পোশাকের রাজনীতিকরণ ও বিশ্বব্যবস্থা

ইমামুল ইসলাম

প্রকাশ : ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

হিজাব সাধারণত মুসলিম নারীরা মাথায় স্কার্ফ হিসেবে পরে থাকেন। বিশ্বের বড় বড় শহরগুলোতে মুসলিম নারীদের মধ্যে হিজাবের প্রচলন দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে; সঙ্গে সঙ্গে হিজাবের রাজনীতির ব্যাপকতাও বৈশ্বিক বলয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করছে। হিজাব নিয়ে যে পরিমণ্ডলেই আলোচনা হোক না কেন, কিন্তু হিজাব নিয়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের পবিত্র ধর্মগ্রন্থে সুস্পষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই। পবিত্র কোরআনে মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) তাঁর অনুসারীদের (সাহাবাদের), তাদের স্ত্রীদেরকে আড়াল করার জন্য পর্দার বিধান রয়েছে। হিজাবকে সাধারণত মার্জিত পোশাক হিসেবে ধরা যায়। পবিত্র কোরআনে পুরুষ-নারীর উভয়ের জন্য মার্জিত পোশাক পরিধানের নির্দেশনা রয়েছে। মুসলিম নারী-পুরুষের পোশাকের বিধান নিয়ে সুরা আন নুরের ৩০-৩১ নম্বর আয়াতে উল্লেখ আছে- মুমিন পুরুষদের বলো, তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাজত করতে; এটাই তাদের জন্য অধিক পবিত্র। নিশ্চয় তারা যা করে, সে সম্পর্কে আল্লাহ সম্যক অবহিত। (আর মুমিন নারীদের বলো, যেন তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাজত করে। আর যা সাধারণত প্রকাশ পায় তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য তারা প্রকাশ করবে না। তারা যেন তাদের ওড়না দিয়ে বক্ষদেশ আবৃত করে রাখে। ....আর তারা যেন নিজেদের গোপন সৌন্দর্য প্রকাশ করার জন্য সজোরে পদচারণা না করে) উক্ত আয়াত দুটিতে কোথাও মাথায় হিজাব পরার বিধান আছে- এমন সুস্পষ্ট নির্দেশনা নেই। তাই এখান থেকে হিজাব নিয়ে একটা দোদুল্যমান তথ্য পাওয়া যায়। কেউ মনে করেন হিজাব বাধ্যতামূলক, কেউ বা মনে করেন হিজাব অপশনাল। হিজাব সাধারণত বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও বাস্তবতার নিরিখে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। মাথায় স্কার্ফ কিংবা হিজাব পরিধান প্রচলিত বড় বড় ধর্মে রয়েছে। মাথা কাপড় দিয়ে আবৃত করার প্রচলন ইহুদি, খ্রিষ্টান ও হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে দেখা যায়। কিন্তু এ প্রচলিত নিয়ম তাদের মধ্যে বেশি মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়নি এবং লিঙ্গভিত্তিক বিতর্কিত ইস্যুও হয়নি। যেমনটা উনিশ শতকে মধ্যপ্রাচ্যে উপনিবেশিক শাসনামলে মুসলিম সমাজে পর্দা কিংবা হিজাব আলোড়ন তুলেছে। উনিশ শতকে পোশাকের এ ধরনটি মুসলিম সম্প্রদায়ের একটা প্রতীকে পরিণত হয়। মধ্যম পন্থা অবলম্বন করতেন। নারীরা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেবেন তারা হিজাব পরবেন, মাথা এক টুকরো কাপড় দিয়ে আচ্ছাদিত করবেন, নাকি মাথায় কোনো কাপড় থাকবে না। হিজাবি মাথা কিংবা হিজাবহীন মাথা এটা নারীর নিজস্ব ব্যাপার।

তৃতীয়ত, মুসলিম নারীদের একটা শ্রেণি, যারা আবার নিজেদের ইসলামি আন্দোলনের অগ্রযোদ্ধা মনে করেন; তাদের কাছে হিজাব বাধ্যতামূলক অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচিত। সত্তরের দশকে ইরানে পাহলভি রাজতন্ত্রের অপরিসীম দুর্নীতি, রাজনৈতিক পীড়ন এবং জীবনযাপনে অতিশয় বিলাসিতার বিরুদ্ধে মুসলিম নারীরা হিজাব প্রতিবাদের প্রতীক ও প্রতিরোধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। এ সময় ইরানি নারীদের মধ্যে হিজাবের প্রচলন দেখা যায় এবং পাহলভি রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে হিজাব প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে ওঠে। হিজাব বা পর্দার বাস্তবতা জীবনচারণের ক্ষেত্রে অনেক বিতর্ক ও বহুমুখী প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। আশির দশকে ইরানে রক্ষণশীল মুসলিম পণ্ডিত ও নেতারা নারীদের জনসম্মুখে চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করেন। তবে হিজাব একটি মধ্যম ধারার (মডারেট) পোশাক, যা সে সময় নারীদের সুযোগ-সুবিধা অর্জনের ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব রাখে। আশির দশকে মিশরে হিজাব নারীদের শিক্ষার অধিকার লাভ ও বাইরে চাকরি কিংবা কাজ করার ক্ষেত্রে সহায়তা করেছে। হিজাব না হলে ওই সময় নারীরা এ সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতো।

হিজাব, অন্যান্য প্রচলিত মাধ্যম ধারার পোশাক, জিলবাব (এমন পোশাক যা গলা থেকে পা পর্যন্ত ঢেকে ফেলে) ও নিকাব (চেহারা আবৃত করার এক টুকরো কাপড় যা বাইরে বের হওয়ার সময় নারীরা পরে) নারীদের জীবনে এক জটিল ভূমিকাও রেখেছে। অনেক মুসলিম নারীই এ ধরনের পোশাক তখন এবং এখন ধর্মবিশ্বাসের অনুষঙ্গ হিসেবে মেনে নিয়ে পরিধান করেছে এবং করছে। ইরানে ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লব ঘটার পর হিজাব নামক পোশাকটি ধর্মীয় মোড়কে ব্যাখ্যা-অপব্যাখ্যা হতে থাকে। পশ্চিমা গণমাধ্যম এমন ব্যাখ্যা প্রদান দেয় ইরানি সমাজব্যবস্থা নারীদের নীচ ও হীন মনে করে; যদিও নারীরা এক বছর আগে স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বেচ্ছায় প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে এ হিজাব পরতেন। আয়াতুল্লাহ খোমেনি যখন নারীদের হিজাব পরার বিধান আরোপ করলেন, তখন ইরানের মধ্যমপন্থি নারীবাদীরা এর বিরোধিতা করে পশ্চিমা নারীবাদী ধারার দিকে ঝুঁকে পড়ে।