উন্নয়নশীল দেশের চ্যালেঞ্জ এবং একজন শেখ হাসিনা

রায়হান আহমেদ তপাদার

প্রকাশ : ২৮ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বেই আজকের ঘুরে দাঁড়ানো বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর মতো তার চরিত্রে মানুষের প্রতি বিশ্বাস-ভালোবাসা, সততা, দক্ষতা, ধৈর্য ও ক্ষমাশীলতার বিশেষ গুণ বিদ্যমান। দেশের বাইরেও প্রশংসিত হয়েছে তার সাহসিকতা ও মানবতার রাজনীতি। সংকটকালে দাঁড়িয়েও আরো সবুজ, আরো পরিচ্ছন্নতা এবং আরো নিরাপদ বিশ্বের স্বপ্ন দেখেন তিনি। শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্ব, যোগ্যতা, নিষ্ঠা, মেধা-মনন, দক্ষতা, সৃজনশীলতা, উদারমুক্ত গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ও দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে উন্নীত হয়েছে। অভাব, মন্দা ও দারিদ্র্যের করাল গ্রাস থেকে বেরিয়ে এসেছে বাংলাদেশ। চলতি বছরের ২২ থেকে ২৪ আগস্ট দক্ষিণ আফ্রিকার বৃহত্তম নগরী জোহানেসবার্গে ব্রিকসের ১৫তম শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। শীর্ষ সম্মেলন ছাড়াও ব্রিকস নেতাদের আউটরিচ এবং ব্রিকস ডায়ালগ অনুষ্ঠিত হবে। ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা, এ পাঁচ দেশের অর্থনৈতিক জোট ব্রিকসের শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিতে আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ পেয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগস্ট মাসে দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে অনুষ্ঠেয় ৫ দেশীয় এ জোটের সম্মেলনে পর্যবেক্ষক হিসেবে প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। বাংলাদেশসহ ৮ দেশকে সম্মেলনে যোগদানের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এর আগে গত জুন মাসে সুইজারল্যান্ডের রাজধানী জেনেভায় অনুষ্ঠিত আইএলও সম্মেলনে যোগদানকালে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসার সঙ্গে বৈঠক হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। ওই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীকে ব্রিকসের সম্মেলনে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়।

২০০৯ সালে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীন ব্রিক নামে একটি রাষ্ট্রীয় জোট গঠন করে।

মূলত : ব্রিক ধারণাটির প্রবর্তক ছিলেন বিনিয়োগ ব্যাংক দ্য গোল্ডম্যান সাচের অর্থনীতিবিদ জিম ও নেইল। ২০০১ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে তিনি বলেছিলেন, ২০৫০ সাল নাগাদ এ চারটি দেশই অর্থনীতিতে প্রাধান্য দেখাবে। কারণ, এ চার দেশের অর্থনীতি দ্রুত বর্ধনশীল। তাদের শ্রম সস্তা, জনমিতি অনুকূলে এবং ব্যবহার করার মতো প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে। ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা এ জোটে যোগ দিলে এর নতুন নাম হয় ব্রিকস। ২০০৬ সালে নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন চলাকালে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন প্রথম জোট গড়ার আগ্রহ জানান। ওই বছরের ২০ সেপ্টেম্বর পাঁচ দেশের মন্ত্রীরা এ নিয়ে প্রথম বৈঠকে বসেন। ২০০৮ সালে রাশিয়ায় প্রথম মন্ত্রিপর্যায়ের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৪ সালে ব্রিকস দেশগুলো বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বিকল্প হিসেবে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক চালু করে এবং নতুন সদস্যদের জন্য তাদের দুয়ার খুলে দেয়। ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠিত হয় ৫০ বিলিয়ন ডলারের মূলধন নিয়ে, যার ২০ শতাংশ দিয়েছিল ব্রিকস জোটের দেশগুলো, যা ১০ বিলিয়ন ডলারের সমমূল্যের। ২০২১ সালে মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, উরুগুয়ে ও বাংলাদেশ নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের শেয়ার গ্রহণ করে। তবে এ শেয়ারের মূল্য ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের বিনিয়োগকৃত ১০ বিলিয়ন ডলারের চেয়ে অনেক কম ছিল। তারপরও সহযোগিতার একটি প্ল্যাটফর্মে পরিণত হওয়ায় অনেক দেশই এখন ব্রিকসে যোগ দিতে আগ্রহী। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে- ইরান, আর্জেন্টিনা, তুরস্ক, মিসর, সৌদি আরবসহ অনেক রাষ্ট্র। ব্রিকসের সম্ভাবনা দেখে আরও ২০টি দেশ সদস্যপদ লাভের আবেদন করেছে, যা বাস্তবায়িত হলে আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার দেশগুলোর প্রতিনিধিত্ব বাড়বে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ-পরবর্তীকালে উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোর জন্য ব্রিকসের প্রাসঙ্গিকতা আরো বেড়েছে। এর মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতিনিধি হিসেবে নিজস্ব অবস্থান সুদৃঢ়করণ এবং গ্রুপ অব জি-৭ ভুক্ত উন্নত দেশগুলোর বিকল্প মডেল দাঁড় করানোর লক্ষ্যও রয়েছে ব্রিকসের। বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে সব দেশ তাদের নিজস্ব মুদ্রা শক্তিশালী করতে চাচ্ছে। ব্রিকস গ্রুপ সেই লক্ষ্য অর্জনে তাদের সাহায্য করতে পারে। এটি এমন এক বিকল্প ব্যবস্থা, যা এ দেশগুলোকে ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি এবং ডলারের তীব্র ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করতে পারে। গত বছরে ১৪তম ব্রিকস সম্মেলনের সময় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ঘোষণা করেছিলেন, ব্রিকস দেশগুলো এমন এক মুদ্রাব্যবস্থা চালু করবে, যা দিয়ে একটি নতুন বৈশ্বিক রিজার্ভ মুদ্রা চালু করা যাবে, এটি মার্কিন ডলারের আধিপত্যের জন্য সরাসরি হুমকি হবে এবং এর আধিপত্য খর্ব করতে সাহায্য করবে।

উল্লেখ্য, ২০২২ সালের মার্চ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ আগ্রাসীভাবে সুদের হার বাড়িয়ে দেয়ায় বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল অনেক দেশের মুদ্রার ওপর নিম্নমুখী চাপ পড়ে। মুদ্রার অবমূল্যায়নের কারণে পণ্য, কাঁচামাল আমদানি ও বৈদেশিক ঋণ পরিশোধও বাধাপ্রাপ্ত ও ব্যয়বহুল হয়। ফলে, দেশগুলো থেকে পুঁজি চলে যাচ্ছে। এ বাস্তবতার নিরিখে এনডিবির বার্ষিক সভায় বৈশ্বিক মুদ্রাব্যবস্থা বহুমুখীকরণের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ব্রিকস জোটে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুইজারল্যান্ড সফরে বলেছিলেন, ব্রিকস যখন জোট করার প্রস্তুতি নেয়, তখন থেকেই বাংলাদেশ এর সঙ্গে ছিল, তবে ফাউন্ডার মেম্বার হওয়া যায়নি।

এখন মেম্বার হওয়ার সুযোগ এসেছে। বাংলাদেশ চাচ্ছে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেন এককভাবে কারও ওপর নির্ভরশীল না হতে হয়। অন্যান্য দেশের সঙ্গেও যেন অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ থাকে। বাংলাদেশের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো যেন পাওয়া যায়, যা ব্রিকসে যোগ দেয়ার সহায়ক সিদ্ধান্ত হিসেবে কাজ করেছে। বাংলাদেশের ব্রিকসে যোগদানের চ্যালেঞ্জও অনেক রয়েছে। যেমন- বৈশ্বিক পরিস্থিতি ও ভূরাজনীতি। এতে যুক্তরাষ্ট্র অসন্তুষ্ট হতে পারে। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ বাজারই বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য বাঁচিয়ে রেখেছে। ইইউ আমাদের অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধার অধীনে যেকোনো পণ্য শুল্কমুক্ত রপ্তানির সুযোগ দিয়েছে। সে কারণেই আমাদের প্রায় অর্ধেক তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়ে থাকে ইইউতে। যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি সুবিধা না দিলেও দেশটিতে রপ্তানি হচ্ছে ২০ শতাংশ পোশাক। অন্যদিকে, ব্রিকসভুক্ত চীন ও ভারত বাংলাদেশের মোট আমদানির প্রায় অর্ধেক সরবরাহ করে, যা রপ্তানির চেয়ে বহুগুণ বেশি। ফলে, দেশের বাণিজ্য ঘাটতি যা হয়, তা যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি ও প্রবাসী আয়, বৈদেশিক বিনিয়োগ ও ঋণ দিয়ে মেটাতে হয়। বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও শীর্ষস্থানে যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বের আন্তর্জাতিক প্রায় সব সংস্থা যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে। ফলে, বিভিন্ন সংস্থার ঋণ পাওয়া ও অবরোধ থেকে রক্ষা পাওয়া যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া সম্ভব হবে না। আবার বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম নিরাপত্তাকর্মী জাতিসংঘের মিশনে যায়, যা থেকে বাংলাদেশ একটি বড় ধরনের বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। যুক্তরাষ্ট্র বিপক্ষে গেলে বাংলাদেশ এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে পারে। আসন্ন ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচন এবং নির্বাচনকে ঘিরে বাংলাদেশ সাংবিধানিক পথেই হাঁটছে। যেমন-গণতন্ত্র, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন; মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতাসহ নানা ইস্যুতে সরকার খুবই আন্তরিক।

সব দলের অংশগ্রহণে এ দেশে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, সেটাই সরকারের মূল লক্ষ্য এবং সেভাবেই কাজ চলছে। এ ধরনের একটি সময়ে সরকার ব্রিকসের সদস্য হতে যাচ্ছে, যা প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এসব উদ্যোগের কারণেই একসময়ে তলাবিহীন ঝুড়ি’র বাংলাদেশকে বিশ্ব আজ সমীহ করছে। গত এক যুগে বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাত্রার মানের যে উন্নয়ন, তা আজ বিশ্বনেতাদের কাছে এক বিস্ময়। এ কারণে ২০১৯ সালে জাতিসংঘের অধিবেশনে তৎকালীন মহাসচিব বান-কি মুন বাংলাদেশকে উন্নয়নের মডেল হিসেবে অভিহিত করেন। ২০২১ সালে বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী পালন কালে এ নতুন বাংলাদেশের পেছনে শেখ হাসিনার কৃতিত্বের কথা উল্লেখ করেছেন বিশ্ব নেতারা। একজন দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে বাংলাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এখন সম্মানিত করা হচ্ছে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। দেশের সামাজিক পরিস্থিতি উন্নয়নে অভূতপূর্ব ভূমিকা রাখায় বিশ্বের শীর্ষ ১০ মহান নেতার একজন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন তিনি। তার নান্দনিক নেতৃত্বে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের শান্তিপূর্ণ ইমেজ গড়ে ওঠার স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ। এ কারণে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়েছে বাংলাদেশ। পরিশেষে বলব, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও উদারতা বাংলাদেশকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাবে, এটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা।

লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক