মোবাইল ফোনে গেম : ক্ষতিগ্রস্ত তরুণসমাজ

রায়হান আলী

প্রকাশ : ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ক্রমেই বাড়ছে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার। বর্তমান সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনার অন্যতম হলো দেশকে তথ্যপ্রযুক্তিতে এগিয়ে নেওয়া। এরই মধ্যে দেশ এ খাতে যথেষ্ট এগিয়ে গেছে। শহরের সীমা ছাড়িয়ে নতুন নতুন প্রযুক্তির মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির নানা সুফল ক্রমেই মানুষের সহজলভ্য হচ্ছে। আর এই সহজলভ্যতাকে কাজে লাগিয়ে দিন দিন ইন্টারনেটের গ্রাহকের সংখ্যাও বাড়ছে। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর মধ্যে সংখ্যায় বেশি শিশু-কিশোর তথা শিক্ষার্থী ও যুবসমাজ। এই বয়ঃসন্ধিকালে কিশোররা মাদকের নেশার মতো ঝুঁকে যাচ্ছে ইন্টারনেটের অপব্যবহারসহ মোবাইল গেমিংয়ে। নিউটনের সূত্রমতে, প্রত্যেকটি ক্রিয়ারই একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছে। ঠিক তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে শুধু সুবিধা ভোগ করছে জনগণ, তা নয়; এর বিপরীতে অনেক অসুবিধা বা কুফলও ভোগ করছে জনগণ। সন্তানদের মেধা বিকাশে একটা সময় হা-ডু-ডু, গোল্লাছুট, ডাঙ্গুলি, দাঁড়িয়াবান্ধা, কানামাছি প্রভৃতি খেলার সুযোগ দিত অভিভাবকরা। পরবর্তীকালে অবশ্য ক্রিকেট-ফুটবলের প্রতি চাহিদাই বেশি দেখা যায় শিশু-কিশোরদের মধ্যে। দিন দিন গ্রামের খেলার মাঠগুলো চাষযোগ্য করে তুলে চাষিরা বিভিন্ন ফসল ফলাচ্ছে। পতিত জমি তেমনটা এখন গ্রামেও পাওয়া যায় না। এ তো গেল গ্রামের হালচিত্র, শহরেও তেমন কোনো খেলার সুযোগ নেই শিশু-কিশোর বা শিক্ষার্থীদের। শহরে অ্যাপার্টমেন্টগুলোয় খেলার কোনো জায়গা নেই। গ্রামে কিছুটা খোলামেলা পরিবেশে বাচ্চারা বড় হলেও সুযোগ থাকে না শহরে। ভুক্তভোগী অভিভাবকদের দাবি- ‘এই ডিজিটাল প্রযুক্তি আমাদের যতটা না উপকার করছে, তার চেয়ে বাচ্চাদের পিছিয়ে ফেলছে বেশি।’ সন্তানদের কী করে খেলার পরিবেশের অভাব পূরণ করা যায়, এ নিয়ে অনেক অভিভাবকের অনেক পরিকল্পনা থাকে। ফলে এখনকার ব্যস্ত অভিভাবকরা সন্তানকে শান্ত রাখতে মুঠোফোনসহ নানা যন্ত্রপাতি তাদের হাতে তুলে দেন। তারা নিজেরাও মুঠোফোনে ব্যস্ত থাকেন। অনেক সময় নিরাপত্তাহীনতার অজুহাতে সন্তানকে সব সময় নিজের চোখের সামনে দেখতে চান বাবা-মা। সেক্ষেত্রে তাদের হাতে মুঠোফোন, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, ট্যাব, ভিডিও গেমের ইকুইপমেন্ট ইত্যাদি তুলে দিয়ে আপাতত স্বস্তি অনুভব করেন, যা পরবর্তীকালে শিশু-কিশোরদের ইন্টারনেট ব্যবহারসহ নানা ভিডিও গেমে আসক্ত করে ফেলে। বাবা-মা নিজেরাও যদি সারাদিন ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মগ্ন থাকেন, সেক্ষেত্রেও সন্তানের মধ্যে আসক্ত হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। অভিভাবককে অনুসরণ কিংবা অনুকরণ করে চলে সন্তানরা। শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে করোনা সংক্রমণের সময়টিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ ছিল। তবে শিক্ষা কার্যক্রমের স্থবিরতা থেকে বেরিয়ে আসতে চলে সীমিত পরিসরে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম। বাবা-মা’রা সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা মাথায় রেখে তাদের হাতে তুলে দেন মোবাইল ফোন কিংবা কম্পিউটার। সন্তানরা তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে অনলাইন ক্লাসের ফাঁকে ইন্টারনেটের অপব্যবহারসহ নানা রকম ভিডিও গেমে আসক্ত হয়ে পড়ে। শিশু-কিশোর আর শিক্ষার্থীদের মোবাইল গেমে আসক্তির বিষয়টি ইন্টারনেট আসক্তি থেকে অনেকটা ভিন্ন। যুবকরা কিংবা শিক্ষার্থীরা দেখা গেল ইন্টারনেটে কেউ অতিরিক্ত পরিমাণে ভিডিও গেম খেলছে, আবার কেউ পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হচ্ছে। কেউ কেউ নানা ধরনের সফটওয়্যার নিয়ে ইন্টারনেটে মশগুল আর কেউবা ফেসবুক, ভাইবার, ইনস্টাগ্রাম, ইমোসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যয় করছে দিনের অধিকাংশ সময়। ধরে নেওয়া যায়, এসবই হচ্ছে ননকেমিক্যাল অ্যাডিকশন বা আচরণজনিত আসক্তি। বিশ্বজুড়ে এই ধরনের অ্যাডিকশনের বিষয়ে প্রকাশিত ১৬টি গবেষণাপত্র অ্যানালাইসিস করে বিশেষজ্ঞরা দেখেছেন, কিশোর ও তরুণদের মধ্যে চার দশমিক ছয় শতাংশ ইন্টারনেট গেমিংয়ে আসক্তিতে ভুগছে। তাদের মধ্যে ছয় দশমিক আট শতাংশ হচ্ছে কিশোর আর এক দশমিক তিন শতাংশ কিশোরী। অধিকাংশ মোবাইল গেমই হলো যুদ্ধের গেম। আর এই যুদ্ধের গেম খেলতেই বেশি আগ্রহ শিশু-কিশোর বা শিক্ষার্থীদের। প্লে-স্টেশনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তৈরি করা একটি গেমের প্রায় অধিকাংশ অংশই দেখা যায় যুদ্ধ, সহিংসতা ও রক্তপাত-সংক্রান্ত। এই খেলাগুলো আসলে শিশুদের ওপর কেমন প্রভাব ফেলে? নিশ্চয় সন্তানদের এমন গেমিং ভবিষ্যতের জন্য ভালো কিছু বহন করে না। সন্তানরা যে কতটা ঝুঁকে গেছে ইন্টারনেট ব্যবহার ও মোবাইল গেমের প্রতি, তা বলাবাহুল্য। নিয়মিত স্কুল শেষে শিশুদের অবসর সময় কাটে প্লে স্টেশন, কিংবা স্মার্টফোন, নয়তোবা ট্যাবের স্ক্রিনে। ভিডিও গেমের প্রতি শিশু-কিশোরদের আগ্রহ নতুন কিছু নয়। তবে এই আসক্তিকে সম্প্রতি ‘মানসিক রোগের’ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বহুদিন ধরে বলছিলেন, ভিডিও গেমের অতিরিক্ত আসক্তিতে একদিকে যেমন শিশু-কিশোরদের সামাজিকীকরণ বাধাগ্রস্ত হয়, তেমনি মেধা বিকাশেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ইন্টারনেট আসক্তির প্রভাব ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উন্নতির অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকের শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তাই এ শিশু-কিশোরদের ইন্টারনেট আসক্তি ও মোবাইল ফোনে গেমিং আসক্তি দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করছে। অনেক অভিভাবক সন্তানদের এমন আসক্তি টের পেয়ে তাদের নানাভাবে বকাঝকাও করছে। আর এই বকাঝকার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য সন্তানরা বাবা-মায়ের অগোচরে নাস্তা, বই, খাতা-কলম ইত্যাদি কেনার টাকা বাঁচিয়ে ইন্টারনেট ক্যাফেতে যাচ্ছে, কিংবা মোবাইলের মাধ্যমে গেমিং অ্যাপ ডাউনলোড করে গেম খেলছে। তাদের মনোনিবেশ বাড়ছে মোবাইল গেমের প্রতি, লেখাপড়ায় নয়। বাংলাদেশে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তথ্যমতে, ২০১৯ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশে প্রায় ৯ কোটি ৩৭ লাখ মানুষ ইন্টারনেটের গ্রাহক ছিল, যাদের মধ্যে ৮ কোটি ৭৯ লাখ ব্যবহারকারী মুঠোফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেটে যুক্ত হয়। এছাড়া বিটিআরসির ২০১৬ সালের তথ্যমতে, বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ৩৫ শতাংশ হচ্ছে মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী, অর্থাৎ বয়ঃসন্ধিকালের কিশোর-কিশোরী। হয়তোবা বর্তমানে আরো অনেকগুণে বেড়ে গেছে এ আসক্তির সমীকরণ। মোবাইল গেমের প্রভাবে ধীরে ধীরে বাবা-মায়ের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে থাকে সন্তান। কথায় কথায় বাবা-মায়ের প্রতি রূঢ় আচরণ করতে থাকে সন্তান। নিয়ন্ত্রণহীন সন্তান সঙ্গ দেয় কিশোর গ্যাং কিংবা আরেক নষ্ট বন্ধুকে। একটা সময় সন্তান হয়ে যায় খারাপ, সঙ্গদোষে মানসিক রোগী। শুরু হয় সন্তানের জীবনের উল্টো চলা। একাধিক সন্তানকে নিয়ন্ত্রণ করা তো বহুলাংশে দুঃসাধ্যের বিষয়। সন্তানদের মোবাইল গেমিং থেকে বিরত রাখতে অনেক অভিভাবক নাস্তানাবুদ। গেমিং করার জন্য বর্তমানে শিশু-কিশোর বা শিক্ষার্থীরা স্মার্টফোন ব্যবহার করছে বেশি। তাই বিশ্বে গেমিং বিভাগে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে মোবাইল গেমিং। এ ধংসাত্মক নেশা থেকে তরুণদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাঁচাতে এগিয়ে আসতে হবে সরকার ও জনগণ, তথা দায়িত্ববান অভিভাবকদের। এ নেশা থেকে তরুণদের বাঁচাতে কয়েকটি উপায়ের কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। এগুলো হলো প্রতিদিন কম সময় ফোন ব্যবহারের জন্য প্রণোদনা দিন। মোবাইল ফোন দৃষ্টির বাইরে রাখলে তার প্রভাবও কম পড়ে। তাই ফোনটি লুকিয়ে রাখুন। মেসেঞ্জারে অন্যরা যেন অযথা বিরক্ত না করে, সেজন্য বিরক্ত করবেন না, লিখে রাখুন। দিনের একটি সময়কে ‘স্ক্রিনবিহীন সময়’ হিসেবে নির্ধারণ করুন। এ সময় কোনোভাবেই স্মার্টফোন ব্যবহার করবেন না। এ ছাড়া নিজ সন্তানদের কীভাবে কন্ট্রোল করা যায়, সেটার সঠিক উপায় খুঁজে বের করতে হবে সচেতন অভিভাবকদের।

রায়হান আলী : আইনজীবী ও কলাম লেখক।