নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ও ইভটিজিং
মাহমুদা টুম্পা, শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
প্রকাশ : ৩০ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
বাইবেলের ভাষা অনুসারে ‘ইভ’ মানে পৃথিবীর আদিমাতা। আমরা মুসলমানরা যাকে আদিমাতা হাওয়া বলে মনে করি। ‘ইভ’ নারীর রূপক অর্থে ব্যবহৃত। আর ‘টিজিং’ অর্থ উত্ত্যক্ত করা। সাধারণভাবে কোনো নারীকে শারীরিক ও মানসিকভাবে উত্ত্যক্ত করাই হলো ইভটিজিং। আমাদের সমাজে উত্ত্যক্তকারীদের জ্বালাতনে নারীর জীবন অতিষ্ঠ। রাস্তাঘাটে বখাটে ছেলেদের উত্ত্যক্ত ও হয়রানির শিকার হয়ে মেয়েদের স্কুল-কলেজ যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। লজ্জায় বা লোক নিন্দার ভয়ে মেয়েরা যুগ যুগ ধরে সহ্য করছে, উত্ত্যক্ত হয়েও প্রতিবাদ করতে না পেরে মানসিক যন্ত্রণায় ছটফট করেছে। কেউ কেউ প্রতিবাদের কারণে উপহার পেয়েছে এসিডদগ্ধ মুখ, লাশ হয়ে ফিরেছে ঘরে। আবার অনেকে পরিবার থেকে সমর্থন সহযোগিতা না পেয়ে বেছে নিয়েছে আত্মহত্যার পথ। তবু থামছে না ইভটিজিং প্রবণতা। বরং বাড়ছেই দিনে দিনে ব্যাপকহারে।
ইভটিজিংয়ের অনেকগুলো কারণের মধ্যে অন্যতম একটি কারণ হলো নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়। আগে জানা যাক নৈতিক মূল্যবোধ বিষয়ে। নৈতিক মূল্যবোধ হলো মানুষের জীবনে অনুসরণযোগ্য এমন কিছু আচরণবিধি, যা মানুষের জীবনব্যবস্থা ও জীবনপদ্ধতিকে সৌজন্যবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, অধ্যবসায়, সর্বোপরি সত্য ও ন্যায়ের পথে পরিচালিত হওয়া ইত্যাদি বিশেষ কতকগুলো গুণ। যা করে তোলে সুন্দর, নির্মল ও রুচিস্নিগ্ধ। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে সততা, কর্তব্যনিষ্ঠা, শ্রম, উত্তম চরিত্র, শিষ্টাচার, সুন্দর গুণাবলী। নৈতিক মূল্যবোধ মানবচরিত্রকে করে তোলে সুষমামণ্ডিত। তাই মানুষের আত্মিক সামাজিক উৎকর্যের জন্য এবং জাতীয় জীবনে উন্নয়ন ও অগ্রগতি নিশ্চিত করার জন্য সমাজে নৈতিক মূল্যবোধের লালন, চর্চা ও বিকাশের বিশেষ গুরুত্ব আছে। এই কারণে শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্যই হচ্ছে মানবচিত্তে নৈতিক মূল্যবোধের উৎসারণ এবং তার মাধ্যমে নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ গড়ে তোলা।
বর্তমানে আমাদের সমাজজীবনে নৈতিক অবক্ষয়ের চরম চিত্র জীবন্ত হয়ে আছে। এ অবক্ষয় যুবসমাজকেও প্রভাবিত করছে, দোলা দিচ্ছে তাদের মনমানসিকতাকে। আমাদের যুবসমাজের সামনে আজ কোনো আদর্শ নেই। নেই অনুপ্রাণিত করার মতো কোনো মহৎ প্রাণ মানুষ। ঘরে-বাইরে সর্বত্রই আজ মনুষ্যত্বের দীনতার চিত্র। বর্তমান সমাজব্যবস্থায় বড়দের কাছ থেকে ভালো কিছু শেখার আশা করা যায় না। বড়রা শিক্ষা বলতে বুঝেন পরীক্ষা ও ডিগ্রি এবং জীবনে উন্নতি বলতে বোঝেন টাকা ও প্রতিপত্তি। ফলে শিক্ষার মধ্যে তরুণ সমাজ খুঁজে পায় না মহত্তর কোনো জীবনবোধ। যুবসমাজকে নতুন চেতনায় উদ্দীপ্ত করার মতো কোনো পরিকল্পনা নেই, ফলে তারা প্রতিনিয়ত অবক্ষয়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। অর্থনৈতিক বিপর্যয়ও আমাদের যুবসমাজের অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাও যুবসমাজের অবক্ষয়ের আর একটি কারণ। একদিকে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-কলহ, অপরদিকে অর্থনৈতিক দুর্দশা, ফলে শিক্ষাজগতে নৈরাজ্য, সমাজসেবার নামে নিজের স্বার্থ হাসিল এবং স্বেচ্ছাচারিতা যুবসমাজকে বিপথগামী রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় জঘন্য, নিষ্ঠুর কাজকর্ম করছে। তরুণসমাজ অবাক বিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করে, অনেকে আইনের চোখে নিরাপদ। প্রশাসন প্রয়োজনমতো ওদের ব্যবহার করে। কী তাদের মূলধন? তারা অনায়াসে মানুষ খুন করে, ডাকাতি করে, ইভটিজিংকারী হিসেবে জনজীবনে ত্রাসের সৃষ্টি করে। আজ তাই মানবিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধও গৌণ হয়ে উঠেছে। বস্তুত সমাজের সর্বস্তরে আজ যে মূল্যবোধের অভাব, তার মারাত্মক প্রতিক্রিয়া তরুণ ও যুবকদের মাঝে প্রতিনিয়ত বিস্তৃতি ঘটছে। গোটা প্রশাসনকে দুর্নীতিবাজদের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র বানিয়ে একশ্রেণির রাজনীতিক আমলা অসাধু ব্যবসায়ী এবং দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ বিভিন্ন সংস্থার দুর্নীতিবাজরা বিদেশি অর্থ, সাধারণের বাস্তুভিটা, খাল-বিল, নদী-নালা, পাহাড়, বন-বাদাড় দখল করে বিলাস-ব্যসনে মত্ত হয়েছে। অন্যদিকে সেদিনের টগবগে যুবকটি শিক্ষা শেষে চাকরি না পেয় ধুঁকে ধুঁকে মরছে। ক্লিষ্ট, ক্লান্ত, ধ্বংস জীবনকে আঁকড়ে ধরে কোনোমতে সে বেঁচে আছে। জীবনযুদ্ধে পরাজিত দিশাহারা এই যুবকটি যদি পথ খুঁজতে খুঁজতে বিপথগামী হয়ে পড়ে কিংবা অজ্ঞাতে কোনো নৈতিক অবক্ষয়ের পথে পা বাড়ায়, তবে সে দোষ কার? কে নেবে তার দায়? আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলওর মতে আজ বেকারের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে হয়েছে প্রায় তিন কোটি।
বেকারত্বের অভিশাপ যে কতটা কষ্টদায়ক, তা ভুক্তভোগীরাই জানে। লেখাপড়া শেষ করেও যখন চাকরি মেলে না, তখন হতাশা আর অর্থনৈতিক সংকটের মুখে অসহায় এই যুবকের করণীয় কী? এভাবে তরুণসমাজকে বিপথগামী করার জন্য আরো নানা উপকরণ সদা সক্রিয়।
বিভিন্ন জাতীয় পএিকার রিপোর্ট অনুযায়ী ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হওয়া সত্ত্বেও ২০২০ সালের চেয়ে ২০২১ সালে শিশু ধর্ষণের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ। কন্যাশিশু ধর্ষণের সংখ্যা বেড়েছে ৭৪ দশমিক ৪৩ শতাংশ। শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৩১৬ জন, ৩৭ জনের অস্বাভাবিক মৃত্যু ও ২৮৮ জন শিশু-কিশোরী হত্যার শিকার হয়েছে। আত্মহত্যা করেছে ৩১৭ জন শিশু। শারীরিক গঠন নিয়ে পথচারীর কাছ থেকে নেতিবাচক কথা শুনেছেন ১১ দশমিক ৮৫ শতাংশ নারী।
ওজনের কারণে নেতিবাচক মন্তব্যের শিকার হতে হয় বলে ৩৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ নারী মনে করেন। ২৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ নারী সম্মতি ছাড়াই পরিবার থেকে বিয়ের চাপের সম্মুখীন হয়েছেন বলে জরিপে উঠে এসেছে। ৬৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। আর বিভিন্ন জায়গায় ইভটিজিংয়ের শিকার হয়েছেন ২২ দশমিক ২৬ শতাংশ। গণপরিবহনে ৪৫ দশমিক ২৭ শতাংশ নারী যৌন হয়রানির শিকার হন বলে জরিপে উঠে এসেছে। এভাবেই মেয়ে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়, বাধ্য হয়ে বাল্যবিয়েতে রাজি হতে হয়। যদিও এ দোষ মেয়েদের নয়, অন্য কারো, তবু ভুক্তভোগী থেকে যায় মেয়েরা। তাদের বাড়ি থেকে বের হতে দেয় না। স্কুল-কলেজে যেতে দেয় না। মেয়েরা বেড়ে ওঠার সুযোগ পায় না। আমরা যদি একটু ভেবে দেখি ইভটিজিংয়ের কারণে যাদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে বা বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে তারা যদি লেখাপড়ার সুযোগ পেত তাহলে তারাও ব্যক্তিজীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ভূমিকা রাখত, আইডল হতো অন্য নারীদের ক্ষেত্রে। এভাবে ইভটিজিং এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে পশ্চাৎপদে থেকে যাচ্ছে। তাহলে সমাজ সুষম উন্নয়ন হচ্ছে তো।
স্কুল-কলেজ অফিস আদালত গার্মেন্টে শুধু নারীরা উত্ত্যক্ত হয় না, আত্মহত্যা করে না, এমনকি শিশুরাও সহিংসতার শিকার হয়। লালসা মিটিয়ে মেরে ফেলে নিষ্পাপ শিশুদের। এমনকি প্রতিবাদকারীরাও নিরাপদ নয়। তাদেরও মেনে নিতে হয় মরণডালা। একসময় কালে-ভদ্রে কোনো তরুণ বা যুবক কোনো মেয়েকে রাস্তাঘাটে উত্ত্যক্ত করার চেষ্টা করলে কোনো অভিভাবক বা শিক্ষকদের দেখলে দৌড়ে পালাত। আর এখন উল্টো বেড়ে যায় বেপরোয়ার মাত্রা, হুমকি-ধমকি এমনি হত্যা করতে দ্বিধাবোধ করে না। এভাবে টানা বারো দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে হেরে গেছেন ইভটিজিং প্রতিরোধী নাটোরের কলেজ শিক্ষক মিজানুর রহমান। এই যদি হয় শিক্ষকের মর্যাদা তাহলে নৈতিক মূল্যবোধ কতটা নিচে ছাত্রসমাজের তা আমরা সবাই বুঝতে পারছি।
এখন কথা বলা যাক সমাধানের বিষয় নিয়ে। নৈতিক মূল্যবোধ অবক্ষয় রোধে পারিবারিকভাবে সন্তানদের নৈতিক শিক্ষা দান করতে হবে। তরুণ ছেলেমেয়েদের ব্যাপারে পরিবারকে আরো সচেতন হতে হবে। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে চ্যারিটি বিগিন এট হোমস। অর্থাৎ যেকোনো ভালো কাজ আগে ঘর থেকেই শুরু করা উচিত। যে কারণে ইভটিজিং প্রতিরোধে প্রথম পদক্ষেপগুলো নিতে হবে ঘরে। যেমন আপনি যদি মা হয়ে থাকেন তাহলে আপনার প্রথম দায়িত্ব হবে আপনার শিশুপুত্রটির মনমানসিকতা এমনভাবে তৈরি করা যাতে করে সে বড় হয়েও এরকম ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডে লিপ্ত না হয়।
মায়েদের আরেকটি বড় দায়িত্ব হলো নিজেদের কন্যাসন্তানদের ওপর সর্বদা দৃষ্টি রাখা, তাদের চলাফেরায় শালীনতা বজায় রাখা।
ছেলেদেরও পরিবার থেকে মেয়েদের সম্মান করাতে শেখাতে হবে। পাশাপাশি সমাজে মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনার প্রতিও নজর দিতে হবে। আমাদের দেশের ঐতিহ্যবাহী সামাজিক অনুশাসনগুলো পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। মানুষের প্রতি মেয়েদের প্রতি মায়েদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত করতে হবে। তৈরি করতে হবে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ। খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রসার ঘটিয়ে, পাড়ায় পাড়ায় পাঠাগার আন্দোলন গড়ে তুলে তথা সুস্থ ধারার সাংস্কৃতিক চর্চার মাধ্যমে কিশোর-তরুণদের অপরাধমূলক ও ক্ষতিকর তৎপরতা থেকে দূরে রাখতে হবে। যে মেয়ে ইভটিজিং এর শিকার পরিবার থেকে তার প্রতি সহানুভূতি, সাহস ও আশ্বাস দেওয়া বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ; যাতে মেয়েটি তার মনোবল হারিয়ে না ফেলে। নারীকে মানুষ হিসেবে সম্মান করার বিষয়টি পুত্র সন্তানদের পরিবার থেকেই শিক্ষা দিতে হবে। ইভটিজিং পুরুষের জন্য তামাশা হলেও নারীর জন্য যন্ত্রণার কারণ। এ যন্ত্রণা কেবল মেয়েরাই বুঝে। ইভটিজিং রোধে নৈতিক মূল্যবোধের অবদান অনস্বীকার্য। তাই তরুণ প্রজন্মকে নৈতিক মূল্যবোধের মাহাত্ম্য বুঝতে হবে। নারীর অগ্রগতি ও সুষম উন্নয়নে নৈতিকতার চর্চা করতে হবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।