ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়

মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন
সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে নানা সময় ষড়যন্ত্রের নানা কথা শোনা গেছে। সরকারকে বিপাকে ফেলার জন্য কোনো কোনো মহল এই ষড়যন্ত্র করেছে তা অনেকটাই প্রমাণিত। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীদের কোনো প্রকার শাস্তি না হওয়ার কারণে ষড়যন্ত্র আরো বেশি বেশি হচ্ছে, এমনটাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা। ‘সিন্ডিকেট’ নামে যে শব্দটা বহুল প্রচলিত ও প্রচারিত সেই শব্দটার মূল উৎপাটনেরও চেষ্টা হয়েছে অনেকবার। বলা যায় ব্যর্থ সেই চেষ্টার কারণেই সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলেছে। বাড়তে বাড়তে বর্তমানে অনেকটা সহ্য সীমানার বাইরে চলে গেছে।

শুধু সিন্ডিকেটের কারণে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি তিনগুন চারগুন বেড়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যারা সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রক তারা সমাজ ও দেশের অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করা দুষ্কর বটে।

তারপরও সব সরকারই চেষ্টা করে সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতে। বেশিরভাগ সময়ই ব্যর্থ হয়। এই ব্যর্থতার পুরো প্রভাব পড়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ওপর। কথায় কথায় চাল, ডাল, চিনি, তেল, ডিম, পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ, তরিতরকারিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম হয়ে যায় আকাশছোঁয়া। ষড়যন্ত্রকারীরা এ সুযোগটাই গ্রহণ করে পুরোপুরি। সরকারকে বিপাকে ফেলতে তারা দ্রব্যমূল্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। যেমনটা করা হচ্ছে বেশ কয়েক বছর ধরে।

সম্প্রতি কাঁচামরিচ নিয়ে যা করা হয়েছে, তা আর যাই হোক পাকা কাজ হয়নি। খুবই কাঁচা কাজ হয়েছে। হয়তো সে কারণেই সাধারণ, অতিসাধারণ সব মানুষই বুঝেছিল যে সংকটটা কৃত্রিম। কোনো কোনো মহলের সৃষ্টি। মহলটি শুধুই সরকারকে বিপাকে ফেলার জন্য পরিকল্পিতভাবে কাজটি করেছে। তাদের ষড়যন্ত্র আর কারসাজির কারণেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যবাজার অস্থির হয়েছিল। যৌক্তিক কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ করে, একলাফে বহুগুন বেড়ে গিয়েছিল শাকসবজিসহ অন্যান্য কাঁচামালের দাম।

কাঁচামরিচের বাজারে আগুন লেগেছিল। সাড়ে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল এক কেজি কাঁচামরিচ। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ যেন এক বিরল ঘটনা। এই ঘটনা কে বা কারা ঘটিয়েছিল তা খুঁজে বের করা যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি তাদের শাস্তির আওতায় আনা। কাঁচামরিচের দাম আকাশছোঁয়া করার পেছনে যাদের অবদান সবচেয়ে বেশি তারা আর যাই হোক বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের বন্ধু নয়। তারা শুধুই ব্যবসায়ী। বলা যায় কাবুলিওয়ালাদের মতো বেনিয়া।

বর্ষাকালে কাঁচামরিচসহ শাকসবজির উৎপাদন কম হয় বলে কাঁচামালের দাম সামান্য বাড়ে। এই সময়ে কাঁচামরিচের কেজি ১০০ বা ১৫০ টাকা হয়েছে। কিন্তু ৭০০ টাকা! এত সর্বনাশ! এই সর্বনাশের হাত থেকে দেশ ও দেশের মানুষকে বাঁচাতে সরকার কাঁচামরিচ আমদানি শুরু করে। প্রথম চালান আসার সঙ্গে সঙ্গেই খুচরা বাজারে প্রতি কেজি কাঁচামরিচ বিক্রি হয় ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। একদিন পরই আবার বেড়ে হয় প্রতি কেজি ৪০০ টাকা। বর্তমানে দাম একেবারেই স্বাভাবিক। ১০০ থেকে ১৫০ টাকা কেজি, যা সাধারণত বর্ষাকালে থাকে।

কাঁচামরিচের দাম নিয়ে এমন ছিনিমিনি কারা খেলেছে, কেন খেলেছে সবই সরকারের জানা। কিন্তু কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে তথাকথিত সিন্ডিকেটের কাছে সব সরকারই পরাজিত হয়।

সিন্ডিকেট কখনো পেঁয়াজের দাম, কখনো তেলের দাম, কখনো চিনির দাম আকাশছোঁয়া করে দেয়। সরকার তাদের টিকিটিও ছুঁতে পারে না। আমাদের পাশের দেশগুলোতে প্রতি কেজি কাঁচামরিচ বিক্রি হচ্ছিল ১০০ টাকার নিচে। বাংলাদেশে ছিল ৪০০ টাকা। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল এ দেশের সাধারণ মানুষ ব্যবসায়ীদের হাতে জিম্মি ছিল। এখনও আছে। তাদের এই জিম্মিদশা কবে কাটবে, আদৌ কাটবে কি না কেউ জানে না। বাণিজ্যমন্ত্রী তো বলেই বসেছিলেন বাজার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে ক্রাইসিস আরো বাড়বে। বাণিজ্যমন্ত্রী যদি এমন কথা বলেন তা হলে দেশের সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়? কোথায় পাবে আশা-ভরসা?

বাণিজ্যমন্ত্রীর এই কথার নানা রকম ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করছে নানা মহল। সরকারের দায়িত্বশীল একজন মন্ত্রীর একটা কথায় দেশের মানুষ হতাশ।

কাঁচামরিচের দাম আকাশছোঁয়া হওয়ার পেছনেও রয়েছে সিন্ডিকেটের হাত। সিন্ডিকেটের সঙ্গে কারা জড়িত তা সবাই জানে। ওপরের দিকে থুথু ফেললে নিজের ওপরই পড়ে- এই কথাটা আমরা সবাই জানি; কিন্তু সবসময় মানি না। যার কারণে অনেক অঘটন ঘটে যায়। যেমন বড় অঘটনটি ঘটেছিল কাঁচামরিচের বাজারে।

যেকোনো বাজারে যেকোনো সময় আগুন লাগতে পারে। কিন্তু সে আগুন সরকারকেই নেভাতে হবে। জোরে বলে কৌশলে যে করেই হোক আগুন নেভাতে হবে। এর আঁচটুকু লাগতে দেওয়া যাবে না সাধারণ মানুষের গায়ে।

মানুষ আসলে একটু সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে চায়। জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া থাকলে সুখে থাকা আকাশকুসুম কল্পনা। ডিজিটাল এই যুগে মানুষ আকাশকুসুম কল্পনা করতে চায় না। বিষয়টা মাথায় রেখে কাজ করতে হবে। নির্বাচনের বছরটাকেও মাথায় রাখতে হবে।

সরকারকে বিপাকে ফেলার জন্য অনেক সিন্ডিকেটই সারাক্ষণ তৎপর থাকে। কৌশলে এসব সিন্ডিকেটের মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে হবে। সিন্ডিকেটের সব দায় অবশ্যই সরকার বহন করবে না। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ অনেক কাজ আছে সরকারের। দেশ পরিচালনা অনেক বড় কাজ। এই কাজের জন্য সময়, অর্থ সবই ব্যয় করতে হয়। পাশাপাশি সামলাতে হয় নানা রকম ঝামেলা, আলোচনা-সমালোচনা। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন রকম চাপ। হাজারো সমস্যার সহজ সমাধান করেই পরিচালনা করতে হয় দেশ, দেশের মানুষকে। পান থেকে চুন খসলেই যেন সব শেষ। বিশেষ করে দ্রব্যমূল্যের বিষয়টি বেশ স্পর্শকাতর। যেকোনো একটি নিত্যপণ্যের দাম সামান্য একটু বাড়লে মানুষ হইচই, চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করে। সময়ের প্রয়োজনে যেকোনো জিনিসের দাম সামান্য বাড়তেই পারে। সে বাড়াকে নিয়ে আর যাই হোক রাজনীতি করা বা কূটনীতির মারপ্যাঁচ দেওয়া সমীচীন নয়। বাংলাদেশে যদিও প্রায় সময়ই এই কাজ করা হয়। কোনো একটি জিনিসের দাম বাড়লেই তাকে নিয়ে শুরু হয় রাজনীতি। আলোচনা-সমালোচনা, পর্যালোচনা।

যুক্তি দিয়ে তর্ক করাটা যুক্তিযুক্ত। তর্কের খাতিরে তর্ক করা অযৌক্তিক। কী কারণে কাঁচামরিচের বাজারে আগুন লেগেছিল তা অনুসন্ধান না করে শুধু সরকারকে দায়ী করাটা যুক্তিসংগত নয়। নিত্যপণ্যের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতায় রাখার সবরকম চেষ্টা সরকার করে। সরকারের চেষ্টার প্রতিফলন তখনই ঘটে, যখন জিনিসের দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে।

যখনই ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায় তখনই মানুষ একচেটিয়া সরকারকে দোষারোপ করতে থাকে। সরকার কতটা দায়ী তা একবারও চিন্তা করে না। চিন্তা করার প্রয়োজনীয়তা পর্যন্ত অনুভব করে না। সরকারকে দোষারোপ করতে পারলেই যেন শান্তি। আসল শান্তি যে কোথায় তা সাধারণ মানুষ বোঝেও অনেক সময় বোঝে না। এই দেশটা আমাদের। দেশটা রক্ষা করব আমরাই। এই ভাবনাটা দেশের মানুষের মন ও মগজে গ্রোথিত থাকলে আর যাই হোক অনৈতিক বা অন্যায্য কিছু হবে না। কথায় কথায় তেল, চিনি, আদা, পেঁয়াজ, কাঁচামরিচসহ নিত্যপণ্যের দাম লাগামহীনভাবে বাড়বে না। দেশের সাধারণ মানুষ পড়বে না সীমা-পরিসীমাহীন বিপাকে। বিদেশিরা এসে দূতিয়ালি করতে হবে না।

বিবেকবিবর্জিত কোনো দেশ, জাতি, রাষ্ট্র কিংবা ব্যক্তি সমাজে টিকে থাকতে পারে না। কোনো রকমে টিকলেও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে। এই চলাতে তেমন কোনো সম্মান নেই, সাধনা নেই, নেই কোনো সংগ্রাম। সংগ্রামহীন বেঁচে থাকার মাঝে আত্মমর্যাদা নেই। বাঙালি বীরের জাতি। আজীবন সংগ্রাম করে টিকে আছে। ১৯৭১ সালে টানা ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জন করেছে মহান স্বাধীনতা। ছিনিয়ে এনেছে লাল-সবুজ পতাকা। এই পতাকার মান রক্ষায় বদ্ধপরিকর বাঙালি জাতি। কিছু মহল আছে যারা সারাক্ষণ অপচেষ্টা চালায় সরকারকে বিপাকে ফেলতে। সরকারের ব্যর্থতার পাল্লা ভারি করতে। তারা কখনো সফল হয়, কখনো ব্যর্থ হয়। সুজলা-সুফলা-শস্যশ্যামলা সোনার বাংলাদেশ আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি। এই দেশটিকে নিয়ে আমরা গর্ব করি। দেশটির সুনাম ধরে রাখার দায়িত্ব আমাদের। প্রাণের চেয়ে প্রিয় বাংলাদেশের মাথা হেয় হয়, এমন কাজ আমরা করি না। কোনো কোনো মহল করে। তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। সাবধান হতে হবে।

বাংলাদেশের চলমান আন্দোলন বলে দিচ্ছে নির্বাচন আসছে। এই নির্বাচনে সব দলই অংশগ্রহণ করবে সে আশাই করছে দেশের মানুষ। বিদেশিরা দৌড়ঝাঁপ করছে। তাদের উদ্দেশ্য একটাই, বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া। সেই চেষ্টাটাই করছে তারা। বাংলাদেশের বড় বড় রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তারা বৈঠক করছে। সামনে আরো বৈঠক করবে। টান টান উত্তেজনা চলছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে। বলা যায় সেকেন্ডে সেকেন্ডে পরিবর্তন হচ্ছে রাজনীতির পট। অনেক দিন পর রাজনীতির মাঠের এই চাঙাভাবে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ বেশ আনন্দিত। তাদের এই আনন্দটা ধরে রাখতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে।

একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন উপহার দিয়ে শান্তি-স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে হবে জনমনে। উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার ব্যাপারটাও মাথায় রাখতে হবে। ডিজিটাল, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ও স্বপ্নকে অবশ্যই মূল্যায়ন করতে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত