবী বাস্তুচ্যুত মানুষের কান্নায় ক্রমেই ভারি হচ্ছে। যে দেশে জন্মগ্রহণ করছে যুদ্ধ বা প্রাকৃতিক কারণে (বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যুদ্ধ এবং সংঘাতের কারণেই) তারা নিজ বাসভূম ছেড়ে আশ্রয় নিচ্ছে কোনো নিরাপদ আশ্রয়ে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে। দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে রোহিঙ্গারা এখানে থাকাতে বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। তা ছাড়া এ ধরনের একটি সমস্যা দীর্ঘদিন সমাধান না করে থাকা যায় না। ফলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, রোহিঙ্গারা কবে নিরাপদে নিজ দেশে ফিরতে পারবে? যদিও এই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর এই মুহূর্তে দেওয়া যায় না। কারণ বিষয়টি কোনো একক দেশের ওপর নির্ভর করছে না অথবা হঠাৎ করেই সম্ভব নয়। তবে তা দ্রুতগতিতে শুরু করা উচিত এবং রোহিঙ্গাদের নিজ দেশের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া মানবাধিকারের মধ্যেই পড়ে। প্রতিটি নাগরিকেরই তার দেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার অধিকার রয়েছে। রোহিঙ্গাদেরও রয়েছে। ফলে তাদের ফিরতে হবে এবং ফেরাতে হবে। দেখতে দেখতে মিয়ানমার থেকে প্রাণের ভয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও তাদের নিজ বাসভূমে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে টুকরো টুকরো কিছু অগ্রগতি হয়েছে। অর্থাৎ খণ্ড খণ্ড কিছু অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মধ্যে প্রায়ই গোলাগুলির ঘটনা ঘটছে। এতে সেখানকার পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। গণমাধ্যম সূত্রে প্রকাশিত তথ্যে, জেলা পুলিশ ও এপিবিএনের তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১০ জুলাই পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিভিন্ন সংঘর্ষ ও গোলাগুলিতে ৬০ জনের মৃত্যু হয়েছে। তারা দীর্ঘদিন ধরেই নানা ধরনের অপরাধমূলক কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ছে। এমনকি মাদক, অস্ত্র ইত্যাদি গুরুতর অপরাধেও জড়িয়ে যাচ্ছে অনেকে। সুতরাং এর লাগাম টেনে ধরতে হলে তাদের সম্মানের সঙ্গে এবং নিরাপদে ফেরত পাঠাতে হবে। গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, সরকার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য তিনটি ট্রানজিট ক্যাম্প স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তাদের ফেরানোর ব্যাপারে কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু তাদের নিয়ে সমস্যা বৃদ্ধির আগেই তাদের ফেরাতে হবে। আন্তর্জাতিক মহলের বিষয়টি নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা গেছে। মাঝখানে করোনা মহামারি এবং তার মধ্যেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ লাগায় ওইসব ইস্যুই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেয়। অথচ রোহিঙ্গাদের জন্য এখন স্থানীয়রাই বিপদে আছে। বিপদে আছে পুরো দেশ।

যত দিন গড়াবে তত তাদের জন্য বহুমুখী সমস্যা দেখা দিবে। স্থানীয় কৃষিজমি, বনভূমি ধ্বংস, শ্রমবাজারে রোহিঙ্গাদের কাজে লাগানোসহ নানাবিধ অপরাধ বৃদ্ধি পেয়েছে। মানবতার খাতিরে তাদের আশ্রয় দিলেও এখন তাদের ফিরতে হবে। রোহিঙ্গাদের একটি অংশ নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে, মাদকদ্রব্য, অন্তর্দ্বন্দ্ব ইত্যাদি লেগেই আছে। কয়েকবার প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও নানা কারণে এবং মিয়ানমারের টালবাহানায় তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। অথচ এখন তাদের ফিরে যাওয়ার দরকার। যখন প্রয়োজন হয়েছিল তখন আমরা তাদের আশ্রয় দিয়েছি। তার অর্থ এই নয় যে, তাদের আজীবন ধরে রাখতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা পৃথিবী নিজেই এক বিরাট সংকটপূর্ণ পরিস্থিতি ও মুহূর্ত পাড়ি দিচ্ছে। বছর বছর রোহিঙ্গা শিশু জন্ম নেওয়ায় বৃদ্ধি পাচ্ছে তাদের জনসংখ্যাও। ফলে যত বছর পার হবে তত রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। যা বাংলাদেশের ওপর চাপ তৈরি করবে। এ বিষয়টি আন্তর্জাতিক ফোরামে অনেকবার উঠছে। কিন্তু কার্যকর কোনো কিছু আসেনি। পৃথিবীর যে কয়েকটি দেশে যুদ্ধ-বিগ্রহের কারণে মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে অন্য কোনো দেশে আশ্রয় নিয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো মিায়ানমার থেকে আসা মানুষ যারা রোহিঙ্গা নামে এদেশে বসবাস করছে।

আশ্রয়হীন মানুষের বড় অংশই এখন বাংলাদেশে বসবাস করছে। মিয়ানমারের এই হত্যাজজ্ঞের সময় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশ প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু আশা ছিল যে, এই সৃষ্ট সমস্যাটির একটি কার্যকর সমস্যা আন্তর্জাতিক মহল করবে। এখনো কার্যত এই সমস্যার কোনো টেকসই সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে পারেনি আন্তর্জাতিক মহল। এই বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা ভবিষ্যতে কোথায় থাকবে, তাদের সন্তানদের ভাগ্যে কী ঘটবে এ বিষয়ে সিন্ধান্ত নেওয়ার মতো যথেষ্ট সময় পার হচ্ছে। মাঝে মধ্যে রোহিঙ্গা নিয়ে কিছু কথা শোনা গেলেও মূল সমাধান অর্থাৎ রোহিঙ্গাদের নিজ বাসভূমে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে তেমন কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায় না। এদিকে ক্রমেই এ দীর্ঘ বিষয়টি আর দীর্ঘতর হচ্ছে। আভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই সময়ের মধ্যে বিশে^ আরো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটছে। আশ্রয়হীন মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু এদের ভবিষ্যৎ কী হবে তার অস্থায়ী সিদ্ধান্ত হলেও স্থায়ী সমাধান হয়নি। বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ইস্যুটিও এরকমই একটি আপাত অমীমাংসিত ইস্যু। যেখানে রোহিঙ্গা ফেরত যাওয়ার কথা তাদের পক্ষ থেকে কোনো কার্যকর সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। রোহিঙ্গারা যেখানে আশ্রয় নিয়েছে সেই উখিয়া, টেকনাফ এবং ভাসানচর থেকেও পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। তারা কেউ কেউ সাগর পাড়ি দিয়ে অন্য দেশে যাওয়ারও চেষ্টা করছে। দেশের বিভিন্ন জেলায় তারা প্রবেশের চেষ্টা করছে। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার ঘটনাটি ছিল মানবিক দৃষ্টিভঙ্গীর প্রকাশ। এখন তাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে দেওয়া আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। সু চি সরকার এখন ক্ষমতায় নেই। এখন ক্ষমতায় রয়েছে সামরিক সরকার। গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় না থাকলেও জান্তা সরকারের সঙ্গেই ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে এবং কাজে লাগাতে হবে আঞ্চলিক যোগাযোগ। কারণ বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের মধ্যে রোহিঙ্গা নিয়ে যে ইস্যু তৈরি হয়েছে তা সমাধান করতে হলে এর বিকল্পও নেই। ২০১৭ মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর ভয়ংকর সহিংসতা শুরু করার পর থেকে রোহিঙ্গারা ধর্ষণ, নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগ থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। মানবতার দিক বিবেচনায় বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় দেয়।

সরকারি হিসাব অনুযায়ী ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি ক্যাম্পে আশ্রয় দেওয়া হয়। তারপর থেকেই এই বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশের আশ্রয়ে রয়েছে। রোহিঙ্গারা আশ্রয় নেওয়ায় প্রায় আট হাজার একরের বেশি বনভূমি ধ্বংস হয়েছে। যা আমাদের পরিবেশ এবং প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের ওপর প্রভাব ফেলছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে আমাদের কৃষিজমির ওপরও চাপ সৃষ্টি হতে পারে। মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত থাকলেও তা শুরু করা যাচ্ছে না। রোহিঙ্গা শিবিরে প্রতি বছর জন্মগ্রহণ করছে বহু শিশু। তাদের বড় হয়ে ওঠার জন্য একটি স্থায়ী পরিবেশ অর্থাৎ তাদের মাটির অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অন্তর্দ্বন্দ্ব ও সংঘাত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বছর যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বৃদ্ধি পাবে। তাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার অনিশ্চয়তা, কর্মসংস্থানের সংকটে নিজেদের মাদকসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে ফেলাসহ বিভিন্ন সমস্যা দীর্ঘতর হচ্ছে। এই অনিশ্চয়তার আশঙ্কা ক্রমেই দীর্ঘতর হচ্ছে। রোহিঙ্গা সংকট এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবিক সংকট। তবে এর সমাধানে শিগগির কিছু হচ্ছে বলে মনে হয় না। বরং সমস্যা দীর্ঘতর হচ্ছে। রোহিঙ্গারা পালানোর চেষ্টা করছে। তাদের যারা সাহায্য করছে তারা একশ্রেণির দালাল। তাদের সহায়তায় রোহিঙ্গারা ক্যাম্প থেকে পালিয়ে বিভিন্ন শ্রমমূলক কাজে যুক্ত হচ্ছে। এ সংখ্যা বাড়ছে। এসব রোহিঙ্গা কোথায়? কারণ ঝুঁকির বিষয় হলো এদের লোকালয়ে মিশে যাওয়ার মতো ঘটনা। এদের মধ্যে অনেকের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা উদ্বেগ তৈরি করছে। রোহিঙ্গাদের জন্য নিজ দেশে উপযুক্ত নিরাপদ পরিবেশ মিয়ানমার তৈরি না করতে পারলে এবং রোহিঙ্গাদের বিশ্বাস অর্জন করতে না পারলে তাদের ফেরানো কষ্টকর। কারণ অনিশ্চিত গন্তব্যে তারা যেমন যাবে না আবার তাদের সেখানে পাঠানোও যাবে না।

এ পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক মহলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বিশেষ করে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, চীনসহ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য বা বিশ্বের অন্যান্য দেশের। কারণ এই সমস্যাটি মানবিক বিপর্যয়ের একটি বড় উদাহরণ এবং বিশ্বের উচিত হবে তাদের নিজ বাসভূমে নিরাপদে পৌঁছে দেওয়ার পরিবেশ তৈরি করা। রোহিঙ্গা নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান সবসময়ই ইতিবাচক ছিল; এখনো আছে। মানবিক কারণেই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে। রোহিঙ্গাদের ওপর এই নৃশংসতাকে ‘গণহত্যা’ আখ্যা দিয়ে ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালত আইসিজেতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা করে গাম্বিয়া। এটি ছিল আইনিভাবে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে একটি বিশাল অর্জন। কিন্তু প্রত্যাবাসন যেন শুরু হয় হয় করেও শেষ পর্যন্ত শুরু হয়নি। রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরে যাওয়া নিশ্চিত করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়টি বারবারই ঝুলে থাকছে। রোহিঙ্গারা নিরাপদ পরিবেশ না পেলে ফিরে যেতে ইচ্ছুক না। এই নিরাপদ পরিবেশ কতদিনে মিয়ানমার তৈরি করতে পারবে তা আদৌ নিশ্চিত করে বলা যায় না। কারণ দেশটিতে এখন গণতান্ত্রিক পরিবেশই নেই। যখন সেই পরিবেশ ছিল তখনই কায়ক্রমে কোনো অগ্রগতি হয়নি। মিয়ানমারে নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা ও চলাফেরার স্বাধীনতা নিশ্চিত হলে তারা ফিরতে পারে। আমাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। অতএব রোহিঙ্গাদের যত দ্রুত সম্ভব তাদের নিজ দেশে ফিরতে হবে। তাহলে বিশ্বের একটি বড় অংশের শরণার্থী সমস্যারও সমাধান হবে। এটি বিশ্ব মানবতার বিজয়ও বটে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত