ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কিছু উচ্চারণে ত্রুটি ও আঞ্চলিক ভাষার সংকট

রণজিৎ সরকার
কিছু উচ্চারণে ত্রুটি ও আঞ্চলিক ভাষার সংকট

লিখতে পড়তে জানা মানুষের মুখের উচ্চারণ সঙ্গত কারণে নির্ভুল হতে হয়। শিক্ষিত জনের উচ্চারণ অন্য সাধারণের কাছে মর্যাদার, অনুসরণযোগ্য। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সেভাবেই শেখানো হয় বাংলাভাষার প্রমিত বানান, প্রমিত উচ্চারণ। তারপরও শিক্ষিত অনেকের কণ্ঠেই হরহামেশা কিছু ত্রুটিযুক্ত উচ্চারণে কথা বলতে শোনা যায়। এর কিছু নমুনা দেওয়া যেতে পারে। যেমন: ‘গ’-এর উচ্চারণে ‘ক’, ‘জ’-এর উচ্চারণে ‘চ’, ‘ব’-এর উচ্চারণে ‘প’। উদাহরণস্বরূপ- আজকের পত্রিকায় পড়লাম। আজ্-কের স্থলে উচ্চারণ করা হয় আচ্কের। কাঁদতে দেখলাম।

কাঁদ-তের স্থলে উচ্চারণ করা হয় কাঁৎতে। তুমি কী ভাবছো, এখানে ‘ভাবছো’ এর স্থলে উচ্চারণ করা হয় ভাপ্ছো। উপস্থিত সুধীবৃন্দের স্থলে সুধীবিন্দু, শিল্পীগোষ্ঠীর স্থলে শিল্পগোষ্ঠী। এমন অসংগতিপূর্ণ উচ্চারণ প্রায়ই শোনা যায়। বিশেষত শিক্ষক, যারা মিডিয়ায় কথা বলেন, বাচিকশিল্পী, কণ্ঠশিল্পী, অভিনয়শিল্পী, মাইক্রোফোন ব্যবহারকারী সবাই সচেতন হলে এমন ত্রুটি থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব। এর পাশাপাশি অবজ্ঞার কারণে কোনো কোনো আঞ্চলিক ভাষা হেয়প্রতিপন্ন হচ্ছে। অনেক অঞ্চলের শিক্ষিতজন তার নিজ অঞ্চলের ভাষা ব্যবহারে অনীহা বোধ করেন, হীনম্মন্যতায় ভোগেন, নিন্দা পোষণ করেন। অথচ প্রতিটি ভাষা ব্যবহারকারীর কাছে কত সাবলীল, গ্রহণীয়, মায়ের মতোই আপন। মাকে যেমন অধিকারে রাখে সবাই, তেমনি মুখের ভাষাকেও তারা নিজের অধিকারে রাখে। আপন ভাষাকে প্রয়োজনমতো, সুবিধামতো ব্যবহার করতে চলে পরিবর্তন, সৃজন।

শ্রমজীবী, মেহনতি, খেটে-খাওয়া মানুষগুলো যেন শব্দ তৈরির প্রাকৃতিক খনি। সেখানে নিত্যই চলছে শব্দ তৈরি। বাক্যে এসব শব্দের প্রয়োগ চলমান জীবনধারার মতো। উত্তরাঞ্চলের ভাষার সেরকম কিছু পরিবর্তন-সংযোজন উল্লেখ্য। যেমন- আমি আসতেছি থেকে ক্রমান্বয়ে আস্ব্যার নাগ্ছি, আস্সেন্নচ্ছি। যাচ্ছি থেকে যাবার নাগ্ছি- যাবান্নচ্ছি- যান্নচ্ছি। পরিবর্তনগুলো কোনো না কোনো নিয়মেই সম্পন্ন হয়ে চলেছে। গণমানুষ কখনোই তার নিজ ভাষাকে ছাড়ে না। বরং আঞ্চলিকতাকে দোষ হিসেবে দেখে তথাকথিত শিক্ষিতজন। উত্তরাঞ্চলের এ ধরনের শিক্ষিত মানুষের মধ্যে এই দৃষ্টিভঙ্গী বোধ হয় একটু বেশিই প্রকট।

উত্তরাঞ্চলের যারা কর্মের প্রয়োজনে কিংবা অন্য কাজে নিজ এলাকার বাইরে, বিশেষ করে ঢাকায় বাস করেন, তারা নিজ মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করে ‘ঢাকাইয়া’ ভাষায় কথা বলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তাদের এই বাচনিক পরিবর্তন আত্মতুষ্টির কারণ কি না বোধগম্য নয়। রংপুর হলো বাহের দ্যাশ, মফিজের দ্যাশ। সে জন্যই কি অস্বস্তি, অবজ্ঞা এড়াতে ওইসব মানুষ ঢাকাইয়া বোল ধরে। মোবাইলে বাড়িতে কথা বলতেও তারা ‘র্হ্যা লগে’, ‘হর লগে’, এমনকি পরিবারে কিংবা জনসম্মুখে উচ্চারণ অযোগ্য কিছু শব্দও ব্যবহার করেন ঢাকাইয়া ভাষায়। তারা হয়তো বোঝাতে চান- অভিজাত এলাকায় থাকি, তাই সে এলাকার ভাষাই ব্যবহার করি। অথচ উত্তরের বিভিন্ন শহর-বন্দরে অনেক আগে ঢাকা কিংবা দক্ষিণের অন্য অঞ্চল থেকে ব্যবসার জন্য যারা স্থায়ী হয়েছে তারা কখনোই তাদের ভাষা বাদ দিয়ে কথা বলে না। চলচ্চিত্র, নাটকে ঢাকাইয়া ভাষার যথেচ্ছ ব্যবহার ভাষার ক্ষেত্রে একরকমের আগ্রাসনের রূপ নিয়েছে। এ বিষয়ে শিক্ষিতজনের সজাগ হওয়া দরকার। নইলে ভাষা গড়িয়ে যায়, হারিয়ে যায়। সেই সঙ্গে ভাষার আপন বৈশিষ্ট্যও হারিয়ে যায়, মিলিয়ে যায়। সব জীবন্ত ভাষা চালু রাখা ও সংরক্ষণের ব্যাপারে সচেতন প্রচেষ্টা দরকার। এ দায়টা শিক্ষিতজনদেরই নেওয়া উচিত।

রণজিৎ সরকার : অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত