এত খাদ্য যদি নষ্ট না হতো!
অলোক আচার্য
প্রকাশ : ২৯ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে প্রধান হলো খাদ্য। মানুষ খাওয়ার জন্য বাঁচে না বাঁচার জন্য খাদ্য গ্রহণ করে, সে নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এটা এক বাক্যে স্বীকার্য যে খাদ্য গ্রহণই মানুষের কাজের প্রধান উদ্দেশ্য। দিন-রাত পরিশ্রম করে দু’মুঠো ভাতের জন্য। পৃথিবীর প্রত্যেকের খাদ্য গ্রহণের অধিকার রয়েছে। খাদ্যের চাহিদা পূরণ হওয়ার পর বাকি মৌলিক চাহিদা পূরণের প্রশ্ন দেখা দেয় বা আবশ্যকতা দেখা দেয়। তাই প্রতিটি নাগরিকের ক্ষুধা নিবারণ করার চেষ্টা রাষ্ট্রের সর্বাগ্রে প্রয়োজন। পৃথিবীতে আজও অনেকে অনাহারে বা অর্ধাহারে ঘুমাতে যায়। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার রির্পোট মতে, ৫৩টি দেশের প্রায় ১৯৩ মিলিয়ন মানুষ ২০২১ সালে অনাহারে-আধপেটে দিনগুজরান করেছে। রিপোর্টে এর জন্য দায়ী করা হয়েছিল সংঘর্ষ, আবহাওয়ার চরম অবস্থা, করোনাভাইরাসের মহামারি। এর মধ্যেই নতুন সংকট হলো ইউরোপের চলমান যুদ্ধ যা গত কয়েক শতাব্দী ইউরোপ দেখেনি। এবার আলোচনায় আসা যাক। সংঘর্ষ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কয়েক বছর ধরেই চলমান ইস্যু। যেমন- ইয়েমেনে গত কয়েক বছর ধরেই সংঘর্ষ চলছে। অবস্থা এমন যে সেখানে দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বর্তমান পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ ক্ষুধার্ত থাকে। ঠিক সেই সময়ে প্রচুর খাবার নষ্ট হয়। বিশেষত আমাদের দেশের বিয়ে বাড়িতে লক্ষ্য করলে দেখবেন, একদিনেই কি পরিমাণ খাদ্য আমরা প্লেটে নষ্ট করছি। ঠিক সেই সময় বিষয়টি আমাদের মাথায় ঢুকছে না। কিন্তু যদি ভাবি যে, এই নষ্ট করা পরিমাণ খাদ্য আরো কয়েকজনের ক্ষুধার্ত মানুষের খাদ্য জোগান দিতে পারত অথবা এই পরিবারের কিছু অর্থও সাশ্রয় হতো, তাহলেও এর পরিমাণ কমে আসত। শুধু বিয়ে বাড়ি নয়, প্রতিটি অনুষ্ঠানেই এভাবে খাদ্য অপচয় হচ্ছে। প্রতিদিন হচ্ছে। কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারছি না। কোনো আইন করেও এটা কমানো সম্ভব হবে না, যদি না আমরা সচেতন হই। এটা শুধু কোনো অনুষ্ঠানের কথা। এছাড়াও প্রতিটি বাড়িতেই প্রতিদিন খাদ্য অপচয় হচ্ছে। কোনো কোনো পরিবারে তা অনেক বেশি। যে ভাত আপনি বা আমি ফেলে দিচ্ছি, খাবারের প্লেটে অতিরিক্ত হওয়ায় সেই পরিমাণ চাল কেনার জন্য দিনান্ত পরিশ্রম করছে কেউ। আবার দিন শেষে কেউ সেই পরিমাণ খাদ্যই কিনতে পারে না। কারও মুখে পোলাও-কোরমা জুটছে না, আবার কারও মুখে চারটা ডাল-ভাতই স্বপ্নের মতো মনে হয়। অর্থাৎ আমাদের দেশে বিপুল খাদ্য নষ্ট হচ্ছে। এর দৃশ্যমান কোনো সমাধান নেই। বিশ্বব্যাপী এই একই চিত্র।
ধনীরা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি নিয়ে নষ্ট করবে আর একশ্রেণি প্রয়োজন হলে ডাস্টবিন থেকে খাদ্য খুঁজে নেবে। ভারসাম্যহীন এই অবস্থার জন্য আমাদের দায় রয়েছে। ঠিক কি পরিমাণ খাদ্য অপচয় হচ্ছে, তার একটি তথ্য দেওয়া যাক। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, অপচয় হওয়া খাদ্য দিয়ে দেশের ১৭ কোটি মানুষের ৩ মাসের খাদ্য চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। এটি দৃশ্যমান অপচয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই দৃশ্যমান অপচয়ে থেকে প্রকৃত অপচয় ৭ গুণ বেশি। সংরক্ষণ করার সব রকম সুযোগ-সুবিধা সত্ত্বেও বিপুল পরিমাণ খাদ্য অপচয় শুধু আমাদের মূর্খতা এবং অজ্ঞতারই বহিঃপ্রকাশ। চলতি বছরের জুন মাসে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত দশম আন্তর্জাতিক নিরাপদ খাদ্য ফোরাম এবং এফএওর গবেষণা থেকে জানা যায়, শস্যদানা মাসে চাল, গম ও ডাল এসব উৎপাদন থেকে মানুষের প্লেট পর্যন্ত পৌঁছানো আগেই প্রায় ১৮ শতাংশ অপচয় হয়। ফল আর সবজির ক্ষেত্রে অপচয় হয় ১৭ থেকে ৩২ শতাংশ পর্যন্ত। এফএও ২০২১ সালে বাংলাদেশে চালানো সমীক্ষা থেকে জানা যায়, উচ্চ আয়ের পরিবারে প্রতি মাসে মাথাপিছু ২৬ কেজি খাদ্য নষ্ট বা অপচয় করে। সমীক্ষা মতে, বছরে যে ২ কোটি ৫২ লাখ মেট্রিক টন চাল খাবার হিসেবে খাই, তার মধ্যে অজ্ঞতা এবং বিলাসবহুলতার কারণে পারিবারিক পর্যায়ে ৫.৫ শতাংশ অপচয় হয়। যার পরিমাণ কমপক্ষে ১৩ লাখ ৮৬ হাজার টন। আমাদের উৎপাদিত ফল বা সবজির একটি অংশ নষ্ট হচ্ছে। আমাদের অবহেলা, খাদ্য সংরক্ষণ নিয়ে সঠিক ধারণা না থাকা এবং নিজেদের অহংকার প্রকাশ করতে গিয়ে আমরা খাদ্য অপচয় করছি। অথচ সবাই যদি খাদ্য অপচয় থেকে বেরিয়ে আসতে পারি, তাহলে খাদ্যমূল্যেও তার প্রভাব পরবে। দাম কমবে।
পৃথিবী নামক এই গ্রহটি কবে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত হবে তা বলা যায় না। তবে একদিন নিশ্চয়ই আসবে যেদিন একজন মানুষও ক্ষুধা পেটে নিয়ে ঘুমাতে যাবে না। যুদ্ধ-বিগ্রহ, প্রতিনিয়ত ঘটা প্রাকৃতিক বিপর্যয় মানুষকে দারিদ্র্যতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। যা ক্ষধার্ত মানুষ তৈরি করছে। ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি- কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের লেখা এই কবিতা থেকে ক্ষুধার যন্ত্রণা সম্পর্কে কিছুটা উপলব্ধি করা যায়। আবার প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ বলেছেন, রুচির রহস্য ক্ষুধায়। যেখানে ক্ষুধা নেই, সেখানে রুচিও নেই। ক্ষুধা প্রাণীর স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। মানুষ বাঁচার জন্য খায় নাকি খাওয়ার জন্য বাঁচে একজন ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে সে প্রশ্ন অর্থহীন। প্রকৃতপক্ষে ক্ষুধা এমন একটি কষ্ট যা ক্ষুধার কষ্টে না থাকায় কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী অনুভব করতে পারে না। তা সম্ভবও নয়। আপনি যখন খাদ্য অপচয় করেন এবং তা সজ্ঞানে তাহলে আপনি কোনোদিনও সেই ব্যথা বুঝবেন না। ব্যথিতের বেদন শুধু একজন ব্যথিত হৃদয়ই বুঝতে পারে। একদিকে ক্ষধার্ত মানুষের যন্ত্রণার আওয়াজ অন্যদিকে কোটি কোটি টাকার মারণাস্ত্রের বিকট শব্দ। কত কত আধুনিক অস্ত্রের সাজেসজ্জিত এই ধরণী। এটাই সব থেকে আশ্চর্যের যে মানুষ একমাত্র প্রাণী যারা অন্য মানুষের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য এসব অস্ত্র কিনছে। সেসব অস্ত্র বানাতেও কোটি কোটি ডলার ব্যয় করছে।
ইয়েমেন দীর্ঘদিন ধরে মানবিক সংকটে ভুগছে। এই মানবিক সংকটের অন্যতম হলো সবার জন্য খাদ্যের নিশ্চয়তা। যুদ্ধাবস্থা দীর্ঘমেয়াদে চলতে থাকলে যেকোনো দেশেই এই রকম অবস্থারই সৃষ্টি হতে পারে। যারা যুদ্ধ বোঝে না, যারা অস্ত্র বোঝে না, যারা দুমুঠো খাবার চেনে। অস্ত্র সেখানে নিরর্থক। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এটা সবার জন্য নিশ্চিত করা একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয়। দীর্ঘ পরিকল্পনা, কৃষির উন্নতির মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা এবং সুষ্ঠু বণ্টন। বাংলাদেশ বহু প্রচেষ্টায় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। এটি ধরে রাখতে হবে এবং উৎপাদন বৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে হবে। কারণ দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্ধিত জনসংখ্যার সঙ্গে সঙ্গে কৃষিজমি কমে যাচ্ছে। এখন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কৃষিকাজ পরিচালনা করতে হবে।
ক্ষুধার্ত মানুষ কি কি করতে পারে। উত্তরটা এক কথায়। সবকিছু পারে। সে তখন নীতি-নৈতিকতার ঊর্ধ্বে থাকে। তাই ক্ষুধার সঙ্গে সমাজের আইনশৃঙ্খলার একটা প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। যত ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বাড়বে প্রত্যেক সমাজে ততই বিশৃঙ্খল অবস্থা বৃদ্ধি পাবে। কারণ প্রয়োজন কোনো আইন মানে না। প্রতিটি মুখের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা সেই রাষ্ট্রের দায়িত্ব। প্রজাদের অভুক্ত রেখে রাজাদের মুখে মন্ডা মিঠাই খাজা ওঠে কি করে। সেই যে কবিতায় জন্মদিনের পার্টিতে একটি কুকুরের যে খাতির দেখিয়ে ব্যঙ্গ করা হয়েছিল তা আজও অসহায় মানুষের রূপ। দামি আ্যালসেসিয়ানকে খাওয়াতে যে টাকা খরচ হয়, তার অনেক কম টাকাতেই তো অভুক্তের পেট ভরে। করোনা অতিমারির সময় পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেই আর্থিক কাঠামোতে প্রভাব পরেছে। মানুষ বেকার হয়েছে, আর বেকারত্ব দারিদ্রতা ডেকে এনেছে। মধ্য ও নিম্নআয়ের মানুষের ওপর এই প্রভাব বেশি পরেছে। বিভিন্ন দেশ এ থেকে উত্তোরণের জন্য একটি ভালো খাদ্যব্যবস্থা গড়তে গ্রামাঞ্চলে উন্নত কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করছে। ক্ষুধা ও দারিদ্র্য নিয়ে যে শুধু আমাদের মতো উন্নয়নশীল বা দরিদ্র দেশগুলোই চিন্তিত বিষয়টা এমন নয়। তবে খাদ্য সংকট এবং খাদ্য ক্রয়ের ক্ষমতা কমে আসা এই দুইয়ের মধ্যে একটু পার্থক্য রয়েছে। খাদ্য সবারই প্রয়োজন। আমার মনে হয়, খাদ্য সংকটের একটি কারণও এই খাদ্য অপচয় করা। ধর্মীয় বিধানেও খাদ্য অপচয় করা অন্যায়। আমি যখন খাদ্য অপচয় করি, তখন অন্য কারো মুখের খাদ্য নষ্ট করছি অথবা যদি ভাবি আমার এই ফেলে দেওয়া বা নষ্ট করা খাবারে কারও পেট ভরবে তাহলেই যথেষ্ট। আমরা এক বিন্দু খাদ্যও অপচয় করব না- এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।