উন্নয়নের ধারায় বিমান

তাহেরা খন্দকার, মহাব্যবস্থাপক জনসংযোগ, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স

প্রকাশ : ৩১ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বিশ্বের বুকে জাতির স্বাধীনতা ও স্বার্বভৌমত্বের প্রতীক জাতীয় পতাকা বহন করে চলেছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। একটি মাত্র ডিসি-৩ উড়োজাহাজ নিয়ে সদ্য স্বাধীন দেশে জাতির পিতার হাত ধরে যাত্রা শুরু করা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বহরে যুক্ত হয়েছে বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ড্রিমলাইনার উড়োজাহাজ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে একটি থেকে একুশটিতে উন্নীত হয়েছে বিমানের বহর। জীর্ণতা ছেড়ে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম তারুণ্যদীপ্ত বহর হিসেবে সুপরিচিতি লাভ করেছে। বিমান বহরের আধুনিকায়নের ফলে লাভের ধারায় ফিরতে শুরু করেছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে অতীতের সব রেকর্ড অতিক্রম করে পরিচালন ব্যয় বাদ দিয়ে ৪৩৯.৭৮ কোটি টাকা নিট মুনাফা অর্জন করেছে। পূর্ববর্তী বছরেও অর্থাৎ করোনা মহামারির মাঝে যখন বিশ্বের বৃহৎ এয়ারলাইন্সসহ সিংহভাগ এয়ারলাইন্স লোকসানের মধ্যে ছিল সে বছরও চার্টার্ড ফ্লাইট পরিচালনা করে ১৫৮ কোটি টাকা নিট মুনাফা অর্জন করেছিল বিমান।

গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ে সক্ষমতা বৃদ্ধি ও মানসম্মত সেবা প্রদানের স্বীকৃতি হিসেবে আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহন সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন (আইএটিএ) কর্তৃক প্রশংসা অর্জন ও নিবন্ধন লাভ, সুষ্ঠুভাবে হজ কার্যক্রম সম্পন্ন করা, নারিতা ও গুয়াংজু রুটে ফ্লাইট পুনঃপ্রবর্তন, বিদেশি এয়ারলাইন্সের সঙ্গে কোড শেয়ার, নতুন প্যাসেঞ্জার সার্ভিস সিস্টেম (পিএসএস) চালু, অনলাইন টিকেটিং, ওয়েব চেক-ইন, লয়্যালটি ক্লাব, মোবাইল এ্যাপসের মতো আধুনিক সেবা চালুকরণ ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার কারণে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স সাফল্যের ধারায় এগিয়ে চলেছে। সম্প্রতি আইএটিএ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমানের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং কার্যক্রম নিরীক্ষা করেছে। ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন সেফটি অডিট ফর গ্রাউন্ড অপারেশন্স (আইএসএজিও) নামে পরিচিত এই নিরীক্ষা কার্যক্রম বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত অন্যতম গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং নিরীক্ষা।

নিরীক্ষা কার্যক্রম সম্পন্নের পর সংস্থাটি বিমানকে নিবন্ধন প্রদান করেছে এবং প্রশংসা জানিয়েছে। এর ফলে বিমানের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সেবা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে স্বীকৃতি পেল, যার মাধ্যমে বহির্বিশ্বে বিমানের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সেবা বিস্তৃত করার সক্ষমতা অর্জিত হয়েছে। এই স্বীকৃতির ফলে কেবল বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশেও বিমান তার সেবা প্রসারিত করতে পারবে। সাম্প্রতিক সময়ে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং খাতকে ঢেলে সাজাতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স বেশ কিছু উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।

এ খাতের আধুনিকায়নে দক্ষ জনবল নিয়োগের পাশাপাশি প্রায় একহাজার কোটি টাকার গ্রাউন্ড সার্ভিস ইক্যুইপমেন্ট ক্রয় করা হয়েছে। পাশাপাশি ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরেও গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের জন্য বিভিন্ন ধরণের যন্ত্রপাতি ক্রয়ে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বর্তমানে বিমানবন্দরে স্থাপনাগত বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার মাঝেও সেবা গ্রহীতা এয়ারলাইন্সের জন্য সর্বোত্তম সেবা নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা চলমান রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ: এবছর সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে প্রি ও পোস্ট মিলিয়ে ৬০০-এর অধিক হজফ্লাইটে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সেবা প্রদানের মাধ্যমে ১, ২২, ৫৫৮ জন হজযাত্রীকে পরিষেবা প্রদান করেছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। সুষ্ঠুভাবে হজ কার্যক্রম সম্পন্ন করায় সম্প্রতি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয় বিমানকে প্রশংসাসূচক শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছে।

বর্তমানে দ্রুততম সময় লাগেজ ডেলিভারি দেয়া হচ্ছে। প্রথম ব্যাগেজ ১৮ মিনিট এবং শেষ ব্যাগেজ ৫৮ মিনিটের ভিতরে ডেলিভারি প্রদানের হার ৯৯.১৭ শতাংশ। অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে সম্মানিত যাত্রীদের সঙ্গে না আসা লাগেজ হোম ডেলিভারির ব্যবস্থা করা হয়।

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমানের সেবার মান বৃদ্ধিকল্পে সার্বক্ষণিক মনিটরিংয়ের জন্য ১১টি ভিজিলেন্স টিম গঠন করা হয়েছে। তারা নিয়মিত বিমানবন্দরের চেক-ইন কাউন্টার, ব্যাগেজ এরিয়া, কার্গো কমপ্লেক্স, জিএসই অপারেশন্স, হুইল চেয়ার সার্ভিস, ইউএলডি ম্যানেজমেন্ট, হেলপার ম্যানেজমেন্ট এরিয়াসহ গুরুত্বপূর্ণ শাখার কার্যক্রম তদারকি করে থাকেন এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে নিয়মিত প্রতিবেদন প্রেরণ করেন। অনলাইন টিকেটিং এবং ওয়েব চেক-ইন সেবা চালুর ফলে সম্মানিত যাত্রীরা ঘরে বসে নিজেরাই নিজেদের বা অন্যদের জন্য টিকিট ক্রয় করতে পারছেন এবং পছন্দ অনুযায়ী আসন নির্বাচন করে ডিজিটাল বোর্ডিং পাস বের করতে পারছেন।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স রুট সম্প্রসারণের উদ্যোগ হিসেবে শারজাহ, টরন্টো, নারিতা ও গুয়াংজুসহ ২১টি আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট চালু করেছে। শিগগিরই চেন্নাই ফ্লাইট চালু হচ্ছে। প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্যে বিমানের ডানা প্রসারিত করতে নব উদ্যোগের অংশ হিসাবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ বাহরাইনের গালফ এয়ারের সঙ্গে কোড শেয়ার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।

কোড শেয়ার চুক্তির ফলে সম্মানিত যাত্রীরা বিমানের টিকিটে গালফ এয়ারের ফ্লাইটে বাহরাইনসহ নতুন গন্তব্যে যাত্রা করতে পারবেন। বিমানের নতুন রুট চালুর পাশাপাশি লাভজনক রুটে ফ্লাইট সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। অভ্যন্তরীণ রুটে আন্তঃসংযোগ বৃদ্ধির প্রচেষ্টা হিসেবে সৈয়দপুর-কক্সবাজার ফ্লাইট চালু হয়েছে।

সম্প্রতি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট অপারেশন্স পরিদপ্তর বিদেশি পাইলটদের ড্রিমলাইনারে লাইন ট্রেনিং প্রদানের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার এভিয়েশন ইতিহাসে নবদিগন্তের সূচনা করেছে। বিমানের প্রশংসনীয় ফ্লাইট সেফটি স্ট্যান্ডার্ড ও দক্ষ প্রশিক্ষক পাইলটদের কারণে বিদেশি এয়ারলাইন্সের বিমান প্রদত্ত ট্রেনিংয়ের প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিমানের দক্ষ প্রশিক্ষকের থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে মঙ্গোলিয়ান এয়ারলাইন্সের পাইলটগণ প্রথমবারের মতো বোয়িং ৭৮৭-৯ ড্রিমলাইনার উড়োজাহাজ পরিচালনা করছে। অপরদিকে বিমানের প্রকৌশল পরিদপ্তর নিজস্ব সক্ষমতায় ড্রিমলাইনারের সি-চেক সম্পন্ন করে ২০ কোটি টাকার অধিক বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করেছে। এছাড়াও দেশের পাশাপাশি বিদেশি এয়ারলাইন্সকে প্রকৌশল সেবা প্রদানের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে অবদান রাখছে।

যাত্রী পরিবহনের পাশাপাশি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স দেশ ও বিশ্ববাসীর জরুরি প্রয়োজনে সেবামূলক ফ্লাইট পরিচালনার মাধ্যমে সর্বদা পাশে থেকেছে।

তুরস্কের ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য টরন্টো এবং ঢাকা থেকে বিনামূল্যে ত্রাণসামগ্রী পরিবহন করেছে বিমান। বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে সহযোগিতা প্রদানের অংশ হিসেবে তাদের জন্য বিনামূল্যে ত্রাণসামগ্রী পরিবহন করেছে। পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে আকাশপথে আসা ত্রাণসামগ্রীর গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং ও কার্গো হ্যান্ডলিং চার্জ বাবদ প্রায় ১২ কোটি টাকা মৌকুফ করেছে। গত মে মাসে সংঘাতপূর্ণ সুদান থেকে জেদ্দায় আশ্রয় নেয়া বাংলাদেশিদের দেশে ফিরিয়ে এনেছে।

এছাড়াও কোভিড-১৯ মহামারির সময় সাশ্রয়ী মূল্যে টিকা ও সুরক্ষাসামগ্রী পরিবহন এবং চীনের উহান শহর থেকে আটকে পড়া বাংলাদেশিদের ঝুঁকি নিয়ে মাতৃভূমিতে ফিরিয়ে এনেছে বিমান। জাতীয় পতাকাবাহী এয়ারলাইন্স হিসাবে প্রিয় দেশ ও দেশবাসীর প্রয়োজনে ভরসাস্থল হিসাবে সর্বদা পাশে আছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স।